১৮৪৩ সাল।
জোড়াসাঁকোর বাড়ির সম্মুখের অলিন্দে একটি আরাম কেদারায় বসে আছেন দেবেন্দ্র। সময় প্রায় মধ্যরাত্রি, সমস্ত গৃহটি অন্ধকার। বার্তাসে ধারালো শীতের ভাব, কিন্তু দেবেন্দ্ৰ শুধু পিরানের ওপর একটা মুগার চাদর জড়িয়ে আছেন, অন্তরের চাঞ্চল্যের জন্য তাঁর তখন শীতবোধ নেই।
দেবেন্দ্ৰ তখন ছাব্বিশ বৎসর বয়স্ক যুবা পুরুষ। সবল, দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ, আয়তচক্ষু। কিন্তু তাঁর মুখখানিতে বিষাদের ছায়া মাখা। মাথার ওপরে নক্ষত্ৰখচিত নীলাকাশ, তিনি মধ্যে মধ্যে সেদিকে চোখ তুলে দেখছিলেন। এইরূপ আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি প্রায়ই প্ৰগাঢ় প্রশান্তি বোধ করতেন, কিন্তু সেদিন মন কিছুতেই যেন স্ববশে আসছিল না।
তার একটু আগেই তিনি বেলগাছিয়ায় তাঁর পিতার বিলাসপুরী থেকে চলে এসেছিলেন। এর ফলাফল কতদূর গড়াবে তা তিনি জানতেন না। তাঁর পিতা সিংহবিক্রম পুরুষ, তাঁর অনুগতরা কেউ তাঁর ইচ্ছবিরুদ্ধ কাজ করছে, এ তিনি কিছুতেই সহ্য করেন না। কিন্তু দেবেন্দ্র আর কোনোক্রমেই থাকতে পারছিলেন না সেখানে, তাঁর অসহ্য বোধ হচ্ছিল। অতগুলি মানুষ নিছক লঘু আমোদে মত্ত। নৃত্য, গীত আর অবিরাম সুরার স্রোতে কারুর ক্লান্তি নেই। সেখানে অবস্থানের সময় একটি কথা বার বার দেবেন্দ্রর মস্তিষ্কে ঘুরছিল। কথাটি আছে ‘কঠোপনিষদে’।
‘প্ৰমাদী ও ধনমদে মূঢ় নির্বোধের নিকট পরলোক সাধনের উপায় প্ৰকাশ পায় না। ইহলোকই আছে, পরলোক নাই—যাহারা এ প্রকার মনে করে, তাহারা পুনঃ পুনঃ আমার বশে (অৰ্থাৎ মৃত্যুর বশে) আসে।’
চেষ্টা করেও দেবেন্দ্ৰ কিছুতেই কথাগুলি মন থেকে বিতাড়ন করতে পারেন নি, ক্ৰমে দামামা ধ্বনির মতন এর প্রতিটি শব্দ যেন আঘাত করেছিল তাঁকে। তিনি প্ৰায় দৌড়ে চলে এসেছিলেন সেখান থেকে।
পিতা ক্রুদ্ধ হবেন তা তিনি জানতেন। তবুও সেদিন দেবেন্দ্রর জীবনে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছিল। তিনি তখন সাবালক, তবু তাঁর পিতা তাঁকে সর্ববিষয়ে উপদেশ ও পরামর্শ দিয়ে চালিত করতে চাইতেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে বসে টাকাকড়ি গণনা করতে করতে তাঁর চিত্ত বিকল হয়ে যেত, তবু তাঁর পিতার আদেশে তাঁকে সেই কর্মই করতে হত। তাঁর পিতা চেয়েছিলেন যে সম্পদে ও ক্ষমতায় ভারতীয়দের মধ্যে তিনি নিজে শীর্ষস্থান অধিকার করবেন এবং তাঁর প্ৰিয়তম পুত্র তাঁর ছত্ৰছায়ায় থেকে এই অভিপ্ৰায় সিদ্ধির সহায়তা করবে। বস্তুতান্ত্রিক পিতা একেবারেই রাখতেন না পুত্রের মনের খবর। প্রৌঢ় দ্বারকানাথ জানতেন না, তখন তরুণ দেবেন্দ্রর মনে জেগে উঠেছিল ঐহিক সম্পদের বদলে পারিত্রিক জ্ঞানের জন্য আকুলতা। কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদন যেমন জানতে পারেন নি তাঁর তরুণ পুত্র যুবরাজ শাক্য সিংহের বৈরাগ্য অনুভূতির কথা।
জীবনের উদ্দেশ্য কী?
এই প্রশ্ন দেবেন্দ্রর মনে এসেছিল এমনই এক মধ্য রাত্রে, গঙ্গার তীরে। এ জগতে সবচেয়ে যাঁকে তিনি ভালোবাসতেন, তাঁর সেই ঠাকুরমা তখন মৃত্যুপথযাত্ৰিনী। এই ঠাকুরমা দেবেন্দ্ৰকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলেন, শুনিয়েছিলেন কত রূপকথা, কত পুরান কাহিনী, সেই ঠাকুরমাকে গঙ্গার তীরে আনা হয়েছিল অন্তর্জালী যাত্রার জন্য। শুইয়ে রাখা হয়েছিল কাঁচা ঘরে। অর্ধেক শরীর ছিল তীরের ওপরে আর পা দু-খানি জলমগ্ন। একদল কীর্তন গায়ক সেই মুমূর্ষর কানে হরিনাম শোনাতেন।
সেখান থেকে একটু দূরে একটা চাঁচের ওপর বসেছিলেন দেবেন্দ্র। তখন তাঁর বয়েস একুশ। কী এক কার্যপলক্ষে দ্বারকানাথ সে সময় ছিলেন এলাহাবাদে। দেবেন্দ্র সর্বক্ষণ ছিলেন পিতামহীর সঙ্গে। গঙ্গার স্রোতের কুলুকুলু ধ্বনি, বাতাসে ভেসে আসা কীর্তনের সুর, মাথার ওপর জোৎস্নাধৌত অনন্ত আকাশ—এইসব মিলেমিশে এক বিচিত্র অনুভূতি হয়েছিল তাঁর।
তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, জীবনের উদ্দেশ্য কী?
তিনি এ দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনীর সন্তান, তাঁর অঙ্গুলি হেলনে যে-কোনো বিলাসদ্রব্য মুহূর্তে চলে আসবে তাঁর কাছে, ভোগের পরাকাষ্ঠা তিনি দেখিয়ে যেতে পারেন। কিছুদিন সব কিছুই চোখে দেখেছেন। কিন্তু এই ভোগবিলাস ও মৃত্যু, এই কি জীবনের চরম পরিণতি? পশুর জীবনের সঙ্গে এ জীবনের পার্থক্য কী? এ জীবন আর কি কোনো বৃহত্তর মহত্তর আনন্দের স্বাদ পাবার যোগ্য নয়? শোক ও সংশয় নিয়ে বসে থাকা সেই একাকী যুবকের মনে হঠাৎ যেন একটা দিব্য আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। আকাশের জ্যোৎস্নায় যেন ধুয়ে গিয়েছিল তাঁর চিত্ত। জীবনের উদ্দেশ্য কী, সে উত্তর তিনি তখুনি পান নি। কিন্তু এই নিশ্চিন্ত উপলব্ধি হয়েছিল যে, এই ভোগমত্ততাই জীবনের সব নয়। ঐশ্বর্য, আড়ম্বর, অপরের ওপর প্রভুত্ব করার দাপট, এসব অতি তুচ্ছ। তাঁর মনে হয়েছিল, সামান্য যে চাঁচের ওপর তিনি বসেছিলেন সেটাই যেন তাঁর যোগ্য স্থান, গালিচা দুলিচা সব হেয় বোধ হয়েছিল।
শেষ রাত্রে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন, কিন্তু ঘুম হয় নি। সারা শরীরের প্রবাহিত আনন্দে তিনি ছটফট করেছিলেন।
পরদিন সকালে আবার তিনি পিতামহীকে দেখতে এসেছিলেন শ্মশানঘাটে। বৃদ্ধার সেদিন শেষ সময় উপস্থিত হয়েছিল। সকলে ধরাধরি করে তাঁকে গঙ্গাগর্ভে নামিয়ে চিৎকার করছিল, ‘গঙ্গা নারায়ণ ব্ৰহ্ম।।’ দেবেন্দ্ৰ জলে নেমে বৃদ্ধার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর চোখে অশ্রু ছিল না। তখন দ্বারকানাথের পালিকা-জননী, পুণ্যশীলা অলকাদেবী তাঁর প্রিয়তম নাতির দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটি হাত নিজের বুকে রেখেছিলেন, অন্য হাতের একটি আঙুল উঁচু করে ওপরের দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে হারিবোল বলে ইহলোক ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রর মনে হয়েছিল, যেন ঠাকুরমা ঈশ্বর ও পরকালের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন তাঁকে।
ঠাকুরমার শ্রাদ্ধের পর কল্পতরু সেজেছিলেন দেবেন্দ্র। যে যা চায়, সবই তিনি বিলিয়ে দেবেন, এই ছিল তাঁর ইচ্ছা। সংক্ষিপ্ত বিলাসের আমলে যত সাজ-সজ্জা অলঙ্কার তিনি প্ৰিয়বোধে সংগ্রহ করেছিলেন, সে সব কিছু থেকে আবার মুক্ত হতে চেয়েছিলেন। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা সামান্য সুখ নিয়ে মত্ত, তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। এক একজন এক একটি দ্রব্য হাতে তুলে বলেছিল, ‘নেবো?’ তিনিও তৎক্ষণাৎ মাথা হেলিয়ে বলেছিলেন, ‘নাও’। এক একজনের দু-হাতেও জিনিস ধরছিল না। তাঁর একজন জ্যাঠতুতো ভাই নিয়েছিল তাঁর জড়ির পোষাক, দেয়াল থেকে খুলে নিয়েছিল মূল্যবান সব ছবি, তবুও তাঁর লোভ যায় নি। শ্বেত মর্মরের টেবিল, আবলুষ কাষ্ঠের কোচ এগুলোর দিকে চেয়েও সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘নেবো?’ দেবেন্দ্ৰ ক্ষণমাত্র দ্বিধা না করে বলেছিলেন, ‘নাও!’ সে তখন মুটে ডেকে সব নিয়ে গিয়েছিল।
শ্মশানে যে তীব্র আনন্দ হয়েছিল, তা বেশীদিন স্থায়ী হয় নি। আবার এক দুঃখবোধ তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। তিনি ‘নেতি’ পেয়েছিলেন, কিন্তু ‘অস্তি’ পাননি। কিসে সুখ নেই, তা বুঝেছিলেন, কিন্তু যাতে চিরসুখ ও চিরশান্তি তা অবলম্বন করতে পারছিলেন না। ঈশ্বর অনন্ত সুখের আকার, কিন্তু ঈশ্বর কে? তিনি কোথায়? কী তাঁর স্বরূপ?
প্রথম বয়েসে উপনয়নের পর তিনি মন দিয়ে শালগ্রাম শিলার পূজা দেখতেন। তখন তাঁর বোধ হতো ঐ শিলাই ঈশ্বর। দুর্গাপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, সরস্বতী পূজায় তিনি আর পাঁচজনের মতই মেতে উঠতেন। প্রতিদিন কলেজ যাবার পথে ভক্তিভরে প্রণাম করতেন, ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী দেবীকে, অপরাপর বালকদের মতন তিনিও পরীক্ষার আগে দুরুদুরু বক্ষে দেবীর কাছে পাশ করার বর প্রার্থনা করতেন। তখন জানতেন যে শালগ্রাম শিলার মতনই দশভূজা দুর্গা বা চতুর্ভূজা সিদ্ধেশ্বরী—সবই ঈশ্বরের প্রকাশ।
এখন বুঝতে পারছিলেন, এই সব কাষ্ঠ লোষ্ট্র দিয়ে গড়া মূর্তি কখনো ঈশ্বর হতে পারে না। কিন্তু ঈশ্বরের স্বরূপ কী? তখন নব্য বঙ্গীয় যুবকরা এই কাষ্ঠ লোষ্ট্র পূজায় তিতিবিরক্ত হয়ে অনেকেই নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকেছিল, আবার অনেকে খৃষ্টীয় ধর্ম বরণ করে নিচ্ছিল। দেশের ভালো ভালো মেধা চলে যাচ্ছিল খৃষ্টীয় ধর্মের দিকে। কিন্তু দেবেন্দ্র চাইছিলেন নিজেই নিজের ঈশ্বরকে খুঁজে বার করতে।
এই অনুসন্ধানের যাতনা যে কী তীব্র, তা আর অন্য কে বুঝবে? বিষয় কর্মে একেবারেই মন টেকে না। মানুষের সংসৰ্গও ভালো লাগে না। এক একদিন অফিস ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতেন, নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে চলে যেতেন শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। সেই স্থান ছিল অতি নির্জন। কিড সাহেবের স্মৃতিস্তম্ভের ওপর একাকী বসে থেকে তিনি মনের বিষাদ অপনয়নের চেষ্টা করতেন। কিছুতে যেত না সে বিষাদ। রোদ্দুরের রঙ-ও তাঁর ঘোর কালো বলে বোধ হত।
তীব্ৰ অনুসন্ধিৎসায় তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের দর্শন গ্রন্থগুলি মন্থন করতে শুরু করলেন। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে তখন হিউম ও লকের দর্শনের খুব প্ৰতপত্তি। এঁরা ছিলেন জড়বাদ ও সংশয়বাদের প্রবক্তা। আমাতেই আমি-র শেষ। আগুনের যে পোড়াবার ক্ষমতা আছে তা চিরসত্য কে বলেছে? আমি ইন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে অগ্নিকে প্রত্যক্ষ করি, তার দাহিকা শক্তি আমি অনুভব করি, কিন্তু যেখানে আমি নেই, সেখানেও অগ্নির দাহিকা শক্তির কথা আমি স্বীকার করবো কী করে? মানুষের মন একটা শূন্য পাতা, সেখানে শুধু অভিজ্ঞতার আচড় পড়ে। সমস্ত জ্ঞানই আমাদের অভিজ্ঞতা, এ ছাড়া আর কোনো জ্ঞান নেই। এই জড়বাদ দেবেন্দ্ৰকে তৃপ্তি দিত না।
প্রকৃতিবাদীরা আবার অন্য কথা বলত। তারা বলত প্রকৃতির অধীনতাই মানুষের সর্বস্ব। এ তত্ত্বে শিউরে উঠেছিলেন দেবেন্দ্র। প্রকৃতির অধীনতাই মানুষের সর্বস্ব? এই পিশাচীর পরাক্রম দুনিবার।–এই পিশাচী প্রকৃতির হাতে তো কারুর নিস্তার নেই। এর কাছে নতশিরে বসে থাকাই যদি চরম কথা হয়, তাহলে আর আশা কৈ ভরসা কৈ?
সংস্কৃত শাস্ত্ৰসমূহ অধ্যয়ন করেও তিনি তৃপ্ত হতেন না। মাঝে মাঝে একটু একটু যেন আলোক দেখতে পেতেন, আবার তা হারিয়ে যেত! মনের বিষাদ আর কিছুতেই দূর হচ্ছিল না। তারপর একদিন অকস্মাৎ এলো সেই উন্মোচনের মুহূর্তটি।
একদিন তিনি উপর মহলের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছিলেন, এমন সময় দোতলার বারান্দায় দেখলেন কোনো একটি বইয়ের ছিন্ন পৃষ্ঠা উড়ছে। কৌতূহলী হয়ে তিনি কাগজটি তুলে নিয়েছিলেন। তাতে কিছু সংস্কৃত শ্লোক লেখা ছিল। দেবেন্দ্ৰ মোটামুটি সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করেছিলেন, কিন্তু সেই শ্লোকের অর্থ বুঝতে পারলেন না।
সংস্কৃত চর্চার জন্য তিনি একজন গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন। সেই শ্যামাচরণ পণ্ডিতকে ডেকে তিনি বললেন, দেখুন তো, এই পৃষ্ঠাটি কোথা থেকেই বা এলো এবং এতে যা মুদ্রিত রয়েছে, তার অর্থই বা কী?
পণ্ডিত ভ্ৰ কুঞ্চিত করে রইলেন। এই শ্লোক তাঁর কাছেও অপরিচিত, সঠিক অর্থ তাঁর কাছেও পরিষ্কার হচ্ছিল না।
দেবেন্দ্র তখন বেশী দেরি করতে পারছিলেন না। তখন সকাল দশটা বেজে গেছে, তখন তাঁর ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে যাবার কথা। তিনি না গেলে ক্যাশ খোলা হবে না। পণ্ডিতকে বলেছিলেন, আপনি এর অর্থ করে রাখুন, আমি বৈকালে এসে দেখবোখন।
অফিসে গিয়েও তিনি সর্বক্ষণ ছটফট করছিলেন। নিদারুণ ঔৎসুক্যে তাঁর মর্মপীড়া শুরু হয়েছিল। কোথা থেকে এলো ঐ কাগজটা, কী ওতে লেখা আছে? দ্বিপ্রহরের পর আর থাকতে পারলেন না তিনি। অন্য একজনকে ক্যাশ বুঝিয়ে দিয়ে তিনি দ্রুত গৃহে ফিরে এসেছিলেন।
ফিরে দেখেছিলেন শ্যামাচরণ পণ্ডিতের মুখখানি তখনও মলিন। তিনি তখনও শ্লোকের অর্থ উদ্ধার করতে পারেননি। খানিক ইতস্তত করে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি বরং রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশকে ডাকাইয়া লউন। আমার মনে হয় এসব ব্ৰহ্মসভার কথা!’
ব্ৰহ্মসভার নাম শুনেই দেবেন্দ্রর বুক ধড়াস করে উঠেছিল। সেই ব্ৰহ্মসভা এখনো আছে? কে চালায়? রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ? হাঁ তাও তো বটে, রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ তাঁরই পিতার বেতনভুক। তৎক্ষণাৎ তিনি বিদ্যাবাগীশকে ডাকতে পাঠিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন।
রামমোহন ব্ৰহ্মসভার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একেশ্বরবাদীদের উপাসনার জন্য। হিন্দু, ইহুদী, খৃষ্টান, মুসলমান সকলেই এতে যোগ দিতে পারবে। বিদ্যাবাগীশ তার আগে থেকেই রামমোহনের সঙ্গে ছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল এই সভার পক্ষ থেকে বেদান্ত প্ৰতিপাদ্য ধর্ম প্রচার করা হোক। কিন্তু রামমোহন রাজি হননি। নতুন ধর্মের প্রয়োজন নেই, সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেই যারা নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বরের উপাসক, তাদের মিলনই চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর উপস্থিতিতে সেখানে সব ধর্মের লোকেরাই আসতো। সন্ধ্যেবেলা ফিরিঙ্গি ও মুসলমান বালকেরা ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় স্তব গান করে যেত। বিষ্ণু ও কৃষ্ণ নামে দুই গায়ক ধরতেন গান, তাঁদের সঙ্গে পাখোয়াজ সঙ্গত করতেন গোলাম আব্বাস। বালক দেবেন্দ্র রামমোহনের পাশে বসে শুনতেন।
ব্ৰহ্মসভার জন্য আলাদা গৃহ নির্মাণ করেছিলেন রামমোহন। কিন্তু বছর দু-এক এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার পর তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন ইংল্যান্ড। আর ফেরেন নি।
রামমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র রাধাপ্রসাদ ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু, পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী, পিতার এই ধৰ্মসভাকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে তিনি আগ্ৰহী হলেন না। এই সভা বন্ধই হয়ে যেত, কিন্তু এগিয়ে এসেছিলেন দ্বারকানাথ। তখন সারা দেশ রামমোহনের বিপক্ষে, ব্ৰহ্মসভা স্থাপনের পর থেকেই হিন্দু ধর্ম যায় যায় রব উঠেছিল, গোঁড়ার দল পালটা সভা স্থাপন করেছিল। সুতরাং বিবাদ এড়াবার জন্য দ্বারকানাথ রামমোহনের মতে পুরো মত মেলাননি। তবে বন্ধুর একটি বাসনা বা বাতিককে সম্মান প্ৰদৰ্শন করতে চেয়ে তিনি বলেছিলেন যে, ব্ৰহ্মসভা যদি চলে তো চলুক, তিনি এর ব্যয়ভার বহন করবেন।
দেবেন্দ্রনাথের মনে পড়েছিল একটি দিনের কথা। বালক বয়েসে তিনি মাণিকতলায় রামমোহন রায়ের গৃহে প্রায়ই যেতেন। একবার তিনি গিয়েছিলেন রাজাকে দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রণ করতে। দেবেন্দ্র যেই বললেন, রামমণি ঠাকুরের বাড়িতে আপনার দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রণ, অমনি চমকে উঠেছিলেন রাজা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে পূজায় নিমন্ত্রণ?’ তিনি পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ করছেন, তবু লোকে তাঁকে পূজায় ডাকে? রামমোহন তাঁর বন্ধুপুত্র দেবেন্দ্রকে সম্বোধন করতেন ‘বেরাদার’ বলে। তিনি বলেছিলেন, ‘বেরাদর, আমাকে নয়, আমার পুত্র রাধাপ্ৰসাদকে নিমন্ত্রণ করো গে।’
‘আমাকে পূজায় নিমন্ত্রণ?’ সেই বিস্মিত স্বর যেন দেবেন্দ্রের কানে আবার ভেসে উঠেছিল, অথচ অনেকদিন ভুলে ছিলেন মাঝখানে। আর একটা কথাও মনে পড়েছিল তাঁর। বিলাত যাত্রার কিছুক্ষণ আগে রামমোহন এসেছিলেন দ্বারকানাথের কাছে বিদায় নিতে। খানিক কথাবার্তার পর তিনি বলেছিলেন, ‘দেবেন্দ্ৰ কোথায়? দেবেন্দ্ৰকে ডাকো। তাঁর কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে আমি যাবো না।’
কিশোর দেবেন্দ্ৰ এলে রাজা সাগ্রহে তাঁর হাত চেপে ধরেছিলেন। সেই ব্যবহারের কোনো গুঢ় অর্থ ছিল কি? রাজা কি বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘বেরাদর দেবেন্দ্ৰ, আমি তোমার পিতাকে জানি। তিনি বৈষয়িক লোক। কিন্তু আমার কার্যভার তুমি লাও!’
অথচ প্রমোদে প্রমাদে সে কথা ভুলে ছিলেন দেবেন্দ্ৰ। প্রবাসে রাজার মৃত্যুর পর দু-একবার মাত্র ব্ৰহ্মসভায় গিয়েছিলেন তিনি। নিছক কৌতূহল বশে। দেখেছিলেন সেখানে তখন দারুণ দৈন্য দশা। প্রবল জেদে রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ একাই সেখানকার দীপ জ্বেলে রেখেছিলেন। আর একজন দ্রাবিড় ব্ৰাহ্মণ সেখানে উপনিষদ পাঠ করতেন। কোনো কোনো দিন তিনি না এলে রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ ছিলেন নিজেই একমাত্র উপাসক, নিজেই উপাচার্য এবং নিজেই শ্রোতা। বৃষ্টি বাদলার দিন কিছু লোক এমনিই হঠাৎ ঢুকে পড়ত সেখানে। তাঁদের কারুর হাতে বুজার ভর্তি ধামা, কারুর হাতে টিয়াপাখি। উৎসাহিত হয়ে রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ উপদেশ শুরু করে দিতেন, শ্রোতারা গোল গোল চক্ষু করে শুনতেন এবং বৃষ্টি থামা মাত্র হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে চলে যেতেন।
এসব দেখে কৌতুক বোধ করেছিলেন দেবেন্দ্র। আর যাননি। মধ্যে কয়েক বৎসর তিনি ব্ৰহ্মসভার কথা একেবারেই বিস্মৃত হয়ে ছিলেন।
ডাক পেয়ে রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়িতে এসে দেবেন্দ্রর সামনে আসন গ্ৰহণ করলেন। যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনের পর দেবেন্দ্র তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘মহাশয়, এই ছিন্ন পৃষ্ঠাটি কোন গ্রন্থের? এই শ্লোকের অর্থ আপনি আমার নিকট ব্যাখ্যা করতে পারেন কি?’
বিদ্যাবাগীশ পৃষ্ঠাটি পরীক্ষা করে বললেন, ‘ইহা তো ঈশোপনিষদের শ্লোক। ব্ৰহ্মসমাজ সংকলিত গ্ৰন্থ হইতে ছিন্ন হইয়াছে। এ কাগজ এ স্থলে আসিল কী প্রকারে?’
দেবেন্দ্র বললেন, ‘তাহা আমি জানি না। আপনি শ্লোকের অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দিন। বিদ্যাবাগীশ শ্লোকটি উচ্চারণ করলেন।’
“ঈশাবাস্যমিদং সৰ্ব্বং যৎকিঞ্চি জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জ থাঃ মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনং।।”
তারপর প্রথমে বললেন, ‘আক্ষরিক অর্থ, ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত জগৎকে আচ্ছাদন করে। তিনি যাহা দান করেছেন, তাহাই উপভোগ করে।’
এবার শুরু করলেন ব্যাখ্যা, ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ-তিনি যাহা দান করিয়াছেন, তাহাই উপভোগ করো।–তিনি কী দান করিয়াছেন? তিনি আপনাকেই দান করিয়াছেন। সেই পরম ধনকে উপভোগ করো। আর সকল ত্যাগ করিয়া সেই পরম ধনকে উপভোগ করো।…’
দেবেন্দ্ৰ যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি ঈশ্বরের স্বরূপ খুঁজছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, ঈশ্বরকে কোথায় পাবেন? এখন শুনলেন ঈশ্বরের দ্বারাই সমুদয় জগতকে আচ্ছাদন করে। তিনি আপনাকেই দান করেছেন—এর থেকে বেশী মানুষ আর কী চাইতে পারে?
এই উড়ন্ত কাগজ যেন এক দৈববাণী বহন করে আনলো তাঁর কাছে। অভিভূতের মতন উঠে গিয়ে তিনি বিদ্যাবাগীশকে প্ৰণাম করলেন।
রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশও ব্যাকুল হয়ে খুঁজছিলেন একজন মন্ত্রশিষ্যকে। দেবেন্দ্রর মধ্যে তিনি তাকে পেয়ে গেলেন। এক প্রচারকের সঙ্গে মিলন হলো এক মুমুক্ষুর।
তাঁর এই নবলব্ধ জ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের জন্য দেবেন্দ্র কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’ (১৮৩৯ সাল)। দ্বিতীয় বৎসর সেই সভার নাম বদলে হলো ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’। বাড়ির একতলার একটি অন্ধকার ঘরে বসে এর অধিবেশন বসত, রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ নিয়মিত সেখানে এসে বেদান্ত প্রতিপাদ্য ধর্ম বিষয়ে নানান উপদেশ দিতেন। দেবেন্দ্ৰ ভেবেছিলেন এ কাজ চলবে তাঁর পিতার অজ্ঞাতসারে। কিন্তু তীক্ষ্ণধী দ্বারকানাথের কাছে কিছুই গোপন থাকত না। একদিন তিনি বেদান্তবাগীশকে ডেকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘একেই তো দেবেন্দ্রর বিষয়বুদ্ধি অল্প, তার ওপর তার মাথায় ব্ৰহ্ম ব্ৰহ্ম ঢুকিয়ে যে তার সর্বনাশ কচ্চো।’
দেবেন্দ্র কিন্তু পিতার এই ভ্রূকুটি মান্য করলেন না।
তত্ত্ববোধিনী সভার তরফ থেকে প্রকাশিত হলো পত্রিকা (১৮৪৩ সাল), স্থাপিত হলো বিদ্যালয়। বাণিজ্য-রাজ দ্বারকানাথের পুত্র হয়ে তিনি মেতে রইলেন নিছক যত অ-বাণিজ্যিক কাজে। এমন কি একবার তত্ত্ববোধিনী সভার সাম্বাৎসরিক উৎসবে কলকাতায় তাঁদের পরিবারের যতগুলি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অফিস আছে তার সমস্ত কর্মচারীদের নামে তিনি আলাদা করে নিমন্ত্রণ পত্ৰ পাঠিয়েছিলেন। তত্ত্ববোধিনী সভা ততদিন পর্যন্ত ছিল অনেকটা গুপ্ত ধরনের ব্যাপার, মাত্র একশত দেড়শত লোকের জ্ঞাত ছিল এ খবর। কর্মচারীরা এ সভার নামই শোনেনি, এমন কি নাম শুনেও অর্থ বুঝতে পারে নি। অবশ্য মালিকপুত্রের নিমন্ত্রণই আদেশের সমান, সুতরাং এসে উপস্থিত হয়েছিল সকলেই।
শঙ্খ, ঘণ্টা ও শিঙা বাজিয়ে রাত্রি আটটায় দরজা খোলা হয়েছিল সভাকক্ষের। লাল রঙের বনাত গায় দিয়ে দশ জন দশ জন করে দুই সারিতে বিশ জন দ্রাবিড় ব্ৰাহ্মণ সমস্বরে করেছিলেন বেদপাঠ। তারপর দেবেন্দ্ৰ পুতুল পূজার পরিবর্তে নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বরের তত্ত্ব ব্যাখ্যান করেছিলেন। এরপর আরও বক্তৃতা চলেছিল। একের পর এক। রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ একাই লাগিয়ে দিয়েছিলেন দু’ঘণ্টা। রাত দু’টোর পর কর্মচারীরা বিমূঢ় বিহ্বল অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিল। এ সব কী কাণ্ড হয়েছে ওখানে, কিছুই তাঁদের মাথায় ঢোকে নি। কিন্তু তাতেও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল দেবেন্দ্রর। তিনি তত্ত্ববোধিনী সভাকে প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
কিছুদিনের মধ্যেই দেবেন্দ্ৰ বুঝেছিলেন, তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্মসমাজকে আলাদা করে রেখে লাভ নেই। দুই সভারই উদ্দেশ্য যখন এক, তখন একসঙ্গে মিলে যাওয়াই ভালো। তত্ত্ববোধিনী সভার মাসিক উপাসনা হতে লাগলো ব্ৰহ্মসভার উপাসনার সঙ্গে মিলিয়ে।
এই পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন্দ্র একটু থমকে ছিলেন। রামমোহনের ব্ৰহ্মসভার সঙ্গে প্রকাশ্যে একাত্মতা স্থাপনের ফলে বহু রকমের প্রতিকূলতা দেখা দেবার সম্ভাবনা ছিল, শুধু হিন্দুসমাজের কাছ থেকেই নয়, নিজেদের পরিবার থেকেও। স্বয়ং পিতা কী বলবেন ঠিক নেই। দ্বারকানাথ তাঁর পুত্ৰকে মুখে রূঢ় বাক্য বলতেন না, কিন্তু সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি অবিচল ছিলেন।
কিন্তু দেবেন্দ্র তখনও অস্থির হয়ে ছিলেন। তাঁর নির্মল চিত্তে কোনোরূপ ছলনার স্থান ছিল না। বহুকালাবধি প্রচলিত ধর্মীয় আচার, সংস্কার ও পূজা পার্বণ সম্পর্কে তাঁর মন বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। একথা সকলকে না জানানো পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি হচ্ছিল না। যে সত্যের সন্ধান তিনি পেয়েছেন, সেই সত্যের স্বাদ তিনি দিতে চাইছিলেন অন্যকে। এই সত্য সাধনা যেন পৃথক এক ধর্ম, এর প্রচার প্রয়োজন ছিল। এবং তারও আগে প্রয়োজন ছিল এক ধর্মীয় দল স্থাপনের। দেশের মানুষকে খৃষ্টানী থেকে দূরে সরিয়ে আনার জন্য এই নব ধর্মের প্রচার ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
এ ব্যাপারেই দ্বিধায় দুলছিলেন তিনি। বেলগাছিয়া ভিলা থেকে অকস্মাৎ চলে এসেছিলেন বারান্দায়। সেখানে একলা বসে থেকে তাঁর বারংবার মনে হয়েছিল, বৃথা সময় চলে যাচ্ছে। তাঁর পিতার বাহ্য আড়ম্বর ও জাঁকজমকের বিরুদ্ধে তাঁর একটা প্ৰতিবাদ রাখা দরকার। জীবনের উদ্দেশ্য নয় পার্থিব জগতে সবার উর্দ্ধে ওঠা, জীবনের উদ্দেশ্য সত্যের প্রতিষ্ঠা।
জোৎস্নাময় আকাশের দিকে চেয়ে তিনি প্রেরণা চাইলেন, তাঁর মনে বল এলো, তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ মনে মনে একটি শপথ নিয়ে নিলেন।
৭ই পৌষ (ইংরেজি ১৮৪৮ সাল) দেবেন্দ্র তাঁর কুড়িজন বন্ধুর সঙ্গে এক নতুন ধর্মে দীক্ষা নিলেন। ব্ৰাহ্মসমাজের যে নিভৃত কুঠুরীতে বেদ পাঠ হতো, সেই কুঠুরী ঢেকে ফেলা হয়েছিল পদ দিয়ে, মধ্যে একটি বেদী, তার ওপরে বসেছিলেন বৃদ্ধ রামচন্দ্ৰ বিদ্যাবাগীশ। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, দুপুর তিনটের সময় দেবেন্দ্র অফিস ছেড়ে চলে এসেছিলেন। বিদ্যাবাগীশকে তিনি বলেছিলেন, ‘হে আচার্য, বিশুদ্ধ ব্ৰাহ্ম ধর্মব্রত গ্রহণ করিবার জন্য আমরা সকলে আপনার নিকট উপনীত হইয়াছি।…যাহাতে আমরা অদ্বিতীয় পরম ব্ৰহ্মের উপাসনা করিতে পারি, যাহাতে সৎকর্মে আমাদের প্রবৃত্তি হয় এবং পাপ মোহে মুগ্ধ না হই, এরূপ উপদেশ দিয়া আমাদের সকলকে মুক্তির পথে উন্মুখ করুন।’
বিদ্যাবাগীশের চক্ষে অশ্রু এসে গিয়েছিল। বহুদিন পর তাঁর স্বপ্ন সফল হতে চলেছিল।
বয়েস অনুসারে প্রথমে শ্ৰীধর ভট্টাচার্য, পরে শ্যামাচরণ ভট্টাচার্য এগিয়ে গিয়ে বেদীর সামনে প্রতিজ্ঞা পাঠ করে ব্ৰাহ্মধর্ম গ্ৰহণ করেছিলেন। তৃতীয় ব্ৰাহ্ম হয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। তারপর তাঁর ভাই গিরীন্দ্রনাথ এবং অক্ষয়কুমার দত্ত ও অন্যান্যরা। দীক্ষান্তে নবীন ব্ৰাহ্মীরা প্রত্যেকে পরস্পরকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এক সামাজিক বিপ্লব ঘটতে চলেছে যে, সেই সচেতনতা থেকে তাঁদের শরীর রোমাঞ্চিত হতে শুরু করেছিল।
দেবেন্দ্র সকলকে বলেছিলেন, ‘পূর্বে ব্ৰাহ্মসমাজ ছিল। এখন ব্ৰাহ্মধর্ম হইল। ব্ৰহ্ম ব্যতীত ধর্ম থাকিতে পারে না এবং ধর্ম ব্যতীতও ব্ৰহ্ম লাভ হয় না।’
এইভাবে রামমোহনের আদর্শ থেকে কিছু বিচ্যুত হয়ে বিদ্যাবাগীশ ও দেবেন্দ্ৰ সূচনা করেছিলেন এক পৃথক ধর্মের। রামমোহন চেয়েছিলেন সর্বধর্মের মধ্য থেকে সংস্কারমুক্ত একেশ্বরবাদী মানুষগুলিকে এক জায়গায় এনে জড়ো করতে, সেইজন্যই তিনি পৃথক নাম দিয়ে কোনো ধর্ম প্রচার করতে চাননি। আর দেবেন্দ্ৰ স্থাপন করেছিলেন, শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দু ভদ্র সমাজের জন্য এক বিদ্রোহী ধর্মের। অবশ্য রামমোহনের মতটি ছিল একটি তত্ত্ব মাত্র, আর দেবেন্দ্রর অধ্যক্ষতায় নবপ্রতিষ্ঠিত ধর্মটি বাস্তব পথ নিয়েছিল অচিরেই।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৫ই মে ,১৮১৭ – ১৯শে জানুয়ারি, ১৯০৫) ছিলেন একজন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক ও দার্শনিক। ১৮১৭ সালের ১৫ই মে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং মাতা দিগম্বরী দেবী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র।
১৮২৭ সালে তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুর-এর প্রতিষ্ঠিত এ্যাংলো-হিন্দু স্কুলে ভর্তি হন। সম্ভবতঃ এই স্কুলে তিনি ১৮৩০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এই স্কুলে পড়ার সময়– স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের নিয়ে ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা’ নামে একটি সভা স্থাপিত হয়েছিল। তিনি এই সভার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য এই সভাতে নির্ধারিত হয়েছিল যে,– সভার সদস্যগণ কেউই বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলবেন না।
উল্লেখ্য, ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় একেশ্বরের উপাসনার জন্য ‘আত্মীয়সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে বিলেতে রাজা রামমোহন ২৭ সেপ্টেম্বরে মেনিনজাইটিস রোগে মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় দ্বারকানাথের অর্থানুকূল্যে এই ‘আত্মীয় সভা’র কার্যক্রম চলছিল। তখনো ব্রাহ্মধর্মের আদর্শ তাঁকে অনুপ্রাণিত করে নি। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই স্কুল ছেড়ে দ্বারকানাথের প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের কোষাধ্যক্ষ রমানাথ ঠাকুরের অধীনে শিক্ষানবীশ হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় নানা প্রকার আমোদ-প্রমোদের মধ্যেই তাঁর সময় অতিবাহিত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর অভিভাবকরা তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা করেন। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে যশোহরের রামনারায়ণ চৌধুরীর কন্যা সারদাসুন্দরী দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে এঁর পিতামহী অলকাদেবীর মৃত্যুর পর এঁর জীবনধারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই সময় তিনি ভারতীয় ও ইউরোপীয় ধর্ম ও দর্শনপাঠে আত্মনিয়োগ করেন। এরপর তিনি সকল ধর্মীয় গ্রন্থের মধ্য থেকে উপনিষদকে উপযুক্ত গ্রন্থ হিসাবে নির্বাচন করেন। মূলতঃ উপনিষদের চর্চা ও এর বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে, তিনি ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই অক্টোবর (২১ই আশ্বিন ১২৪৬ বঙ্গাব্দ) তারিখে জোড়সাঁকোর-বাড়ির একটি ছোটো ঘরে দশজন আত্মীয় ও বন্ধু নিয়ে ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’ স্থাপন করেন। এই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ সভার আচার্য পদ গ্রহণ করলে– আচার্য এই নাম পরিবর্তন করে রাখেন– ‘তত্ত্ববোধিনী’।
১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখে তাঁর ভাই ভূপেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। এর দুই দিন পরে ২১ জানুয়ারিতে তাঁর মা দিগম্বরী দেবী মৃত্যবরণ করেন। এই দুটি মৃত্যুর পর দ্বারকানাথ নিজের অকস্মাৎ মৃত্যু হতে পারে বিবেচনা করে, ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ আগষ্টে তিনি তাঁর সন্তান ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ট্রাস্ট করে দেন। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’ স্থাপন করেন। এই স্কুলটি সেখানে জনসমাদর লাভ না করায়, স্কুলটি বাঁশবেড়িয়া নামক গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য, তিনি ১৮৪২ সালে (বৈশাখ ১৭৬৪ শকাব্দ) তত্ত্ববোধনী সভা’র পরিচালনাভার গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজের বক্তব্য প্রচারের জন্য ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ডিসেম্বর ‘তত্ত্ববোধিনী’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এরপর তিনি তাঁর ২১ জন আত্মীয়-সহ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর অবশিষ্ট আত্মীয়রা এই সময় তাঁকে পরিত্যাগ করেন।
১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই মার্চ-এ দ্বারকানাথ দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড যান এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ১ আগষ্ট তারিখে লণ্ডনের সারেতে মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর, তাঁর বহু ঋণ দেবেন্দ্রনাথের কাঁধে এসে পড়ে। এই সময় বাড়িতে অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গ প্রতিমা পূজা চালু রেখেছিলেন। সে কারণে দুর্গাপূজা’র সময় তিনি দেশ ভ্রমণে বের হতেন। উল্লেখ্য সে সময় তাঁর সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন তাঁর অপর ভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ভাই গিরীন্দ্রনাথের মত্যু হলে, তিনি তাঁর সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে একত্ববাদ প্রচারের জন্য তিনি কেশবচন্দ্র সেন ‘গুডউইল ফ্যাটার্নিটি’ নামে ছাত্রদের একটি একত্ববাদী ধর্ম সভার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের একটি সভায় তাঁর সাথে প্রথম দেবেন্দ্রনাথের প্রথম দেখা হয়। দেবেন্দ্রনাথের প্রচারিত ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, এই বৎসরে কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন।
১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর কিছুদিন পর ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম কেশবচন্দ্রের হাতে ন্যাস্ত করেন। পরে ধর্মীয় আদর্শের কারণে কেশবচন্দ্রের সাথে সংঘাত উপস্থিত হলে – ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হয়ে যায়। কেশবচন্দ্রের অনুগামী সমাজের নামকরণ হয় ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’, পক্ষান্তরে দেবেন্দ্রনাথের অনুগামী ধর্মের নাম হয়– ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’। এরপর ধীরে ধীরে তিনি সকল বৈষয়িক ও ধর্মীয় সংঘাত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে জানুয়ারি (৬ই মাঘ ১৩১১ বঙ্গাব্দ) তারিখে ৮৮ বৎসর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। এঁর সন্তানের সংখ্যা ছিল ১৫টি। নিচে এর তালিকা দেওয়া হলো –
১) কন্যা। শৈশবেই মারা যায়।
২) দ্বিজেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৯ ফাল্গুন, ১২৪৬। মৃত্যু : ৪ মাঘ ১৩৩২। জীবনকাল : ৮৬ বৎসর।
৩) সত্যেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১২৪৯। মৃত্যু : ২৪ পৌষ ১৩২৯। জীবনকাল : ৮১ বৎসর।
৪) হেমেন্দ্রনাথ। জন্ম : ০৮ মাঘ, ১২৫০। মৃত্যু : ২১ জ্যৈষ্ঠ ১২৯১। জীবনকাল : ৮০ বৎসর।
৫) বীরেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৭ কার্তিক, ১২৫২। মৃত্যু : ১৩২২। জীবনকাল : ৭০ বৎসর।
৬) সৌদামিনী। জন্ম : ১২৫৪। মৃত্যু : ৩০ শ্রাবণ ১৩২৭। জীবনকাল : ৭৩ বৎসর।
৭) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। জন্ম : ২২ বৈশাখ, ১২৫৬। মৃত্যু : ফাল্গুন ১৩৩১। জীবনকাল : ৭৬ বৎসর।
৮) সুকুমারী। জন্ম : ১২৫৭। মৃত্যু : জ্যৈষ্ঠ ১২৭১। জীবনকাল : ১৪ বৎসর।
৯) পুণ্যেন্দ্রনাথ। জন্ম : ১২৫৮। মৃত্যু : ১২৬৪। জীবনকাল : ৬ বৎসর।
১০) শরৎকুমারী। জন্ম : ১২৬১। মৃত্যু : ১০ আষাঢ় ১৩২৭। জীবনকাল : ৬৬ বৎসর।
১১) স্বর্ণকুমারী। জন্ম : ১৪ ভাদ্র, ১২৬৩। মৃত্যু : ১৯ অষাঢ় ১৩৩৯। জীবনকাল : ৭৬ বৎসর।
১২) বর্ণকুমারী। জন্ম : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ। মৃত্যু : ৩ নভেম্বর ১৯৪৮। জীবনকাল : ৯১ বৎসর।
১৩) সোমেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৯ ভাদ্র, ১২৬৬। মৃত্যু : ১৬ মাঘ ১৩২৮। জীবনকাল : ৬২ বৎসর।
১৪) রবীন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৫ বৈশাখ। ১২৬৮। মৃত্যু : ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮। জীবনকাল : ৮০ বৎসর।
১৫) বুধেন্দ্রনাথ। জন্ম : ১৮৬৩। মৃত্যু ১৮৬৪। জীবনকাল : এক বৎসর।
(তথ্যসূত্র:
১- আত্মজীবনী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্য বিহার (২০১৪)।
২- মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী।
৩- ঔপনিষদ ব্রহ্ম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুঠোবই (২০১৮)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত