… ‘‘আপনাকে একটু খারাপ করে গাইতে হবে।’’ …
স্বয়ং ছবির পরিচালকের এমন কথায় আকাশ থেকে পড়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
‘দেয়া নেয়া’ ছবির গান। ‘দোলে দো দুল দোলে ঝুলনা’। তারই রেকর্ডিং-এর আগে রিহার্সাল।
সঙ্গীত পরিচালক শ্যামল মিত্র আছেন। ইউনিটের অন্যরাও উপস্থিত। তারই ফাঁকে অমন বজ্রপাত।
‘‘মানে! কেন? কী বলছেন আপনি!’’
পরিচালকের যুক্তি, ‘‘আসলে ছবিতে নায়ক (উত্তমকুমার) গান জানেন। তাঁর বন্ধু (তরুণকুমার) গাইতে পারেন না। গল্পে এমনই বলা আছে। নায়কের গানটা শ্যামলবাবুর (মিত্র)। আপনি গাইছেন বন্ধুর লিপে।’’
‘‘তা বলে খারাপ করে গাইতে হবে! তা হলে আমাকে ডেকেছেন কেন? আমায় বরং ছেড়ে দিন।’’
গম্ভীর হয়ে উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন মানবেন্দ্র। তখনই নায়ক উত্তমকুমারের প্রবেশ। কনট্রোল রুমে বসেছিলেন এতক্ষণ। এ ঘরের সব কথাই তাঁর কানে গেছে। ঢুকেই বললেন, ‘‘মানব, তুই উঠিস না।’’
মানবেন্দ্রর মনের অবস্থাটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি। আলাপ তো আর এক দিনের নয়। যখন তিনি চলচ্চিত্রেরই ধারেকাছে নেই, তখন থেকেই। টালিগঞ্জের বাঙাল পাড়ায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে তবলা শিখতে যেতেন সে দিনের অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। সে কত কাল আগে! সেই আলাপ আরওই জমে গিয়েছিল ‘সাড়ে ৭৪’-এ একসঙ্গে অভিনয় করায়।
ইউনিটের লোকজনের দিকে তাকিয়ে উত্তম বললেন, ‘‘দেখুন, গল্পটা তো রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের নয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরও নয়। একটু বদলে নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। নায়কের বন্ধুকে গায়ক করতে দোষ কী! মানবকে আপনারা ডেকেছেন, ও তো চাইবে ওর একশো ভাগ দিতে। যেমন আমার কাছ থেকেও আপনারা আশা করেন। ওর মতো এক জন গায়ক খারাপ করে কী করে গাইবে?’’
এই কথায় কাজ হল। ভাগ্যিস! নইলে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা দ্বৈত সঙ্গীতের যে কী হত, কে জানে!
সে-যাত্রায় বন্ধু উত্তম পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আবার সেই বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েও এক বার সঙ্গীত পরিচালনার কাজ থেকে সরে আসেন মানবেন্দ্র।
‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবি করবেন উত্তমকুমার। সঙ্গীত পরিচালনার জন্য ডাকলেন তাঁর ‘মানব’কে। প্রথম সিটিঙে গিয়ে মানবেন্দ্র দেখেন, তিনি একা নন। শ্যামল মিত্র সহ আরও জনা তিন-চার সঙ্গীতকার রয়েছেন।
সবাই মিলেই একই ছবিতে একসঙ্গে সঙ্গীত পরিচালনা করবেন। ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি মানবেন্দ্রর। সরে দাঁড়ান। বলেছিলেন — ‘‘এত অ্যামেচারিশ ব্যাপার আমার পোষাবে না।’’ অ্যামেচারিজম পছন্দ নয়। গানের সঙ্গে তাঁর জড়িয়ে পড়ার মধ্যে অদ্ভুত সব কাতরতা। আর তার জন্যই বোধ হয় অমন বিচিত্র ভাবে প্রথম বার সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
১৯৫৩ সাল। নির্মল দে-র পরিচালনায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ তখন সদ্য মুক্তি পেয়েছে। এই ছবির শুটিং চলাকালীনই মানবেন্দ্রকে নিজের পরের ছবি ‘চাঁপাডাঙ্গার বৌ’-এর সংগীত পরিচালনার জন্য নির্বাচন করেছিলেন পরিচালক নির্মল দে। তবে শর্ত একটাই, যেহেতু এই ছবির কাহিনিকার এবং গীতিকার তারাশঙ্কর নিজেই, তাই তাঁর অনুমতি প্রয়োজন। ইতিপূর্বে ছায়াছবিতে সংগীত পরিচালনার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না মানবেন্দ্রর। তবুও এক দিন সকালে নবাগত এই সংগীতপ্রতিভাকে নিয়ে টালা পার্কের বাড়িতে এলেন নির্মল দে। বসার ঘরের টেবিলে তারাশঙ্কর তখন ‘চাঁপাডাঙ্গার বৌ’-এরই গান রচনার কাজ করছিলেন। নবাগত মানবেন্দ্র তাঁর কাহিনি-নির্ভর ছবির সংগীত পরিচালনা করবেন এটা জেনে প্রথমটা খুব একটা খুশি হননি লেখক। পরে একটি চিরকুটে গানের দু’লাইন লিখে মানবেন্দ্রর হাতে দিয়ে তাতে তখনই সুর করতে বলেন লেখক। তারাশঙ্করের কাছে শুধু গানের সিচুয়েশনটা জেনেই মানবেন্দ্র চোখ বন্ধ করে গেয়ে ওঠেন সেই বিখ্যাত গাজনের গান, ‘শিব হে শিব হে অ শিব শঙ্কর…’। চোখ খুলে দেখেন ওই গানের তালে তারাশঙ্করবাবুও নাচছেন আর পরিচালককে বলছেন, ‘নিয়ে নাও, একে নিয়ে নাও, এই ছেলে পারবে।’ ছবিতে উত্তমকুমারের মুখে এই গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল। আর এই ছবি দিয়েই বাংলা ছবিতে সুরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
বিয়ে করতে গিয়ে হবু শাশুড়ি-মাকে পাঁজাকোলা করে নিয়েছিলেন যে মানুষটা, তিনি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
তাঁর জন্ম কালীঘাটে হলেও বড় হওয়া টালিগঞ্জের ভবানী সিনেমার পাশের গলিতে, বাঙাল পাড়ায়। যৌথ পরিবার। বড় সংসার।
তাঁর পিতা, অতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন আর্কিটেকচারাল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁরা ছিলেন দশ ভাই। গানবাজনা ছিল পরিবারে বহু কালের সঙ্গী। বাঙাল পাড়ায় আজও ‘গানের বাড়ি’ বললে, লোকে মুখোপাধ্যায়দের পুরনো বাড়ি চিনিয়ে দেয়।
মানবেন্দ্রের পিতা এস্রাজ বাজাতেন। তাঁর অন্যান্য ভাইদের মধ্যে রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত কীর্তনীয়া। সিদ্ধেশ্বর, মনোজেশ্বর মার্গ সঙ্গীতের সাধক। সত্যেশ্বর সব ধরনের গান করতেন। মানবেন্দ্রের গান শেখা এই কাকাদের কাছেই।
এখান থেকে মানবেন্দ্রের পিতা চলে যান বিজয়গড়ে। সে সময় বিজয়গড় হদ্দ গ্রাম। ওখানে তখন কলোনি-ল্যান্ড দেওয়া হচ্ছিল। তারই খানিক জমি নেন তিনি। তাঁদের দেশের বাড়ি ছিল বরিশালের উজিরপুরে। বিশের দশকে তাঁরা সপরিবার এ পারে চলে আসেন।
মানবেন্দ্রের ঠাকুর্দা ছিলেন গজেন্দ্রনাথ। তিনিও অসম্ভব সঙ্গীত-রসিক ছিলেন। রজনীকান্ত সেনের সঙ্গে এক মেসে থাকতেন। ভক্তিগীতি, হরিনামের গান করতেন। রজনীকান্ত গান লিখলে গজেন্দ্রনাথকে দেখাতেন। দেশের বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে গান লেগেই থাকত। রাধাকৃষ্ণের লীলা কীর্তন, রয়ানী গান, মনসামঙ্গলের আসর। নদীঘাটে, নৌকায় মাঝিমাল্লার গান তো ছিলই। সারিন্দা বাজিয়ে তাঁরা সারি জারি ভাটিয়ালি ধরতেন। মাঝিরা গাইতেন হরিনাম সংকীর্তন।
দেশের বাড়ি উজিরপুর, তার হাওয়াবাতাসের উড়ান মানবেন্দ্র কে গানের পাকদণ্ডিতে নিয়ে ফেলে। তাঁর কাকা রত্নেশ্বর ছিলেন আবার কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু। কিশোরবেলায় মানবেন্দ্রের গলায় কীর্তন শুনে মুগ্ধ হয়ে নজরুল দুটো গান শিখিয়েছিলেন তাঁকে।
গানের জন্য এক দিকে আবেগী। অন্য দিকে বেপরোয়া। নাছোড়। সে একেবারে ছোট থেকেই।
ইন্টার কলেজিয়েট কম্পিটিশন। সেখানে কীর্তন, টপ্পা, ঠুংরির সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতে হবে। বাকিগুলো নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত?
বাড়ির পরিবেশ ভরপুর গানের, কিন্তু কোনও দিন রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা তেমন করা হয়নি। কাকা রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়। দিকপাল সঙ্গীতজ্ঞ। বললেন, ‘‘জর্জ বিশ্বাসের (দেবব্রত বিশ্বাস) কাছে যা। পারলে ওই তোকে গাইড করতে পারবে।’’
ভোরে লেকে জগিং করার অভ্যাস ছিল মানবেন্দ্রর। জর্জ বিশ্বাস তখন থাকতেন সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এ। দিনভর তাঁর বাড়ির দরজা খোলা। জগিং সেরে ঢুকে গেলেন দরজা ঠেলে। এলোমেলো ঘর। মশারি টাঙানো। ঘুমিয়ে আছেন দেবব্রত বিশ্বাস। সটান মশারি তুলে হাত দিয়ে তাঁকে ঠেলাঠেলি করতেই উনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললেন, ‘‘আপনি ভারী অসভ্য ইতর লোক তো! না বলে কয়ে ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত লোককে তুলে দিচ্ছেন!’’
ভয়ে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মানবেন্দ্র। বাড়ির কর্তা বিছানা ছেড়ে উঠে মুখ ধুয়ে জাঁতি হাতে সুপারি কাটতে কাটতে আড়চোখে খানিক চেয়ে দেখতে দেখতে বললেন, ‘‘মশায়ের কী করা হয়?’’
‘‘ছাত্র।’’
‘‘দেখে তো মনে হয় না ভাল কিছু কাজ করেন। তা আগমনের হেতু?’’
‘‘ইন্টার কলেজ কম্পিটিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হবে। আপনার কাছে শিখব।’’
‘‘প্রতিযোগিতা কবে?’’
‘‘আজ বিকেলে।’’
জর্জ বিশ্বাস শুনে বাক্যহারা। এ-ছেলে বলে কী!
‘‘আমার কাকা রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়। উনিই আপনার কাছে পাঠালেন।’’
এর পর সদয় হলেন জর্জ বিশ্বাস। গান শেখাতে বসলেন— ‘ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশেরও পাখি’। কিছুক্ষণ বাদে জর্জ অফিসে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর বোনকে বলে গেলেন, ‘‘যতক্ষণ না ওঁর গানটা ঠিক হচ্ছে, ছাড়বি না।’’
সে আর আটকানো যায়নি। একটু বাদেই বোনের নিষেধ সত্ত্বেও চলে এসেছিলেন। কিন্তু বিকেলবেলা প্রতিযোগিতায় গিয়ে চমকে গেলেন। বিচারকদের চেয়ারে শৈলজারঞ্জন মজুমদার, অনাদি দস্তিদারের পাশে স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস! মানবেন্দ্রকে দেখে উনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। প্রতিযোগিতায় তাঁকে তিনি কোনও নম্বরও দেননি। কিন্তু সবার বিচারে প্রথম হলেন মানবেন্দ্রই।
এর পর আবার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে দেখা করতে যেতেই জর্জ বললেন, ‘‘শুনুন, আপনাকে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে। এই আপনার প্রথম আর শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া। এ লাইন আপনার নয়।’’
সেই থেকে পারতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের গানের ধার মাড়াননি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
গান নিয়ে ওঁর প্যাশনটা যে কী পর্যায়ের ছিল! কত বার হয়েছে, রেকর্ডিং করতে বসে কখনও সুরের গমকে কেঁদে ফেলেছেন। আবার সুর আসছে না, কথা ভাল লাগছে না বলে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, এমনও হয়েছে।
এক বার এমনই এক কারণে সুরকার নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে বড়সড় ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যাচ্ছিল প্রায়।
সে বছর পুজোয় বিখ্যাত এক গানের মহলা। ‘বনে নয় মনে মোর’। রেকর্ডিং হবে একটু পরেই। অথচ নচিকেতার তৈরি মুখড়টা কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না।
শেষে তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দীকে মানবেন্দ্র বললেন, ‘‘তুই একটা টুকরো বাজা তো।’’ বাজালেন রাধাকান্ত। সেটাই গানের মুখে লাগালেন।
এ বার মানবেন্দ্র-রাধাকান্ত দু’জনেরই খুব পছন্দ হল। নচিকেতা গেলেন রেগে। তক্কাতক্কি করে উঠেই গেলেন মহলা ছেড়ে।
মহলা কিন্তু থামল না। রেকর্ডিংও হল। এই পুরো সময়টা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার অলক্ষ্যে গান শুনেছিলেন নচিকেতা। ধীরে ধীরে গানটা ওঁর মনে ধরে গেল। শেষে এসে জড়িয়ে ধরলেন মানবেন্দ্রকে।
‘মায়ামৃগ’র গান বাঁধা হচ্ছে। গীতিকার শ্যামল গুপ্ত। মানবেন্দ্রর বহুকালের বন্ধু। যখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্যামলের বিয়ে হয়নি, তখন থেকেই তাঁরা হরিহর আত্মা।
এই বন্ধুতা শুধু দু’জনের নয়, সম্পর্ক ছিল পরিবারে-পরিবারে। তা যে কতটা ঘন, বোঝাতে দুই বাড়ির একটা রীতির কথা বলা যেতে পারে।— প্রত্যেক বছর অক্ষয় তৃতীয়ায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নর্থ রোডে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে যেতেন। এক কুঁজো জল, এক থালা ফল আর মিষ্টি নিয়ে। এ প্রথা কবে শুরু হয়েছিল বলা মুশকিল, কিন্তু চলেছিল মানবেন্দ্রর জীবনের একেবারে প্রান্তবেলা অবধি।
মায়ামৃগ-র সময় শ্যামল গুপ্তকে মানবেন্দ্র বললেন, ‘‘নায়ক বিশ্বজিৎ নায়িকা সন্ধ্যা রায়ের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু নায়কের সব কথাতেই ডাক্তারির প্রসঙ্গ এসে পড়ে। এমনকী প্রেম নিবেদনের সময়ও তাই। এটাকে মাথায় রেখে একটা গান লেখ।’’
মানবেন্দ্র তখন ফার্ন রোডে ‘গীতবীথিকা’ নামে একটি স্কুলে গান শেখান। ক্লাসের পর সেখানে বন্ধু শ্যামলের সঙ্গে গান-আড্ডাও হয়।
তেমনই এক রবিবারের বিকেলে শ্যামল গুপ্ত হাজির হলেন ফার্ন রোডে। সঙ্গে গান— ‘মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য’। দেখে বললেন, ‘‘ছ্যা, এ কী লিখেছিস! এ একেবারে চলবে না। গান লেখা টুকরো কাগজটা হাতে নিয়ে মুচড়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন জানলা দিয়ে। বন্ধু আর কী করেন! মুষড়ে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়লেন।
ঘণ্টা দুই গড়াল। গানের ক্লাস শেষ। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে মানবেন্দ্র দেখলেন বন্ধু পাংশুমুখে বসে। বললেন, ‘‘নারে, গানটা তুই মন্দ লিখিসনি। দেখি এক বার!’’
এ বার রাগে-অভিমানে শ্যামল বললেন, ‘‘তুই তো ফেলে দিলি রাস্তায়। আমার কাছে কোনও কপিও নেই। ট্রামে আসতে আসতে হাতে যা ছিল, তার ওপরে লিখেছিলাম…।’’
তা হলে?
তখন সন্ধে নেমে গেছে। রাস্তায় আলো প্রায় নেই। টর্চ হাতে তোলপাড় খোঁজ চলল তার মধ্যেই। শেষে দলা পাকানো টুকরো কাগজটার খোঁজ মিলল নর্দমার পাশে। এর পর ‘মেটেরিয়া মেডিকার’ জনপ্রিয়তা তো আকাশ ছুঁয়ে যায়। যেখানে অনুষ্ঠানে যেতেন, ‘মেটেরিয়া’ না শুনিয়ে রেহাই নেই। গানের লিপ দিতে মঞ্চে ডাক পড়ত বিশ্বজিতের।
এই শ্যামল গুপ্তরই লেখা ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’। মানবেন্দ্র বলতেন, ‘‘ও আমার ভূতে পাওয়া গান।’’
তখন রেডিয়োয় লাইভ ব্রডকাস্টের যুগ। ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেস থেকে ইডেনে আসেনি আকাশবাণী। এক অনুষ্ঠান শেষে পরের অনুষ্ঠানের মাঝে অনেকটা ফাঁকা সময় থাকলে অফিসেই কাটিয়ে দিতেন অনেকেই।
তেমনই এক দিনে ছাদে পায়চারি করতে করতে গুনগুন করে গান গাইছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। নিঝুম সন্ধেবেলা। ঠিক নীচে কবরখানার দিকটা জমাট কালো। ও-বাড়ির সাহেব-ভূতের গল্প বহুশ্রুত। তাতে ভ্রুক্ষেপ ছিল না তাঁর।
হঠাৎ কেউ যেন ডেকে উঠল, ‘‘মানব, মানব।’’ চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখেন দুটো চোখ। জ্বলছে।— ‘‘কে?’’
‘‘আমি শ্যামল। একটা গান লিখে ফেলেছি। শুনবি?’’
একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘‘বল।’’
অন্ধকারে দাঁড়িয়েই শুনতে লাগলেন গানের কলি— ‘‘…তোমার কাজল চোখে যে গভীর ছায়া কেঁপে ওঠে ওই/তোমার অধরে ওগো যে হাসির মধু মায়া ফোটে ওই/তারা এই অভিমান বোঝে না আমার…।’’
সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। শেষ হতেই এক হাতে বন্ধুকে পাকড়ে ধরে সোজা পাঁচ নম্বর স্টুডিয়ো। ওখানে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো রাখা। সন্ধে পাঁচটার পর সে-ঘরের দরজা তালাবন্ধ থাকে। পিয়ানোর ডালায় চাবি দেওয়া। কিন্তু সে দিন যে কী হল!
দরজার ‘ল্যাচ’ ঘোরাতেই খুলে গেল! ডালায় হাত দিয়ে ওঠাতে উঠে গেল! তাতে বসেই গানের মুখড়াটা করে ফেলেছিলেন মানবেন্দ্র।
পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বিস্ময়ের ঘোর জীবনের শেষ দিন অবধি তাঁর কাটেনি। কেবলই বলতেন, ‘‘ও আমার ভূতে পাওয়া গান।’’
মেহদি হাসানের গজলের পাগল-ভক্ত ছিলেন। উল্টো দিকে মেহদি হাসান?
রবীন্দ্রসদনে গাইতে এসেছেন। তার আগে শুনেছেন কলকাতায় আরেকজন ‘মেহদি হাসান’ আছেন। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে আলাপ করার খুব শখ। সংগঠকরা সে কথা জানতেন।
দর্শকাসনে মানবেন্দ্রকে বসতে দেখে তাঁরা মেহদিকে জানাতেই মঞ্চ থেকে উনি বলে উঠলেন, ‘‘মানবেন্দ্রজি, আপনি একবার উঠে দাঁড়ান। আমি একবার অন্তত আপনাকে দেখতে চাই।’’
প্রায় একই রকম ছিল লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ওঁর পরিচয়-পর্ব। কলকাতায় ‘হোপ এইট্টিসিক্স’। সারা ভারতের বহু নামী শিল্পীদের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরও এসেছেন। গ্রিনরুমে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। হাতজোড় করে প্রণাম করে নাম বলতেই, লতাজি ভ্রু তুলে চমকে উঠে বললেন, ‘‘মানবেন্দ্রজি, আপ উও গানা গায়ে থে! হাম তো কুচভি নেহি গা পায়ে।’’
কী ব্যাপার?
এর আগে সলিল চৌধুরীর সুরে অসম্ভব শক্ত তাল-লয়-সুরের দুটি গানের রেকর্ড করেন মানবেন্দ্র। যার এক পিঠে ‘যদি জানতে গো’। অন্য পিঠে ‘আমি পারিনি বুঝিতে পারিনি’। এর যখন হিন্দি ভার্সান করতে যাবেন, লতা মঙ্গেশকরের কাছে গিয়েছিলেন সলিল। গান শুনে লতাজি বলেছিলেন, ‘‘সলিলদা, এ অসম্ভব। এ কেউ গাইতে পারবে না।’’ উত্তরে সলিল চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘এ গান অলরেডি বাংলায় রেকর্ডেড। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের।’’
সেই বাংলা গান শুনে লতা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন, প্রথম আলাপে তাই ওঁর ওই কথাটাই মনে পড়ে যায়।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুর মানেই জটিল। অথচ তিনি নিজে যখন সেই একই গান গেয়ে ওঠেন মনে হয়, এর চেয়ে সহজ কাজ পৃথিবীতে আর হয় না।
এ কথা স্বীকার করতেন মান্না দেও। ‘ইন্দিরা’ ছায়াছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে গাইবেন তিনি। দুটি গানের সুর করলেন মানবেন্দ্র। ‘ঝর ঝর বৃষ্টিতে’ আর ‘আজি মলয় মন্দ বহিয়া’।
মানবেন্দ্রর যাদবপুরের নর্থ রোডের বাড়িতে এলেন মান্না দে। গানের মহলা। শুনলেন গান। এর পর যত বারই গাইতে যাচ্ছেন, তত বারই বলছেন, ‘‘মানববাবু, এ আপনার মতো হচ্ছে না।’’
প্রতি বারই আশ্বাস, ‘‘কী বলছেন মান্নাদা! এ গান আপনি অন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছেন।’’— তবু মান্না দে’র কুণ্ঠাবোধ শেষ অবধি যায়নি।
ছোট থেকে এত রকমের গানের মধ্যে দিয়ে গেছেন যে, পরে সেই ভিন্নতার রেশ পড়েছে তাঁর সুরের গড়নেও।
ঠাকুর্দা গজেন্দ্রনাথ ছিলেন অসম্ভব সঙ্গীতরসিক মানুষ। রজনীকান্ত সেনের সঙ্গে একই মেসে থাকতেন। নিজে ভক্তিগীতি, হরিনামের গান গাইতেন। রজনীকান্ত গান লিখে গজেন্দ্রনাথকে দেখাতেন।
বরিশালের উজিরপুরে ওঁদের যে দেশের বাড়ি, তার চণ্ডীমণ্ডপে গান লেগেই থাকত। রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তন, রয়ানী গান, মনসামঙ্গলের আসর…। মাঝিমাল্লারাও গান গাইত। সারিন্দা বাজিয়ে। সারিজারি ভাটিয়ালি।— ‘আর কত দিন রইব দয়াল/নেবানি আমায়’। নমঃশুদ্র মাঝিরা গাইত হরে নামসংকীর্তন।
বাবা অতুলচন্দ্র গানবাজনা না করলেও, তাঁরই উৎসাহে দুই কাকা রত্নেশ্বর আর সিদ্ধেশ্বর গানচর্চা করতেন। ওঁরাই ছিলেন ‘মুখুজ্জে পরিবার’-এ কীর্তন, ধ্রুপদী গানের বাহক। কাকাদের সঙ্গে হরির লুঠের আসরে রূপানুরাগ, মান, মাথুর গাইতে যেতেন ও-বাড়ির পল্টন (মানবেন্দ্রর ডাক নাম)।
কালীঘাটে জন্মেছেন, কিন্তু দেশের টান, তার সুর আমৃত্যু ভোলেননি। বলতেন, ‘‘একটু যখন বড় হইলাম, দ্যাশের জন্য মন ক্যামন করলেই তখনকার বরিশাল এক্সপ্রেসে চাইপ্যা খুলনা হইয়া স্টিমারে ঝালকাঠি দিয়া দ্যাশের বাড়ি যাইতাম।’’
এক দিকে এই মায়াটান, অন্য দিকে বাড়িতে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বড়ে গোলাম আলিদের আনাগোনা। জ্ঞানপ্রকাশের ডিক্সন লেনের বাড়িতে যাতায়াত, বেগম আখতার কলকাতায় এলেই হত্যে দেওয়া, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর সংস্পর্শে আসা, সেতারবাদক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুতা— সব মিলিয়ে সুরের রামধনুতে যাঁর চলাচল, তাঁর রঙের খেলা যে বহুগামী হবে এ আর বিচিত্র কী!
কাকা রত্নেশ্বরের ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু। কিশোর মানবেন্দ্রর কীর্তনে মুগ্ধ হয়ে নজরুল নিজে দু’টি গান শিখিয়ে দিয়েছিলেন— ‘সখী সাজায়ে রাখ লো পুষ্পবাসর’ আর ‘হে মাধব হে মাধব’।
সেই নজরুলকে এক সময় বাঙালি যেন ভুলতে বসল! এই বিস্মরণ ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। ঠিক করেছিলেন যেখানেই অনুষ্ঠানে যাবেন, নজরুলের গান গাইবেন।
এ দিকে সবাই তখন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ফিল্মি গান, আধুনিক গান শুনতে চায়। পরের পর অনুষ্ঠানে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়েছেন। উঠে চলেও এসেছেন। তবু ছাড়েননি নজরুলের গান!
গ্রামাফোন কোম্পানিতে রেকর্ডিং অফিসার হয়ে এলেন সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত। ডেকে পাঠালেন মানবেন্দ্রকে। নজরুলের প্রতি অবজ্ঞা তাঁকেও বিঁধছিল। ‘বেস্ট লভ সঙ্গস অব নজরুল’ এলপি করবেন তিনি। তাতে দুটি গান গাইলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়— ‘এত জল ও কাজল চোখে’ আর ‘বউ কথা কও’। এত বিক্রি হল যে কোম্পানি স্পেশাল ইপি করতে ডাকলেন। লেবেলে লেখা হল ‘নজরুল গীতি’। সেই প্রথম বার। আগে লেখা থাকত ‘সঙ্গস অব কাজী নজরুল’।
এর পর আবার ডাক। অত গান কোথায় পাবেন নজরুলের! বিস্তর গান লিখেছেন কবি, কিন্তু তার হদিশ কোথায়?
শেষ জীবনে নজরুল তখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে মানবেন্দ্র এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘‘৭১ সালে বঙ্গবন্ধু (মুজিবর রহমান) এলেন বাংলায়। সে বার ক্রিস্টোফার রোডে গাইতে গেলাম কবির জন্মদিনে। রাধাকান্ত নন্দীকে নিয়ে। সেজেগুজে বসে আছেন নীরব কবি। কী ট্র্যাজিক সেই নীরবতা! ‘কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ দিয়ে শুরু করে কত গান গেয়েছিলাম। কবির দু’চোখে জলের ধারা। কোনও কথা নেই মুখে।’’
শেষমেশ ঈশ্বরের পাঠানো দূতের মতো মানবেন্দ্রর গানজীবনে এলেন বিমান মুখোপাধ্যায়। অসংখ্য নজরুলের গানের ভাঁড়ার নিয়ে। নজরুল ভুলে যাওয়া বাঙালিকে ধাক্কা দিয়ে হুঁশে ফেরালেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের পর কোন একক সংগীতস্রষ্টার জনপ্রিয়তা এবং সর্বব্যাপীতার কথা উঠলে আসবে কাজী নজরুলের গান। পৃথিবীর সর্ব সংখ্যক গানের রচয়িতা কবি নজরুল। ৫ হাজার এর অধিক। এর মধ্যে ১৫০০-২০০০ এর মতো গান পাওয়া যায় না, নজরুল বেঁচে থাকতেই হারিয়ে গিয়েছে। যে ৩ হাজারের মতো গান পাওয়া যায় সেটা নিয়েই বলা যায় পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক গানের রচয়িতা কবি নজরুল। দ্বিতীয় স্থানে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনুমানিক ২২২৭ টি। আর নজরুলগীতির জনপ্রিয়তার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান হল শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়-এর।
কবির শিষ্য, গুণগ্রাহী ও বন্ধুরা ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টির ব্যবহার সচল রেখেছিলেন। এর পর থেকেই ষড়যন্ত্রের শুরু। কবির ‘কথার কুসুমে গাঁথা’গানটি – ‘কথা প্রণব রায় ও সুর কমল দাশগুপ্ত’ এভাবে প্রকাশিত হয়ে গেছে। নজরুলের ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’ গানটির সুরকার হিসেবে চিত্ত রায়ের নাম ছাপা হয়েছে। ধীরেন দাস থেকে শিল্পী সতীনাথ হয়ে নতুন যুগের শিল্পীরাও চিত্ত রায়ের সুর হিসেবেই এই গান গেয়েছেন। এমনি করে কবির গান অন্যের নামে হারিয়ে যেতে থাকে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত নজরুলগীতির অন্ধকার যুগ। ১৯৬৪ সালে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে নজরুলগীতি গাওয়ানো হল। কিন্তু শান্তিনিকেতনের আশ্রমবাসীরা তাঁর রাশ টেনে ধরলেন। আশ্রমকন্যাকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। তিনি ঘরে ফিরলেন। ‘কথা প্রণব রায়’ এবং ‘সুর কমল দাশগুপ্ত’ এভাবে এই গান (‘বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে’) রেকর্ড কোম্পানিতে চুক্তিবদ্ধ হল। ফিরোজা বেগম রবীন্দ্রনাথের গান ছেড়ে কমলগীতি গাইতে শুরু করলেন। বাংলা গানের দ্বিতীয় পর্যায়। গীতিকার ও সুরকার ততদিনে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্র, উৎপলা সেন, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সনৎ সিংহ, রবীন চট্টোপাধ্যায়, রবীন মজুমদার – একঝাঁক নতুন শিল্পী গণমাধ্যমে হাজির। বাংলা গানের নব ধারায় ঢেকে গেল নজরুলী আবহ।
‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’, ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে’, ‘বনে নয় মনে মোর’ ইত্যাদি গানের মাধ্যমে মানবেন্দ্র তখন বাংলা গানের শ্রোতাদের মনে তাঁর জায়গা করে নিয়েছেন। চলচ্চিত্রের কণ্ঠশিল্পীর সাথে সাথে সুরকারের খাতায়ও নাম লেখালেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বাংলা আধুনিক গানের এই ধারায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় যখন তুঙ্গে তখন তাঁর কণ্ঠে একক একটি নজরুলগীতির ডিস্ক (১৯৬৫) প্রকাশিত হল। বরিশালের উজিরপুর মুখার্জী পরিবারের উত্তরসূরী মানবেন্দ্র আর একই জেলার তবল-এ-নেওয়াজ রাধাকান্ত নন্দীর যুগলবন্দি। রাধাকান্তের আঙুলে যেন খই ফোটে। ছন্দের আড়ি, কুয়াড়ি হয়ে সমে এসে ধা বাজে পরম লগ্নে। হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের তালিমের চরম নির্যাস উভয়ে ঢেলে দিতে পেরেছেন কবির লঘুসঙ্গীতে। যেটা আধুনিক গানে সম্ভব নয়। প্রেমে পড়লেন মানবেন্দ্র। পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের পর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অনুরোধের আসরের ফাঁকে শ্রোতারা শুনতে থাকে বাণী-বীণার এই নতুন স্বাদ। সঙ্গীতমোদী মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল নজরুলের গানে। মানব ও নজরুল হয়ে গেলেন একই বৃন্তের ফুল। নজরুলগীতি হয়ে গেল ‘মানবেন্দ্রর গান’। অনুরোধ, মানবেন্দ্র-র গান শুনতে চাই। কোথাও আবার উল্টো ঘটনা – আধুনিক গান শুনব, এসব শুনব না। মানবেন্দ্র সেখানে গোঁয়াড়—শুনতেই হবে। নিজের গাওয়া বিখ্যাত আধুনিক গানের প্রলোভন দেখিয়ে নজরুলের এক ডজন গান শোনানো হয়ে গেছে। কোথাও বা তিনি বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন, কখনো শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন; কিন্তু নজরুলগীতি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। থামেননি একটুও।
মানবেন্দ্র নজরুলগীতি নব আন্দোলন শুরু করলেন। তবলায় রাধাকান্ত নন্দী। ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’, ‘এত জল ও কাজল চোখে’, ‘কেন আনো ফুলডোর’, ‘মুসাফির মোছ রে আঁখিজল ফিরে চল’, ‘ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান’ বাংলা গানকে সুরের বন্যায় ভাসিয়ে দিল। অনেকে অভিযোগ তুললেন, ‘মানব তো সুর বিকৃত করছে।’ কিন্তু, তাঁর গায়কীর চাল ধরতে গেলে যে তালিম প্রয়োজন, সেটা তো তাঁদের নেই। না ক্লাসিক্যালে, না নজরুলগীতিতে। পল্লীগীতি ও আধুনিক গানের অক্ষম গায়করা এহেন মন্তব্যে জীবনপাত করেছেন। বাঙালি সঙ্গীত সমাজে ছড়িয়ে গেল মানবেন্দ্র-র গান। এমনকি মানবেন্দ্র নিজের সুরে গাইলেন নজরুলের- ‘আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন’ গানটি। জনপ্রিয় হবার পর তিনি স্বীকার করলেন এ গানের সুর তাঁর।
নব প্রজন্মের হাতে বাংলা গানের এই শ্রেষ্ঠ ধারার আলোকবর্তিকা যে শিল্পী নিজের জীবন নিঃশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে দিয়ে গেলেন তার জন্য তিনি অমর, অক্ষয় হয়ে থাকবেন। তারপরও মূল শক্তি হল কাজী নজরুল ইসলামের বাণী ও সুরের অপূর্ব সমন্বয়—ভারতীয় সুর ও ছন্দের সার্থক প্রয়োগ। এ জন্যই সফল হয়েছেন যোগ্য নাবিক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
ইস্টবেঙ্গল বলতে মানবেন্দ্র ছিলেন অজ্ঞান। এ দিকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি পুববাংলার লোক হলেও সবাই ছিলেন মোহনবাগান সমর্থক। ফলে খেলার দিন, ইস্টবেঙ্গল জিতলেই তিনি ইলিশ কিনে সোজা চলে যেতেন শ্বশুরবাড়ি তে।
আর মোহনবাগান জিতলে, তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁর শ্যালকগণ পাল্টা হানা দিতেন তাঁর বাড়িতে। এমনও হয়েছে, বাড়ির টিভিতে খেলা চলছে। পাড়াসুদ্ধু লোক তাঁর বাড়িতে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ওয়েস্টন টিভির সামনে হামলে পড়েছে। তিনি তাঁর কন্যা শ্রীমতী মানসী মুখোপাধ্যায়ের সাথে রবীন্দ্র সরোবরের বেঞ্চে গলদঘর্ম হয়ে রেডিয়ো শুনছেন! ইস্টবেঙ্গল হারলে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁর শ্যালকের আক্রমণ শেষ হল কি না জেনে, তবেই তাঁরা বাড়ি ফিরতেন।
ময়দানেও খেলা দেখতে যেতেন তিনি। সেখানেও আবার এক কীর্তি! শচীন দেববর্মন প্রায়ই আসতেন দেখতে। মানবেন্দ্র ও তাঁর বন্ধুদের ধারণা হয়েছিল, এসডি অপয়া! তিনি গ্যালারিতে বসলেই লাল-হলুদ হারে। শচীনর্কতাকে নাকি তাই তাঁরা পিছন দিকে গ্যালারির নীচে দাঁড় করিয়ে রাখতেন! ভাবুন একবার! কর্তা নাকি হাসিমুখে তা মেনেও নিতেন। দল জিতলেই হল। শুধু গ্যালারিতে তেমন চিৎকার শুনলে জোর গলায় জানতে চাইতেন, ‘‘আরে কাগো চিৎকার ক’! আমাগো?’’
তখন খেলা শুরুর আগে সবুজ লজেন্স খাওয়ার খুব চল ছিল। মোহনবাগান জার্সির রং যে সবুজ-মেরুন, তাই। মানবেন্দ্র ও তাঁর বন্ধুরা এক-এক জন একটা একটা করে লজেন্স খেতেন, আর বলতেন, ‘‘এই মোহনবাগানরে খাইলাম!’’
তাঁর সঙ্গে থাকতে থাকতে তাঁর কন্যারও খেলার প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মানবেন্দ্র নিজে ক্রিকেটটা ভালই খেলতেন। ফুটবল-ক্রিকেট দুটো খেলা নিয়েই কন্যার সাথে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিতেন।
অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড করতেন মানবেন্দ্র! হঠাৎ একবার ঠিক করলেন যে, হোমিওপ্যাথি শিখবেন। ব্যস! মেটেরিয়া মেডিকা কিনে চলল দিনের পর দিন পড়াশোনা।
কলেজবেলায় আদর্শ ছিলেন গায়ক-অভিনেতা রবীন মজুমদার। মজা করে কবুলও করতেন, ‘‘ওঁর দেখাদেখিই সরু গোঁফ রাখতে শুরু করি। পঞ্চাশের দশকে যখন রবীন মজুমদার পড়তির দিকে, কারা যেন বলেছিল, মানব, জায়গাটা খালি হলে কিন্তু তোর একটা চান্স হবে। সেই আশাতেই সাড়ে ৭৪-এ নামলাম। সেই প্রথম, সেই শেষ।’’
সিনেমায় আর অভিনয় করেননি। কিন্তু খুব শখ ছিল মিউজিক্যাল বায়োস্কোপে। সেই জন্যই বন্ধু শ্যামল গুপ্তকে নিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘জলসাঘর’ কাহিনিটি কিনেছিলেন পাঁচশো টাকা দিয়ে। ছবি করবেন। সন্ধ্যা-বেলা প্রোডাকসন্স-এর ব্যানারে (বেলা ওঁর স্ত্রীর নাম)। সে আর কিছুতেই হয় না! হঠাৎ তারাশঙ্করের সঙ্গে কোনও এক অনুষ্ঠানে দেখা।
‘‘ছবির কী হল তোমার?’’
‘‘এখনও স্ক্রিপ্টই লেখা হয়নি। আমরা তো ও-লাইনের নই…।’’
‘‘আসলে মানিক কাহিনিটা চাইছিল। তো আমি তখন তোমাদের কথা বললাম।’’
মানিক, সত্যজিৎ রায় তখন ‘জলসাঘর’-এর জন্য ঝুঁকেছেন। এ কথা জানতে পেরে সাততাড়াতাড়ি বলে উঠেছিলেন, ‘‘না না না, এ তো অতি উত্তম কথা। আপনি ওঁকেই দিন।’’
জলসাঘর স্বপ্নই থেকে গেল।
৯২-এর জানুয়ারির ১৯-এ আচম্বিতে বাংলার জলসাঘরের ঝলমলে মানব-বাতিটা ঝুপ করে নিভে গেল।
ম্যাসিভ হার্ট এট্যাক!
তখন তিনি সবে একষট্টি!
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ই আগস্ট ২০১৫ সাল।
২- ১৩ই মে ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা শ্রীমতী মানসী মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে মার্চ ২০১৮ সাল।
৪- https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/nazrulgeeti-and-manabendra-mukhopadhyay)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত