সুচিত্রা সেন কি ভারতের প্রথম ফেমিনিস্ট নায়িকা ছিলেন? তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। কেউ বলতে পারেন যে, তিনি সত্যিই নিজের শর্তে কাজ করে গিয়েছেন। কেউ বলতে পারেন যে, তিনি শর্ত রেখেছিলেন ঠিকই, তবে তা পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নয়। বরং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এক জননীর নিজস্ব জায়গা করে নেওয়ার খাতিরেই সেই শর্তগুলো রাখা হত। হয়তো নিজস্ব ‘ফেমিনিটি’ রক্ষা করার জন্য একটা অন্য ‘স্পেস’ তৈরি করার চেষ্টা। তবে যে কোনও কারণেই হোক না কেন, সে যুগে সুচিত্রা সেন-য়ের কাজ করার শর্তগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো। তখনকার দিনে মেয়েদের কোনও আলাদা মেক-আপ রুম ছিল না। স্রেফ নিজের দাবিতে তিনি নিজের জন্য আলাদা মেক-আপ রুম আদায় করে নিয়েছিলেন। কাজ করতেন দর্পের সঙ্গে। শোনা যায় যে কেরিয়ারের প্রথম দিকে যখন স্টুডিয়ো সিস্টেমে কাজ করা হত, তখন সুচিত্রা সেন নাকি উত্তমকুমারের থেকে বেশি মাইনে নিতেন। “শুনেছি পঞ্চাশের দশকের শুরুতে এমপি স্টুডিয়োতে কাজ করার সময় সুচিত্রা সেনের মাসিক মাইনে ছিল ২৫০০ টাকা। আর উত্তম কুমার পেতেন ২০০০ টাকা। সেটা ছিল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমা করার সময়,” বলছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়।
আর যখন নিজের কেরিয়ার শেষ করলেন, তখনও নিজের শর্তে। নায়িকা হিসেবেই। সিরিয়াল বা যাত্রা-র মা-মাসিমা, কিংবা নাতনি রাইমা-রিয়া-র দিদিমা রূপে কোনও দিন পর্দায় দেখা দেননি তিনি। তাঁর শেষ ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৮-এ। তার পর কেটেছে দীর্ঘ ৩৬ বছর। দিন পাল্টেছে। ইন্ডাস্ট্রির চেহারা বদলেছে। টলিউডের নায়িকাদের নিজস্ব মেক-আপ ভ্যান আজ সব্বারই থাকে। কিন্তু অন্য শর্তগুলো? আজকের নায়িকারা কী ভাবেন তা নিয়ে?
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের দেখা হয়েছিল ‘দেবী চৌধুরানী’র জন্য। প্রথমে নাকি এই ছবির কথা শুনে উৎসাহিত হয়েছিলেন মহানায়িকা। রাজিও হয়েছিলেন। গোলযোগ শুরু হয় ডেট নিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের সব সিনেমার নিয়ম ছিল, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ‘ফিক্সড ডেট’ দিতে হবে। কিন্তু সেই সময় সুচিত্রা সেন ব্যস্ত অভিনেত্রী, আর তাঁর পক্ষে তিন মাস ‘এক্সক্লুসিভলি’ এই ছবির জন্য সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই ছবিটি করেননি তিনি।
বাড়ির সকলে কৃষ্ণা বলে ডাকতেন, স্কুলে ভর্তির সময় তার নাম দেওয়া হয় রমা। ক্লাস নাইন-এ পড়ার সময় দু’টি ক্লাসের মাঝখানে ডেস্কের উপর বসে গল্প করতে-করতে বন্ধুদের একদিন হঠাৎ বলে ফেলেছিলেন ‘আমি এমন নাম করব যে, পৃথিবী চিরকাল আমায় মনে রাখবে।’ সেই রমা যখন সত্যি নাম করে ফেললেন সিনেমায়, হয়ে উঠলেন সুচিত্রা, উমাদেবী — তাঁর দিদি একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘তুই সিনেমায় নামলি, অভিনয়ের কী জানিস?’ নিজের দিদির কাছে সবচেয়ে সহজ ছিলেন সুচিত্রা, অকপটও, বলেছিলেন ‘না দিদি, পয়সার খুব দরকার, সিনেমা করতেই হবে। চেষ্টা করে দেখি, কতটা পারি।’ কতটা পেরেছিলেন তা বোধহয় শুধু বঙ্গদেশের মানুষজনই নন, আদিগন্ত ভারতবাসী জানেন— সাদাকালো চলচ্চিত্রে তিনি চিরন্তন বর্ণময়ী।
আবার যখন ১৯৫৩-’৭৮ পর্যন্ত দর্শকের চোখে স্বপ্নে-স্বপ্নে ফেরার পর স্বেচ্ছাবসর নিয়ে চলে গেলেন অন্তরালে, কেউই প্রায় জানতে পারল না কারণটা। কেবল তাঁর ছায়াসঙ্গী মহম্মদ হাসান জামান ছাড়া, যিনি ছিলেন তাঁর মেকআপ আর্টিস্ট, হয়ে উঠেছিলেন খুব কাছের মানুষ। একদিন জামান খুব মনখারাপ ক’রে বাড়ি ফিরে স্ত্রী জামিলাকে বললেন, সুচিত্রা আর অভিনয় করবেন না, আর না-করার যে কারণটি জানিয়েছেন, সেটি শুনে চমকে ওঠার মতো। শত অনুরোধেও জামান কিন্তু কারণটি বলেননি জামিলাকে: ‘ও ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলেছিল, ওকে যেন এই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন না করি’।
আড়াল তাঁর প্রিয় ছিল, আত্মজীবন লিখতে চাননি, তাঁর কথা কেউ কখনও যেন জানতে না পারে— এমনই বিধান দিয়েছিলেন, বারণ রেখে গিয়েছেন, তবু তাঁকে নিয়ে আনন্দলোক-এ বেরনো বিভিন্ন সময়ের রচনাদি তাঁর অলিখিত জীবনকেই গোচরে এনে দিল সকলের। অপরিণত মহাজীবনীর বদলে নিশ্চিন্তে এ-বই নির্ভর করে কোনও পারঙ্গম সাহিত্যিক কিংবা চলচ্চিত্রকার আখ্যানের মতো ভেবে ফেলতে পারেন সুচিত্রার জীবনী, যা এক বাস্তব মানুষের গল্প।
সে বাস্তবতায় ধরা পড়ে যান স্বয়ং উত্তমকুমারও, সুচিত্রার ক্রমোন্নতি ও সাফল্যে ঈষৎ ঈর্ষান্বিত, এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখছেন ‘আপনাদের সুচিত্রা সেন মুম্বইতে আরও দু’-তিনখানা বই-এ কনট্র্যাক্ট পেয়েছে। তিনি আজকাল একটু প্রাউড হয়েছেন… যাক, টাকা বেশি পেলে সকলেরই ওরকম হয়।’ আবার আর একটি চিঠিতে তারিফও করছেন: ‘‘… ‘ত্রিযামা’ বইতে আপনাদের চিরপরিচিতা ‘সুচিত্রা’ এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। …’’ মাধবী মুখোপাধ্যায়, যাঁর অভিনয় বাংলা ছবিকে আন্তর্জাতিক শিল্পমানে পৌঁছে দিয়েছে, সুচিত্রাকে নিয়ে তাঁর খেদ ‘বাংলা সিনেমায় অসাধারণ কিছু রোল করে যাওয়া সত্ত্বেও ভদ্রমহিলা তেমন কোনও স্বীকৃতি পেলেন না। … ভাবলে অবাক লাগে, এইরকম একজন অভিনেত্রী কখনও জাতীয় পুরস্কার পাননি!’ নৈর্ব্যক্তিক এই মুগ্ধতার পাশেই আবার তাঁর ব্যক্তিগত বিনীত অনুযোগ, সুচিত্রার মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গে: ‘আমার বাড়িতে হঠাৎ নেমন্তন্নের চিঠি এসেছিল। আমাদের, বাঙালিদের রীতি অনুযায়ী, মিসেস সেন বা ওঁদের পরিবারের কেউ সশরীরে নেমন্তন্ন করতে আসেননি। তাই আমার অভিমান হয়েছিল।’
■ প্রকৃত নাম রমা দাশগুপ্ত। মামা ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বি. এম সেন। শৈশবের অনেকটা কেটেছে বোলপুরে। মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে।
■ ছোট থেকেই ডাকসাইটে সুন্দরী। কলকাতার প্রখ্যাত ব্যবসায়ী দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় মাত্র ১৬ বছর বয়সে‚ ১৯৪৭ সালে।
■ কন্যা মুনমুনের আগে এক পুত্রসন্তান হয়েছিল তাঁর। তবে সেই শিশু বেশিদিন বাঁচেনি। মা হওয়ার পরে সিনেমায় অভিনয় শুরু করেছিলেন তিনি।
■ মূলত স্বামীর ইচ্ছে-উৎসাহেই সিনেমায় আসা। গায়িকা হিসেবে গান রেকর্ডও করেছিলেন। সেভাবে দিনের আলোর মুখে দেখেনি। পরে অন্য শিল্পীর কণ্ঠে শোনা গেছিল সেই গান।
■ সুচিত্রা সেনের শ্বশুরমশাই আদিনাথ সেন ছিলেন অত্যন্ত রাশভারী ব্যক্তিত্বের। তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন বিমল রায়ের বোন। তাঁর মৃত্যুতে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন আদিনাথ। তবে বিমল রায়ের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় ছিল।
■ বিমল রায়কে মামা বলে সম্বোধন করতেন দিবানাথ। সেই সূত্র ধরেই রমা ১৯৫২ সালে অভিনয় করেছিলেন ‘ শেষ কোথায়‘ বলে একটি সিনেমায়। কোনওদিন মুক্তি পায়নি তাঁর সেই প্রথম ছবি।
■ শ্রী সুকুমার দাশগুপ্ত ছিলেন ‘ সাত নম্বর কয়েদী‘ সিনেমার পরিচালক। তাঁর কাছে অডিশন দিতে গিয়েছিলেন রমা। সেখানে পরিচালকের সহকারী নীতিশ রায় (বম্বের নীতিশ রায় নন) ‘রমা‘ থেকে নায়িকার নাম পাল্টে করে দিয়েছিলেন ‘সুচিত্রা‘। সেই থেকে তিনি সুচিত্রা সেন।
■ ইন্ডাস্ট্রিতে গুটিকয়েক মানুষ তাঁকে রমা বলে ডাকতেন শেষ অবধি। উত্তম কুমার তাঁদের মধ্যে একজন। বাকি সবার কাছে তিনি ম্যাডাম‚ ম্যাডাম সেন বা মিসেস সেন।
■ ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় ‘সাত নম্বর কয়েদী ‘। এটাই তাঁর মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি। নায়ক ছিলেন সমর রায়।
■ ১৯৫১ সালে ‘ অ্যাটম বম্ব ‘ বলে একটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। তবে তিনি ছিলেন ‘এক্সট্রা‘ হিসেবে! আসল নায়িকা ছিলেন শ্রীমতী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
■ ষাটের দশকে তাঁকে নাম ভূমিকায় রেখে সত্যজিৎ রায় করতে চেয়েছিলেন দেবী চৌধুরানী। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন যতদিন শ্যুটিং চলবে‚ সুচিত্রা অন্য কারও সিনেমায় কাজ করতে পারবেন না। এই শর্তে রাজি হননি সুচিত্রা। বলেছিলেন‚ যাঁরা তাঁকে নায়িকা বানিয়েছেন তাঁদের বঞ্চিত করতে পারবেন না।তিনি রাজি হননি বলে সত্যজিৎ রায় ছবিটা করেনইনি। দীনেন গুপ্তর পরিচালনায় সুচিত্রা পরে ‘ প্রফুল্ল ‘ করেছিলেন বটে। কিন্তু সেই ছবি তাঁর সেরা ছবিগুলোর মধ্যে পড়ে না।
■ রাজ কাপুরের ছবি করার অফারও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
■ হিন্দিতে ‘আঁধি‘ ছবির শ্যুটিং-এর সময়ে আউটডোরে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল রাখী গুলজারের। কিন্তু পরিচালক গুলজারকে তিনি সবসময় ‘ স্যর‘ বলে সম্বোধন করতেন। যদিও গুলজার ছিলেন বয়সে ছোট। এই সম্বোধন পাল্টাতে না পেরে গুলজারও পাল্টা তাঁকে ‘ স্যর‘ বলে ডাকতে শুরু করেন।পাশাপাশি সুচিত্রার গুণমুগ্ধও ছিলেন গুলজার। সেই ‘ স্যর ‘ সম্বোধন বজায় ছিল শেষ দিন অবধি। ‘আঁধি‘-র মুক্তির পরেও আটকে ছিল ২০ সপ্তাহ। ছবিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির ছায়া থাকায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। পরে ১৯৭৭ সালে জনতা সরকারের আমলে ছবিটি প্রথমে মুক্তি পায় জাতীয় টিভি চ্যানেলে।
■ শ্রী দিবানাথ সেনের সঙ্গে দাম্পত্য সুখের ছিল না। ডিভোর্স না হলেও আলাদা থাকতেন তাঁরা। ষাটের দশকে বিদেশে প্রয়াত হন দিবানাথ। শোক ভুলতে কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন সুচিত্রা।
■ প্রথম বাঙালি নায়িকা হিসেবে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারে ভূষিত হন।
■ সিনেমায় অভিনয় থেকে সরে আসেন বলে রাজেশ খান্নার বিপরীতে একটি ছবি অসমাপ্তই থেকে যায়। সেটি ছিল নটী বিনোদিনীকে নিয়ে।
২০১৪ সালের ১৭ই জানুয়ারি না ফেরার দেশে চলে যান কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন। কিন্তু রেখে গেছেন চলচ্চিত্রের এক অনন্য অধ্যায়। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। কিন্তু প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়নি। তবে পরের বছরেই মুক্তি পায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। আর এই ছবির মাধ্যমেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শুরু হয় উত্তম-সুচিত্রা জুটির পথচলা।
প্রকৃত নাম রমা দাশগুপ্ত। জন্ম ১৯৩১ সালে বাংলাদেশের পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে করুনাময় দাশগুপ্ত আর ইন্দিরা দাশগুপ্তের ঘরে। পাঁচ সন্তানের মধ্যে রমা ছিলেন তৃতীয়। তার শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় কেটেছে পাবনার আলো-বাতাসেই। পড়াশোনা করেছেন পাবনার মহাখালী পাঠশালা ও পাবনা গার্লস স্কুলে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় আরও অনেক হিন্দু পরিবারের মতো রমার পরিবারও পাড়ি জমায় কলকাতায়। একই বছরে কলকাতায় থিতু হওয়া ঢাকার আরেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রমার। নামের শেষে স্বামীর উপাধি যোগ করে তিনি হয়ে যান রমা সেন। দিবানাথের মামা বিমল রায় ছিলেন তখনকার খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা। ভাগ্নেবধূ রমাকে তিনিই নিয়ে আসেন চলচ্চিত্রের পর্দায়। শ্বশুরের আগ্রহ আর স্বামীর উৎসাহে রূপালী জগতে নাম লেখানো রমা হয়ে যান সুচিত্রা সেন। এরপর ২৫ বছর যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সঙ্গে।
২৫ বছর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পর রহস্যজনকভাবে প্রায় ৩৫ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। ১৯৭৮ থেকে ২০১৪ সাল প্রায় তিনটি যুগ ঠিক কোন অভিমানে তিনি অন্তরালে জীবনযাপন করেছেন এই কাহিনী আজও রহস্য সৃষ্টি করে আছে সুচিত্রা ভক্তদের মধ্যে। অন্তরাল ভেঙে প্রথমে তিনি বাইরে আসেন মহানায়ক উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর।মাঝরাত পর্যন্ত বসেছিলেন তার মরদেহের পাশে।সুচিত্রা শেষ জনসমক্ষে আসেন ১৯৮৯ সালে তার গুরু ভরত মহারাজের মৃত্যুর পর। ২০০৫ সালে সুচিত্রাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হলেও ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিতে বাড়ির বাইরে দিল্লি যেতেও রাজি হননি তিনি।
১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন সুচিত্রা সেন। প্রথম অভিনীত ছবিটি পরে আর মুক্তি পায়নি।১৯৫৫ সালে বিমল রায়ের পরিচালনায় হিন্দি ‘দেবদাস’ ছবিতে দীলিপ কুমারের বিপরীতে অভিনয়ের সুযোগ পান সুচিত্রা। ‘পার্বতী’ চরিত্রে তার অভিনয়ে বিমোহিত হয় দর্শক। এ ছবি তাঁকে এনে দেয় জাতীয় পুরস্কার। এরপর একে একে অভিনয় করেন ‘শাপমোচন’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘সবার উপরে’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত’র মতো দর্শকপ্রিয় সব ছবিতে। ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে এসে ‘আঁধি’ ছবিতে রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান সুচিত্রা। ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছিল বিহারের রাজনীতিক তারকেশ্বরী সিনহার জীবনী অবলম্বনে। কিন্তু সুচিত্রা সেন পর্দায় হাজির হয়েছিলেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ‘স্টাইল’ নিয়ে।চলচ্চিত্রটির কয়েকটি দৃশ্য নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে মুক্তি দেওয়ার ২০ সপ্তাহ পরে ‘নিষিদ্ধ’ হয় আঁধি।‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৬৩ সালে ‘মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে’ সেরা অভিনেত্রীর সম্মান পান সুচিত্রা। ভারতীয় কোনো অভিনেত্রীর জন্য সেটিই ছিল বড়মাপের প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার পান ১৯৭২ সালে; ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পুরস্কার বঙ্গবিভূষণ অর্জন করেন। দুই যুগের অভিনয় জীবনে বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে ৬০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেন সুচিত্রা। সবশেষ ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিতে অভিনয় করেন সুচিত্রা।
এরপর ৩৫ বছর অন্তরালে থাকার পর ২০১৪ সালে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি অভিনেত্রী।
সুচিত্রা সেনের চলচ্চিত্র জীবন তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম মাইলস্টোন বলা হয় গুলজার পরিচালিত হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র ‘আঁধি’ কে। শ্রীমতী সেনের মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতিচারণে ২৭শে মার্চ ২০১৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় গুলজার লিখেছিলেন,
“আঁধি’র চিত্রনাট্য নিয়ে চললাম কলকাতা। আমি আর প্রযোজক জে ওমপ্রকাশ। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নো ডিসকাশন, নো কোয়েশ্চেন। আমি কোনও প্রশ্ন করব না, আপনি যা বলবেন আমি তা-ই মেনে নেব।’ আমি একটু লজ্জাই পেয়ে গেলাম। উনি মনে রেখেছেন তা হলে প্রথম সাক্ষাতের কথা।
চিত্রনাট্য শোনার পর উনি রাজি হয়ে গেলেন। এ বার আমি একটু হেসে বললাম, ‘আপনি এই সিনেমায় বিশেষ কোনও চরিত্রকে কাটছাঁট বা মডিফিকেশন করতেই পারবেন না। কারণ সিনেমাটায় একে চরিত্র কম, আর মহিলা চরিত্র মাত্র একটি, আপনার।’ মিসেস সেন একটু অবাকই হলেন, কারণ অন্য সবার মতো উনিও খেয়াল করেননি যে সিনেমায় কেবল একটি মহিলা চরিত্র। এমনকী সিনেমা দেখার পরও কেউ তেমন করে খেয়াল করেন না।
শুটিং শুরু হল। প্রথমেই বিপত্তি। উনি সবার সামনে আমাকে ‘স্যর’ বলে ডাকতে লাগলেন। বললাম, সে কী কথা! আপনি আমার চেয়ে বড়, আপনি আমায় স্যর কেন বলবেন? মিসেস সেন বললেন, ‘আপনি আমার ডিরেক্টর, তাই স্যর।’ আমি বললাম, ঠিক আছে আমিও আপনাকে তা হলে ‘স্যর’ বলেই ডাকব। দেখাদেখি গোটা ইউনিট ওঁকে স্যর বলে ডাকতে আরম্ভ করল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার আর ওঁর এই সম্বোধনই বজায় ছিল। কাশ্মীরে শুটিং-এর সময়টা বড় সুন্দর কেটেছিল। আমার মেয়ে বস্কি তখন ছোট। স্যর খুব খেলতেন ওর সঙ্গে। রাখীজিও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। দারুণ জমাটি আড্ডা হত— আমি, রাখীজি, সঞ্জীব আর স্যর। সঞ্জীবের সঙ্গে স্যরের খুব ভাল র্যাপো ছিল।
শুটিং শেষ হল। রাশ দেখে ইউনিটের সবার মুখ চুন। কারও ভাল লাগেনি। স্যরেরও না। কিন্তু মুখের ওপর তো সরাসরি বলতে পারেন না। তাই বললেন, ‘ঠিকই আছে এমনিতে। কিন্তু এর সঙ্গে নিশ্চয়ই আরও কিছু জুড়বে, মিউজিক জুড়বে।’ আমি বললাম, ‘দেখুন, সিনেমাটা এটাই। এর চেয়ে কিছু অন্য রকম বা নতুন হয়ে উঠবে না।’ আমার ক্যামেরাম্যান আমায় ডেকে বলল, ‘জো চিজ আদমি নিউজপেপার মে পড়তা হ্যায়, ও সিনেমা মে কিঁউ দেখেগা?’ মানে সিনেমাটা দর্শকের চোখে একটি কষাটে খবরের কাগজ ছাড়া কিছুই মনে হবে না। বসলাম এডিটিং টেবিলে এবং তার পর সবার চোখ চকচক করে উঠল। সবাই মুগ্ধ। মিসেস সেনের অনবদ্য অভিনয় দেখে মুগ্ধ, তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স-এ মুগ্ধ।
এর পর সেই ঘটনা। আমি তখন মস্কোয়, ফেস্টিভ্যালে। ভারতে তখন ‘আঁধি’ ২২-২৩ সপ্তাহ চলছে। জুবিলি হবে। হঠাৎ ফোন পেলাম, আঁধি ব্যান হয়ে গেছে। কেন? দক্ষিণ ভারতে কারা যেন প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে: স্ক্রিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিনা মদ খাচ্ছে, সিগারেট খাচ্ছে? অথচ আমি এই স্টিরিয়োটাইপটাই ভাঙতে চেয়েছিলাম। ভ্যাম্প ছাড়াও যে মেয়েরা ড্রিংক করে, সিগারেট খায়, সেটাই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম। পরে তখনকার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী আই কে গুজরাল-এর সঙ্গে কথায় কথায় জানতে পারি, কেবল ওটাই ইস্যু ছিল না, আরও নানা আপত্তি উঠেছিল। সঞ্জয় গাঁধী এই ধরনের প্রতিবাদে বিচলিত হয়ে সিনেমাটা বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এই ব্যান নিয়ে নিই ইয়র্ক টাইম্স-এ বিরাট রিপোর্ট হয়েছিল। স্যরও ব্যাপারটায় খুব আঘাত পেয়েছিলেন।
তবে সিনেমাটার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, আমাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। কত শুনেছি, উনি নাকি ভীষণ রিজার্ভড, কারও সঙ্গে মেশেন না, কথা বলেন না। কিন্তু আমি মানুষটাকে অন্য ভাবেই চিনেছি। হয়তো উনি পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষের সঙ্গেও মেলামেশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি তো কলকাতা গেলেই দেখা করতাম। মুনমুন আমায় বলেছিল, মা’কে জিজ্ঞেস না করে কারও ফোন দিতে পারি না, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ফোন তুলে আমায় শুধু বলতে হয়, স্যরের ফোন। এই পাওয়াটা বড় পাওয়া। আমি আসলে ওঁকে চিনি ভীষণ ইমোশনাল, ওয়র্ম এক জন মানুষ হিসেবে। আমার মনে আছে, ‘আঁধি’র গোটা শুটিং-এ যত বার ওঁকে কান্নার দৃশ্য করতে হয়েছে, এক বারও গ্লিসারিন ব্যবহার করেননি। কেবল একটাই আবদার ছিল। ক্যাসেট প্লেয়ারে আমাকে ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে’ গানটার ‘তুম জো কহে দো তো আজ কি রাত চাঁদ ডুবেগা নহি, রাত কো রোক লো…’ লাইন দুটো বাজাতে হত। উনি সেটা শুনতেন আর তার দু’মিনিট পর বলতেন, ‘শট নাও।’ আমি গোটা শুটিং-এ আমার টু-ইন ওয়ান আর ওই ক্যাসেটটা বয়ে বেড়াতাম।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে কত সময় গিয়ে দেখেছি, উনি বারান্দায় বসে আছেন আর কাকদের আঙুর খাওয়াচ্ছেন। কী অবাক হতাম! কাকগুলো সব ওঁর হাত থেকে আঙুর নিয়ে যেত। অথচ আমি শুনেছিলাম কাক নাকি মানুষকে ছোঁয় না! সকালের দিকে গেলে, উনি কাউকে বলতেন, এক গ্লাস ঠান্ডা দুধ আনতে। প্রতি বারই অবাক হতাম। আমার ব্রেকফাস্টের মেনু ওঁর এখনও মনে আছে! কত সময় কলকাতা গিয়েছি, কিন্তু ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। ফোন করে জানিয়েছি। ও মা, সন্ধেবেলায় হঠাৎ বারীনদা এসে উপস্থিত। বারীনদা ওর সেক্রেটারি থেকে ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, ‘ম্যাডাম এসেছেন গাড়ি নিয়ে, চলুন।’ তখন আমি দেখা করতে যেতাম।”
তাঁর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বলেছিলেন এক পরিচালক। শেষ দিকে সুচিত্রা সেন নাকি চেয়েছিলেন ‘নটী বিনোদিনী’ করতে। মহানায়িকা শ্রীমতী সুচিত্রা সেন কে নিয়ে অভিনেত্রী শ্রীমতী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন শ্রীমতী সংযুক্তা বসু। আনন্দবাজার পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়েছিল ৫ই এপ্রিল ২০১৪ সালে।
“… ‘ছেড়ে দে মাধু। তোর সঙ্গে আমার পোষাবে না। আমি রমাকে (সুচিত্রা সেন) দিয়ে অভিনয় করিয়ে নেব,’ …” ঋত্বিকদা যে কত বার আমাকে এই হুমকি দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে আমার যেমন ভাব ছিল তেমন ঝগড়াও হত খুব। হয়তো কোনও ছবির কাজ নিয়ে মতের অমিল হল, ঋত্বিকদা রেগে গেলেন। আর তখনই দুম করে বলে বসতেন ওই কথাটা। মনে মনে হাসতাম। ভাবতাম তোমার মতো খামখেয়ালি মেজাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করা অত সোজা! শেষমেশ সত্যিই ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে সুচিত্রা সেন কোনও দিনই অভিনয় করেননি। ঋত্বিক ঘটক মানুষটা কেমন ছিলেন তা নিশ্চয়ই জানতেন তাঁর রমাও। তা সত্ত্বেও ওঁদের মধ্যে কেন জানি না একটা আত্মিক যোগাযোগ ছিল।
সুচিত্রা সেন কিংবদন্তি মহানায়িকা। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, কিংবা তপন সিংহের তকমা না এঁটেও তিনি একাই একশো। ঋত্বিকদার মুখে তো রমা নামটা শুনেছিই বারবার। সেই সময়কার নামকরা প্রযোজক অসিত চৌধুরী আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমার রান্না খেতেন। কোনও রান্না ভাল লাগলে বলতেনএটা সুচিত্রার থেকেও ভাল হয়েছে। আসলে ওঁকে ঘিরে যে মুগ্ধতা তা যেন বাকরুদ্ধ করে রেখেছিল তাবড় বাঙালিকে।
সুচিত্রা তখন প্রায় উদীয়মান শিল্পী। এক বড় পরিচালক তাঁকে বোধ হয় প্রণয়ঘটিত প্রস্তাব-টস্তাব দিয়ে যথারীতি প্রত্যাখাত হন। তাতে পরিচালকমশাই প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেন, “দেখব রমা কী করে হিরোইন হয়! যদি হয় তো আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে।’’ তার বহু দিন বাদে সেই পরিচালকের সঙ্গে আবার দেখা সুচিত্রার। তখন তিনি স্টার সুচিত্রা সেন। পট করে পরিচালককে বলে বসলেন, ‘‘দেখি দেখি, আপনার হাতটা। হাতের তালুতে চুল গজানোর কথা ছিল তো! আমি তো হিরোইন হয়ে গিয়েছি।”
এই রকম আশ্চর্য সব রসিকতা উনি নাকি মাঝেমধ্যেই করতেন। একবার কী এক খেয়ালে বাড়িতে একটা শিম্পাঞ্জি পুষলেন (তখন প্রাণী পোষা নিয়ে কোনও বিধিনিষেধ ছিল না)। সে শিম্পাঞ্জি নাকি চা-সিগারেটও খেত। হঠাৎ একদিন কী খেয়ালে পোষ্যটিকে দিয়ে দিলেন তাঁর প্রিয় এক মেক আপ আর্টিস্টকে।
টুকটাক এই সব খামখেয়ালির গল্প শোনা গেলেও আসলে সুচিত্রা ছিলেন অসম্ভব ডিসিপ্লিনড, বাস্তববাদী মানুষ। এ কথাটা তাঁকে যাঁরা দেখেছেন সকলেই বলেন। এমনকী উত্তমকুমারের সঙ্গে যখন কাজ করেছি, তখন কদাচিৎ সুচিত্রা সেনের কথা উঠলে দেখতাম উত্তমকুমারের কী গভীর শ্রদ্ধা!
ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কোনও দিন। অ্যলবামে এমন কোনও ছবি নেই যেখানে আমি আর সুচিত্রা সেন একসঙ্গে।
‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের ছোটবেলার চরিত্রে আমার অভিনয় করার কথা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু আমার গড়ন ছিল রোগাটে, তাই শেষমেশ চান্স হয়নি। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তখনকার বিখ্যাত শিশুশিল্পী শিখারানি।
মুনমুনের সঙ্গে আমার অনেক দিনের আলাপ। সুচিত্রা সেনের পারলৌকিক অনুষ্ঠানে যে দিন গেলাম, মুনমুন আবেগ ভ’রে বলল, ওর মা নাকি আমার প্রসঙ্গে বলতেন, “এই মেয়েটা ভারী ভাল অভিনয় করে কিন্তু!” সত্যিই তো আমি ওঁর মেয়ে ছাড়া আর কী’ই বা হতে পারি! ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘উত্তর ফাল্গুুনী’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘হসপিটাল’ এ সব ছবি আমার কাছে বীজমন্ত্রের মতো। আমার তো মনে হয় আর সব চরিত্রর কথা যদি না-ও বলি, রিনা ব্রাউনই হল সেই চরিত্র, যা শুধু সুচিত্রা সেন ছাড়া আর কেউ করতে পারতেন বলে আমার অন্তত মনে হয় না।
সুচিত্রা সেন যখন পুরোদমে তারকা, তখন প্রত্যেক স্টুডিওতেই তাঁর জন্য আলাদা একটা ঘর থাকত। তাঁর শ্যুটিং থাকলে সে ঘর খোলা হত। সেখানে বসে মহানায়িকা মেকআপ ও বিশ্রাম সারতেন। তখনকার দিনে একটা নিজস্ব ঘর সুচিত্রা আদায় করে নিয়েছিলেন প্রত্যেক স্টুডিও চত্বরে, কেবল নিজের মানসিক প্রস্তুতির জন্য। সেই ঘর থেকে বেরিয়ে যখন ফ্লোরে ঢুকতেন তখন তিনি আর রমা নন। নন সুচিত্রা সেনও। তখন শুধু মাত্র সেই চরিত্রটাই তাঁকে ঘিরে থাকত, যে চরিত্রে তিনি অভিনয় করছেন। অভিনয় ছেড়ে যখন চলে গেলেন তিনি, তার বহু পরে বিভিন্ন স্টুডিয়োয় সুচিত্রা সেনের নামাঙ্কিত ঘরগুলোতে প্রবেশের অধিকার পেয়েছি। সুন্দর আসবাবে সাজানো। বড় আয়না। বসার জায়গা। জানলায় শৌখিন পর্দা। সবেতেই এক অভিজাত রুচির পরিচয়। সবই ছিল। কিন্তু নায়িকার নির্বাসনের পর ক্রমে তা মলিন হয়ে গিয়েছিল। যত বারই সে সব ঘরে ঢুকেছি তত বারই মনে হয়েছে এই বাহ্যিক সাজসজ্জার আড়ালে একটা সত্য আছে। নিজের শর্তে জীবন বাঁচার বিদ্যাটা যে কী করে ওই রকম একটা পুরুষশাসিত সমাজে দাঁড়িয়ে আয়ত্ত করেছিলেন তিনি, ভাবলে আজও অবাক হয়ে যাই।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ওঁর ‘দেবী চৌধুরাণী’ করা হয়নি। কারণটা সবার জানা। সত্যজিৎ রায় শ্যুটিংয়ের সময়টা ওঁকে ‘এক্সক্লুসিভ’ ভাবে চেয়েছিলেন। সুচিত্রা মানেননি। তবে এই ‘এক্সক্লুসিভ’ চাওয়ার ব্যাপারটা শুধু যে সুচিত্রা সেনের ক্ষেত্রেই ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। আমি যখন ‘চারুলতা’ করি, তখন আমাকেও সব কাজ ছেড়ে ওই একটা ছবির কাজই করতে হয়েছে। ‘দেবী চৌধুরাণী’ কেন হয়নি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু সবচেয়ে যেটা আপসোস হয় ভাবলে যে, সত্যজিৎ- সুচিত্রার ভাবনায় একটা কালজয়ী বাংলা ছবি হয়তো দর্শক মিস করল।
আরও একটা আক্ষেপ। শেষ দিকে নাকি ‘নটী বিনোদিনী’ করার খুব ইচ্ছে ছিল সুচিত্রা সেনের। চিত্রনাট্য পর্যন্ত তৈরি ছিল। শেষ পর্যন্ত কাজটা হল না। সেই সময় মুনমুন ‘রাজবধূ’ বলে একটা ছবি করে। জানি না সেই কারণেই কি সুচিত্রা সেন ‘নটী বিনোদিনী’ করলেন না?
আজ ওঁর কথা বলতে গিয়ে মুনমুনের মুখটাই ভেসে উঠছে বারবার। বছরখানেক আগের কথা। সে দিন কোয়েল (মল্লিক)-য়ের বিয়ে। বিরাট জায়গা জুড়ে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। প্রচুর অতিথি অভ্যাগত। ভিড়ের মধ্যে মুনমুনের সঙ্গে দেখা। আমাকে ও এক জায়গায় বসাল। খানিকক্ষণ গল্প করল। তার পর ওকে চলে যেতে হল। আরও খানিকটা থেকেই যেত হয়তো, কিন্তু মেয়েকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে যেতে হবে বলে চলে গেল। কিন্তু কী স্নেহভরা সান্নিধ্য! কী দায়িত্ববোধ! আমার মনে হয় এ সবই মুনমুন মায়ের শিক্ষায় পেয়েছে। শুনেছি নিকটজনদের খুব আদরযত্ন করতেন সুচিত্রা। সেই গুণ মেয়েও পেয়েছে।
মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা সুচিত্রা সেন না রাখলেও শুনেছি দানধ্যানে উনি ছিলেন উদার। আড়ালে থেকেও সে কাজটা উনি করে গিয়েছেন। সবাই যে সর্বসমক্ষে আসবেন এমন তো কোনও কথা নেই। কিন্তু ওঁর যে সিনেমাজগতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না তা নয়। পছন্দসই মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। যেমন কানন দেবীর প্রতি সুচিত্রা সেনের শ্রদ্ধা ছিল। ছিল আন্তরিক সম্পর্কও। এ কথা কাননদি নিজেই বলেছেন কত বার। বয়সে অনেকটা বড় হলেও ছায়া দেবীর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল সুচিত্রা সেনের। সুচিত্রা নাকি মহানায়িকা ইমেজকে বাঁচিয়ে রাখতেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। অনেকেরই এমন ধারণা। কিন্তু বিশ্বাস করুন এটা আমার মনে হয় না। বরং মনে হয়, এই যে এত ছবি, এত নামযশ, এত গ্ল্যামার, এত অহং-য়ের পূর্ণতা এ সব থেকে উনি বোধহয় মুক্তি চেয়েছিলেন। জীবন যে খুব নশ্বর সে কথা ভেবেই। আমিত্বকে পুরোপুরি মুছে ফেলার সাধনাতেই থেকে গেলেন বাকি জীবন। কিছুই থাকার নয়। সবই ফুরায় একদিন। এই সত্যটাকে আগে থেকে উপলব্ধি করেই সতর্ক হয়েছিলেন। আত্মস্থ হয়েছিলেন। চলে যাওয়ার পর কাল তাঁর প্রথম জন্মদিন। যেখানেই থাকুন, সেটা ওঁর কাছে নতুন একটা পৃথিবী।
আপনাকে প্রণাম করে এই শুভেচ্ছা জানাই রমাদি, ভাল থাকবেন। নিজের শর্তে বাঁচবেন। যেমনটা বেঁচে এসেছেন এত দিন।”
‘ফরিয়াদ’ ছায়াছবির গান শোনাতে নচিকেতা ঘোষ গিয়েছেন সুচিত্রা সেনের বাড়ি। মন দিয়ে গান শুনলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। গান শোনার পর সুচিত্রা সেন বললেন, শুনুন, গানের মাঝে হাসিটা কিন্তু আমি নিজে হাসব। আপনার আশা ভোঁসলে নয়। আমি রেকর্ড করে দেব। আপনি নিয়ে যাবেন। সুবোধ বালকের মত ঘাড় কাত করে তাতে সম্মতি জানালেন নচিকেতা ঘোষ।
কয়েক দিন পর নচিকেতা ঘোষ মুম্বই হাজির। এবার যথারীতি আশা ভোঁসলের বাড়িতে। ঘটনা সবকিছু শুনে আশাজি বললেন, ‘‘ইয়ে সুচিত্রা সেন নে হাসকে দিয়া, ইসসে আচ্ছা হাসি আউর হোগাই নেহি। শুনাইয়ে সুচিত্রা সেন কা রেকর্ড। দেখুঙ্গি ক্যয়া হ্যায় উসকি হাসি মে, জো মেরা নেহি হ্যায়!’’ শিল্পীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে এভাবে কাজ আদায় করে নিতেন নচিকেতা ঘোষ।‘ফরিয়াদ’ ছবিতে সেই গানটি ছিল ‘নাচ আছে গান আছে, রূপের তুফান আছে/যা কিছু কিনতে চাও কেনো না/ চোখের-ই জল শুধু তুমি চেয়ো না/একে যায় না কেনা, এ তো কেউ পাবে না, এ আমার-ই থাক/অনেক নেশা ঝলক আছে/হরিণ চোখের পলক আছে/এ চোখ কিনতে চাও কেনো না/ চোখের-ই জল শুধু তুমি চেয়ো না/আরো আরো যত পারো/ছুড়ে দাও ছুড়ে দাও সোনা চাঁদের ঝুটি/মারো না আমায় মারো না/আমি হাসি, শুধু হাসি, আমার লাগে না ব্যথা, লাগে না লাগে না, লাগে না হা হা হা/এ চোখ কিনতে চাও কেনো না/আরো আরো যত পারো, কেড়ে নাও কেড়ে নাও আমার সাধের স্বপ্ন/যে টুকু লজ্বা আছে কোরো না/আমি হাসি, শুধু হাসি, আমার লাগে না ব্যথা, লাগে না লাগে না, লাগে না, হা হা হা/যা কিছু কিনতে চাও কেনো না/শুধু চোখের জল ওগো তুমি চেয়ো না’।
এরপর রেকর্ডিং-এর সময় গাইতে গাইতে আশা ভোঁসলে এক পর্যায়ে হাসতে হাসতে কেঁদে ফেললেন! ‘আমি হাসি শুধু হাসি…আমার লাগে না ব্যথা লাগে না…। তারপর? কলকাতায় ফিরতে রেকর্ডিং শুনলেন সুচিত্রা সেন। নচিকেতা ঘোষের সামনে সুচিত্রা সেন তখন একেবারে স্তব্ধ। পুরোপুরি মুগ্ধ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর সুচিত্রা সেন বললেন, ‘‘এ যাত্রায় আমার হাসিটা বাদ থাক! পাঠক ভাবুন একবার। একজন শিল্পী কতোটা নিজের সর্বস্ব উজার করে ঢেলে দিলে আরেকজন শিল্পী তাতে এমন সম্মান দেখাতে পারে!
‘আজ দুজনে মন্দ হলে মন্দ কি/দেখো ময়ূরপঙ্খী রাত যে আলোয় ঝিলমিলে/আহা এমন রাতে এসো না আজ ভাব করি/আহা এই ফাগুনের বাহার তো কাল থাকবে না/ও ভ্রমর, তখন তুমি ফুলের খবর রাখবে না/যৌবনেরই রঙ মশাল, জ্বলছে দেখো রঙ মাতাল/সেই আগুনে আজকে না হয় ঝাঁপ দিলে/দেখো ময়ূরপঙ্খী রাত যে আলোয় ঝিলমিলে/আহা এমন রাতে এসো না আজ ভাব করি/যদি তোমার চোখে আমার চোখে রঙ লাগে/আর, একটু ছোয়ায় রক্তে যদি ঢেউ জাগে/দোহাই বলো দোষটা কি/মনকে কেনো দাও ফাঁকি/ও, মৌমছি! একটু না হয় আজকে তুমি মৌ নিলে/দেখো ময়ূরপঙ্খী রাত যে আলোয় ঝিলমিলে/আহা এমন রাতে এসো না আজ ভাব করি’।
এটাও ‘ফরিয়াদ’ ছবির গান। গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর সুরকার নচিকেতা ঘোষ। আর গানটি গেয়েছেন শিল্পী আশা ভোঁসলে। ফরিয়াদ ছবির পরিচালক ছিলেন বিজয় বসু। আর এ ছবিতে সুচিত্রা সেনের বিপরীত চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত। সুচিত্রা সেন করেছিলেন রতনমালা চরিত্রটি। আর ‘ফরিয়াদ’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭১ সালে।
একবার বিজলী সিনেমার ম্যানেজার বিশ্বাবসু রায় চৌধুরীর ঘরে দেখা গেল রমা দাশগুপ্তকে। সঙ্গে তাঁর স্বামী দিবানাথ সেন। মিসেস সেনের চেহারায় সাজগোছের কোনো চিহ্ন নেই! তখন উপস্থিত কেউ কেউ বললেন, সলজ্ব দেখা যে কোনো গৃহবধূর তুলনায় রমা ছিলেন সত্যি সত্যি একেবারে আলাদা। ছাই চাপা আগুনের মত চেহারা ছিল সেদিন রমা সেনের। আর মনের কোনে কীসের যেন এক হতাশা! তাই রমা ম্যানেজার বিশ্বাবসুকে বলেছিলেন, আর ট্রায়াল দিতে পারছি না। আর স্ক্রিন টেস্ট দিতে পারছি না!
বিশ্বাবসু রায় চৌধুরী একটা ছবি ম্যানেজ করে দেবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ছবি তো রাতারাতি হয় না। ওদিকে রমা যে সেদিন ওভাবে ছাই চাপা আগুন থেকে একেবারে দাবানল হয়ে উঠবেন, কেউ ভাবতেও পারেননি। যে ‘সাত নম্বর কয়েদী’ ছবিতে সুচিত্রা সেন তেমন আলোড়ন তুলতে পারেননি, যে সকল সংবাদপত্র তাঁকে নিয়ে সেদিন লিখেছিলেন যে নবাগত সুচিত্রা সেন রূপালি পর্দায় উত্তীর্ণ হবার নম্বরটুকু হয়তো পেতে পারেন, কিন্তু তা আহামরি তেমন কিছু না। সেদিন বিজলী সিনেমার ম্যানেজার বাবুর রুমে অমন দাবানল আর কেউ কোনো দিন দেখেননি।
তারপর নিজের প্রত্যয় আর সাধনায় সেই সুচিত্রা সেন কোটি কোটি বাঙালির হৃদয় জয় করলেন কেবল অভিনয় দিয়েই। একবার ভাবুন তো, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে কতটা প্রত্যয় আর দৃঢ়তা লাগে একজন শিল্পীর জীবনে। যেটাতে ভেসে যায় জীবনের ফেলে আসা সকল ব্যর্থতা আর গ্লানিটুকু! সেই দৃঢ় প্রত্যয়ের ভেতরে কমিটমেন্ট আর সাধনা ছিল বলেই আমরা একজন সুচিত্রা সেন পেয়েছি। বাঙালি সিনেমা দর্শকরা পেয়েছে এক অমর শিল্পীকে। আর তিনি বাংলা সিনেমায় এককভাবে রাজত্ব করা সুচিত্রা সেন।
ছায়াছবির পর্দার মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। তাঁর অভিনীত বাংলা ছবিগুলিতে গানের বিরল সম্ভার। ঢুলি, অগ্নিপরীক্ষা, সবার উপরে, সাগরিকা, শিল্পী, চন্দ্রনাথ – অসংখ্য ছবি আর অসংখ্য গান। সেসব গানের শিল্পীরা দিকপাল, সন্দেহ নেই। কিন্তু অসামান্য লিপ দেওয়ার গুণে গানগুলি মহানায়িকারই গান হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন “প্রতিটি গানেই লিপের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সিরিয়াস ছিলেন সুচিত্রা। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ গানটির ‘মিতা মোর কাকলি কুহু’ কথাগুলো যেখানে আসছে, ওই জায়গাগুলোয় লিপ দেওয়া কিন্তু ভীষণ কঠিন। বিশেষ করে ‘কুহু’ শব্দের আন্দোলনের যে বৈচিত্র্য তা পর্দায় এমন ভাবে লিপ দেন সুচিত্রা যা দেখে দর্শকরা আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলেন।”
আসলে এমনটা তখনই সম্ভব যখন গানের অন্দরে নিজের মতো করে প্রবেশ করা যায়। গানের ভাব আর নিজের মনের ভাবনাকে একাত্ম করা যায় এবং সর্বোপরি গান গাইবার ওপর প্রচণ্ড দখল রাখা যায়। এর সবটাই ছিল মহানায়িকা সুচিত্রা সেন-এর। যদিও আপামর বাঙালির ঘরে সুচিত্রা সেনের স্ব-কণ্ঠে গান গাওয়ার খবর রাখা নেই তথাপি এ ঘটনাটিও সত্যি যে তিনি গান গাইতে জানতেন এবং গানের রেকর্ডও করেছিলেন।
সেটা ১৯৫৯ সাল। ২৭শে জুলাই। একটি বিশেষ রেকর্ড কভারে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির কর্ণধার কমল ঘোষ অনেক আশা নিয়ে একটা নতুন ঘটনা ঘটালেন। তিনি সুচিত্রা সেনের স্ব-কণ্ঠে গানের রেকর্ড প্রকাশ করলেন। নায়িকা সত্ত্বা থেকে তিনি বার করে আনলেন সুচিত্রার গায়িকা সত্ত্বাকে। এই রেকর্ডের একপিঠে রয়েছে ‘আমার নতুন গানের নিমন্ত্রণে’ আর অন্যপিঠে ‘বনে নয় আজ মনে হয়’। এসব গানের কথা লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর সুর দিয়েছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। ‘আমার নতুন গানের নিমন্ত্রণে’ গানটি মিউজিকের সাথে শুরু করার আগে প্রথম শব্দকটি মুখে বলেছিলেন সুচিত্রা সেন। যেন শ্রোতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন। যেন জিজ্ঞাসা করছেন তাঁর গানের নিমন্ত্রণে শ্রোতা সাড়া দেবে কি? যেমন ভাবে তাঁর ছবির জন্য সবাই পাগল হয় তেমনটাই হবে কি তাঁর কণ্ঠে গান শুনে? এক বিরাট প্রশ্ন নিয়ে ও প্রশ্ন দিয়েই গানের জগতে পা ফেলেছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু কী পেয়েছিলেন তিনি?
বিখ্যাত ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় লেখা হল “দরদি কণ্ঠে বেশ কিছু বছর আগে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে বলেছিলেন ‘আমার নতুন গানের নিমন্ত্রণে আবার তুমি আসবে কি?’ কিন্তু সেদিনের সেই গানের নিমন্ত্রণে সাড়া তিনি বিরাট ভাবে পাননি। আর সেই কারণেই বুঝি হৃদয়ের সংগীত সত্ত্বাকে শুধু মাত্র হৃদয়ের পিঞ্জরেই বন্দি করে হারিয়ে গিয়েছেন জনগণের সূক্ষ্ম বিচার কক্ষ থেকে আজকের জনগণবন্দিতা সুচিত্রা সেন।”
শ্রীমতী সুচিত্রা সেনের লিপে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রে অসংখ্য গান গেয়েছিলেন কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী শ্রীমতী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন শ্রীমতী সুচিত্রা সেনের অন্তরঙ্গ বান্ধবী। শ্রীমতী সুচিত্রা সেনের জন্য তাঁর গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা এবং শ্রীমতী সুচিত্রা সেনের জীবনের নানা অজানা কথা নিয়ে তাঁর এই সাক্ষাৎকার টি ১৮ই জানুয়ারি ২০১৪ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকার টি নিয়েছিলেন সাংবাদিক শ্রী গৌতম ভট্টাচার্য।
“আমার জামাই বাড়িতে এসে দুপুরবেলা টিভি খুলে দেখছিল। আমি এক বারের জন্যও তাকাইনি। আমার পক্ষে সম্ভবই নয় সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্য দেখা।খবরটা পেয়েই শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। প্রেশার বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে কথা বললেও টায়ার্ড লাগবে। আমাদের সবাইকে একদিন যেতে হবে। এটাই নিয়ম। চলে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। তবু পৃথিবীতে সুচিত্রা নেই, মানব কী করে? অথচ আমার সঙ্গে শেষ দেখা প্রায় বাইশ বছর আগে। আমার মেয়ের বিয়ে ছিল ’৯১-এর নভেম্বরে। তার জন্য বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে ওকে নেমন্তন্ন করতে গিয়েছিলাম। প্রকাশ্য বিয়ে-টিয়েতে ও আসবে না জেনেও গিয়েছিলাম। আমাদের বন্ধুত্বটা এতই জোরালো ছিল। এর পরেও কয়েক বার ফোনে কথা হয়েছে। আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, আমরা যেমন টিভিতে পুরনো গান-টান চালিয়ে দেখি, সুচিত্রা কেমন যেন নির্মোহ হয়ে গিয়েছিল। টিভি চালাতই না। পুরনো ছবি-টবিও দেখত না।
অনেকের মনে হয় ও খুব রহস্যময়ী ছিল। জীবনের শেষ দিন অবধি সেই রহস্যটা বজায় রেখেছিল। আমার কিন্তু মনে হয়েছিল একটা কারণ হতে পারে নায়িকা ছাড়া অন্য কোনও ভূমিকায় ও হয়তো প্রকাশ্যে আসতে চায়নি। আরও একটা কারণ হতে পারে, ওর মনটা অন্য দিকে চলে গিয়েছিল। ধর্মের দিকে ওর ঝোঁক ভীষণ বেড়ে গিয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি একদিন আমাকে ফোন করে বলল, “সন্ধ্যা, আমার সঙ্গে একটু বেলুড় মঠে যেতে হবে। ভরত মহারাজ তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।” আমি, আমার স্বামী শ্যামল গুপ্ত, সুচিত্রা সবাই দল বেঁধে গেলামও। ছিলেন অসিত চৌধুরীও। সেই প্রথম আমার বেলুড় মঠ যাওয়া। বেলুড় মঠে ওকে দেখে আমার অবাকই লেগেছিল। যে মহানায়িকাকে আমি এত বছর চিনতাম, সেই গ্ল্যামারের দুনিয়া থেকে এত তাড়াতাড়ি ওর বিবর্তন হয়ে গেছে, ভাবতেও পারিনি। এক বার ওর বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়নি। আমার বাড়িতে প্রতি বারই হত। সে বার সুচিত্রা, ওর ছোট বোন রুনা আর মুনমুন আমাদের বাড়িতে এসেছিল। সুচিত্রা এসেছিল পুরো উপোস করে। অঞ্জলি দিল, সন্ধেবেলা খেল। শেষের দিকে এক-আধ বার মনে হতো ওকে ফোন করি। তার পরেই ভাবতাম আমার বন্ধু যখন নিজের জন্য এ রকম একটা জীবন বেছে নিয়েছে, সেই ইচ্ছেকে বিরক্ত করা ঠিক নয়।
ওর লিপ-এ আমার যে কত গান আছে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আমাদের যুগলবন্দি নিয়ে মানুষ উচ্ছ্বসিত ছিল। সেই সময় সবার মুখে মুখে ফিরত, উত্তমবাবু মানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর সুচিত্রা মানে সন্ধ্যা। এত ভাল লিপ দিত সুচিত্রা যে, এক এক সময় আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, গানটা কি ও-ই গেয়েছে? আবার ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’-তে যেখানে আমি অভিনয় করে বলেছি ‘তুমিই বলো’, বা শেষে ওই যে ‘লা লা লা লা’, ওটা লোকে ভেবেছে বুঝি সুচিত্রার গলা। বোঝেনি। বসুশ্রী-তে সেই সময় বিশাল প্রোগ্রাম হত। উত্তমবাবু নিয়মিত আসতেন। এক বার তো আমি আর উত্তমবাবু ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ ডুয়েট গাইলাম। কী রিঅ্যাকশন তার! এত বছর পরেও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।
সবাই উত্তম-সুচিত্রা পর্দার জুড়ির কথা বলে। আমার পর্দার বাইরেও ওদের দারুণ লাগত। অদ্ভুত একটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল ওদের মধ্যে। সুচিত্রা তো দেখতাম ‘উতু’ বলে ডাকত। উত্তমবাবু ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ করলেন। যেখানে মান্নাবাবু আর আমার দু’জনের গলায় গানটা ছিল ‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে’। আমি এক দিন সুচিত্রাকে ফোন করে বললাম, একটু প্রোজেকশন রুমে আসবে? গানটা শুনে বলবে কে বেটার গেয়েছে? খুব সিরিয়াসলি নয়, মজা করে বলা। কিন্তু সুচিত্রা বলল, “আসছি।” প্রোজেকশন রুমে শুনেটুনে বলল, “তুমি বেটার গেয়েছ।” ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-তে আরও একটা গান ছিল, ‘আমি যে জলসাঘরে’। সেটাতেও দু’একটা জায়গা ছিল যেখানে আমার গায়কির ও খুব তারিফ করেছিল।
সুচিত্রা নিজে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে দুটো গান রেকর্ড করেছিল। আমি কখনও ওর গায়কি সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হতে পারিনি। কিন্তু গানটা খুব ভাল বুঝত। এত ভাল লিপ যে দিত, তার পেছনে রহস্য বোধহয় গানটা বোঝা আর ওর আন্তরিকতা। স্টুডিওয় শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর রেকর্ড বাজিয়ে অনবরত শুনত। আর লিপ প্র্যাকটিস করত। আমি অনেক নায়িকার গলায় গান গেয়েছি। কিন্তু সুচিত্রা অসামান্য ছিল। শুধু চোখমুখের এক্সপ্রেশন দিয়ে ও একটা গানকে এমন বিশ্বাসযোগ্য করে দিত যে, ভাবাই যায় না। কোনও মুভমেন্ট নেই, অথচ মনে হচ্ছে ও-ই গাইছে।
আমাদের প্রথম আলাপ ব্যারাকপুরের এমপি স্টুডিওতে। ‘সবার উপরে’ ছবিতে প্রথম সুচিত্রার লিপে গান গাই। সেটা ছিল ‘জানি না ফুরাবে কবে’। রেকর্ডিং করছি স্টুডিওতে। মিউজিক ডিরেক্টর রবীন চট্টোপাধ্যায় এসে আলাপ করিয়ে দিলেন। কিন্তু আমাদের জুটির রিয়্যাল জয়যাত্রা শুরু ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে। ওটা রিলিজ হয়েছিল ‘সবার উপরে’-র ঠিক এক বছর আগে। কিন্তু ‘সবার উপরে’-র গান রেকর্ডিং হয়েছিল আগে। বাঙালির ঘরে ঘরে অসামান্য সুন্দরী গর্বিতা মেয়েটি পৌঁছে গেলেন ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি থেকে।
আমাদের প্রথম হিট গান ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’। পর্দায় ওর লিপ দেওয়া দেখে আমি হাঁ হয়ে গেছিলাম। এত নির্ভুল! অমর হয়ে গিয়েছিল ওই গানটা। অথচ অনুপম ঘটক যখন সুর করেছিলেন, তখন ডিরেক্টর বিভূতি লাহা একেবারেই খুশি হতে পারেননি। উনি রীতিমতো হম্বিতম্বি করে মিউজিক ডিরেক্টরকে বললেন, এটা কী গান হয়েছে? তখনকার দিনের মিউজিক ডিরেক্টরদের যথেষ্ট মেরুদণ্ড ছিল। আজকালকার মতো নয়। উনি পাল্টা ডিরেক্টরকে বললেন, আপনি কী করবেন আপনি ভাবুন। আমি এটা নিয়ে যথেষ্ট কনফিডেন্ট। ছবির রেকর্ডিস্ট খুব সম্ভবত ছিলেন যতীন দত্ত। উনিও বললেন, ওঁর ভাল লেগেছে। গানের একটা জায়গায় ছিল ‘কুহু কুহু’। ওঁরা ডিরেক্টরকে বললেন, এই জায়গায় সন্ধ্যার গলার কাজটা দেখুন। কী করে বলছেন গানটা কিছু হয়নি? ডিরেক্টর শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন। বাকিটা ইতিহাস।
আমাদের বন্ধুত্বেরও সেই শুরু হয়ে গেল। এর পর ‘সাত পাকে বাঁধা’ করে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে সুচিত্রা সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতল। তখন ও থাকত নিউ আলিপুরে। দিবানাথবাবু তখনও ওর জীবনে ছিলেন। আমি গেলাম। সুচিত্রা দেখেই বলল, দিবানাথের তোমার গান খুব ভাল লাগে। আমি বললাম, “আজ ও সব ছাড়ো। তোমাকে অনেক অভিনন্দন!” বলে বেলফুলের একটা বড় মালা নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা গলায় পরিয়ে দিলাম। আর বিদেশি পারফিউম ওর জন্য নিয়েছিলাম। সেটা স্প্রে করে দিলাম। সুচিত্রা-রা তখন কোথাও একটা বেরোচ্ছে। বলল, “করেছ কী! গলায় মালা, এত ভাল পারফিউম, তুমি তো আমাকে রানির মতো করে দিলে!”আজ বিষণ্ণ ভাঙা মনে ওর স্মৃতি হিসেব করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, রানির মতোই তো ও চলে গেল। যাওয়ার আগে হাসপাতালেও কী লড়াইটাই না করে গেল! সাংবাদিক আমার কাছে জানতে চাইছেন, জীবনের যে কোনও একটা গান ওকে উৎসর্গ করতে হলে আমি কোনটা বাছব? এক কথায় বলা খুব মুশকিল। এত সব হিট গান আছে আমাদের জুড়িতে যে, কোনও একটা গান বাছি কী করে? তবু অনেক ভেবেটেবে মনে হচ্ছে ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’টাই হতে পারে। সুচিত্রা-সন্ধ্যা বন্ধুত্বের তো সেই শুরু।
অনেকে বলত, সন্ধ্যা তুমি কণ্ঠ, ও হল শরীর। আজ শরীরটা চলে গেল। এ দুর্ভাগা কণ্ঠটাই শুধু পড়ে থাকল।”
সুচিত্রা সেন পাঁচ বছর হল নেই। তবে চলে যাওয়ার আগেও প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর তিনি থেকেও ছিলেন না। যোগাযোগ ও প্রচারের বাইরে চলে গিয়ে নিজের এক অদৃশ্য উপস্থিতি রচনা করেছিলেন সিনেমা জগতে, হলিউডের গ্রেটা গার্বোর মতো। যদিও অন্তরালবর্তিনী হওয়ার সময় তিনি গার্বোর এই সুদীর্ঘ আড়ালের জীবন (১৯৪১ থেকে) সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতেন না। কালে কালে এই তুলনা উঠতে থাকায় জেনেছিলেন। ১৯৯০-এ গার্বোর মৃত্যুর পর (তত দিনে সুচিত্রার নিজেরও সাত বছর হল দেখা নেই) তুলনাটা দানা বাঁধে।
লোকচক্ষু থেকে হারিয়ে যাওয়াটাই কিন্তু গার্বো-সুচিত্রার একমাত্র সাদৃশ্য নয়। মাত্র কুড়ি বছরে চৌত্রিশটা ছবি (আট সুইডিশ, ছাব্বিশ ইংরেজি) করে গার্বো যে-কুহকিনী ভাবমূর্তি ও ডিভা স্টেটাস তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজের, সুচিত্রাও অনুরূপ এক প্রভাব ও মায়া সঞ্চার করেছিলেন তাঁর পঁচিশ বছরের নায়িকাজীবনে তিপ্পান্নটি বাংলা ও সাতটি হিন্দি ছবি করে।
সুচিত্রাই কি বাংলা ছবির প্রথম ও শেষ ডিভা? হয়তো। আবার ‘হয়তো’ কেন? নিশ্চিতই। উত্তমকুমারের চেয়েও যাঁর স্টার বিলিং এগিয়ে থাকত, বেড়ে থাকত পারিশ্রমিক, স্টুডিয়ো ফ্লোর তটস্থ থাকত যাঁর মেজাজমর্জি, খেয়ালের ব্যাপারে, প্রযোজকরা সন্ত্রস্ত, তিনি কিন্তু ওই গার্বোর মতোই হিটের পর হিট দিয়ে (বাহান্নতম বাংলা ছবি ‘দত্তা’-ও তেইশ সপ্তাহ চলে বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ জুগিয়েছে) কেরিয়ারের শেষ অবধি নিজের জায়গা কায়েম রেখে গেছেন।
কায়েম তো রেখেছিলেনই, কিন্তু আরও বেশি করে যেটা ভাবায় তা হল কী ভাবে? প্রযোজক ধরে ছবিতে নেমে নয়, ছবি প্রযোজনা করেও নয়, প্রচারমাধ্যমকে কাজে লাগিয়েও নয়। ওঁর সেরা সময়ের দশটা বছরের ছবিগুলোর নাম পর পর সাজিয়ে দিচ্ছি, দেখুন গায়ে কাঁটা দেয় কি না, অবিশ্বাস্য ঠেকে কি না। নিন… ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হল দেরি’, ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘চাওয়াপাওয়া’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘হসপিটাল’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সপ্তপদী’, ‘বিপাশা’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘উত্তরফাল্গুনী’, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ ও ‘গৃহদাহ’।
১৯৫৭-৬৭ অবধি এ এক অবিরাম হিটযাত্রা যা গ্ল্যামারাস সুচিত্রাকে একটু একটু করে অভিনেত্রী ও ডিভা করে তুলেছে। এর অধিকাংশই তো নায়িকাপ্রধান ছবি নয়, উত্তমকুমারের মতো নায়কের সঙ্গে প্রাধান্য ভাগ করে নিতে হয়েছে (কখনও অশোককুমার, সৌমিত্র, বসন্ত ও বিকাশ), কিন্তু সব ছবিতেই সুচিত্রা আছেন সুচিত্রাতেই। মানে উপস্থিতি, মানে তীব্র আকর্ষণ, স্ক্রিনজোড়া লাবণ্য এবং কখনও কখনও চমকে দেবার মতো অভিনয়। মনে করুন ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘উত্তরফাল্গুনী’ বা ‘চন্দ্রনাথ’। যা বাঙালি দর্শককের মনের ব্যথা ও চোখের জলের সঙ্গে মিশে আছে এতকাল।
পর্দায় উপস্থিতিটাও যে অভিনয়ের এক মস্ত অঙ্গ তা সুচিত্রার মতো আর কোনও অভিনেত্রী প্রমাণ করতে পেরেছেন কি না জানি না, শুধু গ্ল্যামার দিয়ে এ কাজ সেরে ফেলা যায় বলেও মনে হয় না। গ্রেটা গার্বোর মৃত্যুতে অনন্যা অভিনেত্রী বেটি ডেভিস যেটা বলেছিলেন তা সুচিত্রা সম্পর্কে বললেও বলা যেতে পারে: “হার ইন্সটিংক্ট, হার মাস্টারি ওভার দ্য মেশিন ওয়জ পিওর উইচক্র্যাফট।” ওঁর প্রবৃত্তি মেশিনের ওপর ওঁর কতৃত্ব ছিল বিশুদ্ধ ডাকিনীবিদ্যা।
সুচিত্রা গ্ল্যামারসর্বস্ব ও অভিনয়ে শিথিল এমন একটা প্রচার তাঁর সমকালীন ও ঈষৎ পরবর্তী কালের অভিনেত্রীরা জারি রেখেছিলেন। সেটা কতখানি ঈর্ষাপ্রসূত আর কতটা ন্যায্য বিচার তা সুচিত্রার ছবিগুলো চালিয়ে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রথম দিককার ছবিতে তিনি বেজায় আড়ষ্ট, কিন্তু তার কারণ ঠাওরানো খুব কঠিন কাজ নয়। পাবনার মেয়ে বিয়ে হয়ে কলকাতায় এসেছেন, আকাঙ্ক্ষা যদি কিছু থেকে থাকে তো সেটা গানের রেকর্ড করার। গানের গলাটা ছিল মিষ্টি এবং ঝোঁক ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি। কিন্তু বিধি অন্য রকমটি ভেবেছিলেন।
স্বামী দিবানাথ সেনের উচ্চাভিলাষই (হয়তো রূপসী বৌয়ের মধ্যে আগামী নক্ষত্র দেখেছিলেন!) কারণ হল, রমা সেনের সিনেমায় নামার। ওজরআপত্তি কম করেননি রমা, কিন্তু তত দিনে ওঁর হয়ে অ্যাক্টিঙের অ্যাডভান্সও নেওয়া হয়ে গেছে উদ্যোগী স্বামীর। ফলে একদিন রাশভারী শ্বশুর আদিনাথ সেনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল রমাকে পারমিশন জোগাড়ের জন্য। ফলে যাকে বলে একজন রিলাকট্যান্ট অ্যাকট্রেস, সে রকম এক অনিচ্ছুক শিল্পী হিসেবে ওর টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় প্রবেশ। দ্বিতীয় ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ সাফল্যের মাপজোক হয় না, কিন্তু সে সাফল্যের কিছুই প্রায় বর্তায় না সুচিত্রায়। কিন্তু চতুর্থ ছবি ‘ভগবান শ্রীচৈতন্য’-য় রূপের সঙ্গে এক মরমিয়া উপস্থিতি জুড়তে শুরু করে দিয়েছেন সুচিত্রা। হয়তো ওইখানেই আমরা প্রথম আভাস পাই পরবর্তী কালের ‘চন্দ্রনাথ’ ও ‘কমললতা’র সুচিত্রার। প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’ থেকে শেষ ছবি পর্যন্ত সুচিত্রা যে ক্রমান্বয়ে সিনেমার রোল ধরে ধরে নিজেকে শুধরেেছেন ও গড়েছেন, তা চোখে না পড়ে যায় না। তাতে কতটা কী পেরেছেন, না পেরেছেন তা নিয়ে তর্ক চলতেই থাকবে।
তবে মনের মতো ছবি ধরে ধরে যে তিনি এগোতে পেরেছেন, সেটা সম্ভব হয়েছিল তিনি নিজের পছন্দের এবং নিজের শর্তে কাজ করতে পেরেছিলেন বলেই। কত ছবির কাজ যে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছলেন, তা নিয়েও একটা গল্প তৈরি হয়ে যায়। অজস্র কাজের অফার এলেও সে সব স্ক্রিনিং করার জন্য কোনও সেক্রেটারি রাখেননি। তরুণকুমারকে বলেছিলেন যে প্রতিদিন সেক্রেটারির সঙ্গে এক-দেড় ঘণ্টা পরামর্শ চালানো বড় সমস্যা। তবে আসল কারণ হয়তো এই যে তিনি কাহিনি ও কাজ নিজেই সরাসরি বুঝে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
ছবির কাহিনি, প্রযোজক ইত্যাদি বাছাইয়ের ধরনে সুচিত্রা একটা একক ঘরানা তৈরি করেছিলেন বাংলায়। খুবই মেজাজি, হয়তো বদমেজাজিও কিন্তু কোনও মতেই খামখেয়ালি নন। ‘আঁধি’র শু্যটিঙের সময় মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ওঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, “সব সময় মাথা উঁচু করে কাজ করবে।”
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজের অফারও ফিরিয়েছেন সুচিত্রা। সত্যজিৎ ওঁর ‘দেবী চৌধুরাণী’ ছবির জন্য টানা ডেট চেয়েছিলেন নায়িকার। কিন্তু তা করতে হলে আরও ক’জন প্রযোজকের থেকে ডেট ফেরত নিতে হত। সুচিত্রা সেটা করতে চাননি। ফলে ‘দেবী চৌধুরাণী’ আর হয়নি। এই আক্ষেপ আজ অনেকেরই। আবার সেই সঙ্গে আরেক আক্ষেপও প্রায়ই শোনা যায়: ‘হায়, নায়ক-নায়িকার এই আভিজাত্য আর কি কখনও ফিরবে না?”
ফাংশানে ফাংশানে ফিতে কেটে লম্ফ জ্বেলে খবরে ওঠার দিকে কোনও দিনই ছিলেন না সুচিত্রা। স্টুডিয়ো ফ্লোর ও তার বাইরের জীবনের মধ্যে স্পষ্ট একটা দূরত্ব রক্ষা করতেন। এই বাইরের জীবনটার আবার অনেকখানি জুড়ে থাকত তাঁর পারিবারিক জীবন। যে-জীবনের কোনও প্রচারও তিনি চাইতেন না। এক আত্মীয় ফোটোগ্রাফার ধীরেন দেব ছাড়া ওঁর খোলা মেজাজের ছবিও খুব বেশি কারও নেই। জীবনের একেবারে শেষ দিকে তিনি যে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন, সিনেমা ও সমাজ থেকে, তার প্রস্তুতি-পর্ব কিন্তু খুব কম দিনের নয়।
আজকের সিনেমা জগৎ মানেই তো শিল্পীদের সাক্ষাৎকার, সাক্ষাৎকার আর সাক্ষাৎকার। বলতে গেলে নেই কথার সাক্ষাৎকার। পঁচিশ বছরের ফিল্ম কেরিয়ার ও তারও পাঁচ বছর পর অবধি (অর্থাৎ অন্তরালবর্তিনী হওয়ার আগে) ক’টা সাক্ষাৎকার পাওয়া যায় সুচিত্রার?
বলা মুশকিল। ওঁর কথা হিসেবে যা মাঝে মধ্যে ছেপে বেরোত, তা ক্ষমাঘেন্না করে ছেড়ে দিতেন। বলতেন, ওঁদেরও তো কিছু করে খেতে হবে।
তাতে ফল হয়েছে এই, সুচিত্রা নিয়ে বৃত্তান্তের শেষ নেই। হয়তো এই কারণেই গল্পে গল্পে পাওয়া রহস্যে রহস্যে ওঁকে নিয়ে মানুষের কল্পনার উড়ানও স্তর-পরম্পরায় ঊর্ধ্বগামী। ফলে তুলনাটা ফের এসে যায় গার্বোর সঙ্গে। যাঁর মৃত্যুতে ‘ডেলি নিউজ’ পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল, “হারস্ ওয়জ্ আ মিথ মেড বাই মেশিন, বাট ম্যানস্ ইমেজিনেশন টুক ইট ফ্রম দেয়ার টু ডিজিং হাইটস্।” মেশিন তৈরি করেছিল ওর কিংবদন্তি। কিন্তু মানুষের কল্পনাই সেটিকে উর্ধ্ব থেকে উর্ধ্বলোকে বয়ে নিয়ে গেছে।
সবে তো এক বছর হল, দিনে দিনে সব কাহিনি, সব স্মৃতিচারণা, সব বলাও শোনা যখন হয়ে পড়বে, তখন হয়তো সুচিত্রার সেরা ছবিটা আরও স্পষ্ট হবে। যে ছবি ওর সব সেরা ছবির স্থির চিত্রের মতো নীরব-মুখর, ওর উত্তরাধিকার। এই চিন্তাটা আসাতে, আরেকটি মর্মপীড়া থেকে উদ্ধার পেলাম। ১৯৮৯-৯০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রস্তাব ছিল, ওঁর কন্যা মুনমুনকে সঙ্গে নিয়ে সুচিত্রার স্মৃতিকথা রেকর্ড করে লেখার। মুনমুন বারকয়েক সেই প্রস্তাব মা’র কাছে রাখেন। বারবারই এক উত্তর: “কী হবে? ছেড়ে দাও।”
কল্পনার কাছে যেখানে সত্য ও যুক্তি হার মেনেছে, তিনি সেখানেই রয়ে গেলেন।… কারণ বাঙালির কাছে তিনি তো শুধু সত্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন কল্পনা ও সত্যের সঠিক মেলবন্ধন। বঙ্গহৃদয়ের স্বপ্ন হিসেবে তাঁর স্থান আর কেউ নিতে পারবে না।
● শ্রীমতী সুচিত্রা সেন অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকা-১) শেষ কোথায় (১৯৫২)। মুক্তি পায় নি।২) সাত নম্বর খেয়াড়ি (১৯৫৩)। মুক্তি পায় নি।৩) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য (১৯৫৩)। মুক্তি পায় নি।৪) সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)৫) কাজরি (১৯৫৩)। ৬) সদান্দের মেলা (১৯৫৪)।৭) ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪)।৮) গৃহপ্রবেশ (১৯৫৪)।৯) এটম বোম (১৯৫৪)।১০) ঢুলি (১৯৫৪)।১১) মরণের পারে (১৯৫৪)।১২) বলয় গ্রাস (১৯৫৪)।১৩) অন্নপূর্ণার মন্দির (১৯৫৪)।১৪) অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪)।১৫) সাঁঝের প্রদীপ (১৯৫৪)।১৬) দেবদাস (১৯৫৫)।১৭) শাপমোচন (১৯৫৫)।১৮) সবার উপরে (১৯৫৫)।১৯) সাজঘর (১৯৫৫)।২০) মেজো বৌ (১৯৫৫)।২১) ভালোবাসা (১৯৫৫)।২২) সাগরিকা (১৯৫৬)।২৩) ত্রিযামা (১৯৫৬)।২৪) আমার বৌ (১৯৫৬)।২৫) শিল্পী (১৯৫৬)।২৬) একটি রাত (১৯৫৬)।২৭) শুভরাত্রি (১৯৫৬)।২৮) হারানো সুর (১৯৫৭)।২৯) পথে হল দেরি (১৯৫৭)।৩০) জীবনতৃষ্ণা (১৯৫৭)।৩১) চন্দ্রনাথ (১৯৫৭)।৩২) মুসাফির (১৯৫৭) (হিন্দি)।৩৩) চম্পাকলি (১৯৫৭) (হিন্দি)।৩৪) রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮)।৩৫) সূর্য তোরণ (১৯৫৮)।৩৬) ইন্দ্রাণী (১৯৫৮)।৩৭) দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯)।৩৮) চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯)।৩৯) হসপিটাল (১৯৬০)।৪০) স্মৃতিটুকু থাক (১৯৬০)।৪১) বোম্বাই কা বাবু (১৯৬০) (হিন্দি)।৪২) সারহাত (১৯৬০) (হিন্দি)।৪৩) সপ্তপদী (১৯৬১)।৪৪) সাথীহারা (১৯৬১)।৪৫) বিপাশা (১৯৬২)।৪৬) সাত-পাকে বাঁধা (১৯৬৩) (এই ছবির জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন)।৪৭) উত্তর ৪৮) ফাল্গুনী(১৯৬৩) (১৯৬৬ সালে হিন্দিতে পুনঃনির্মিত হয়েছে মমতা নামে)।৪৮) সন্ধ্যাদীপের শিখা(১৯৬৪)।৪৯) গৃহদাহ (১৯৬৭)।৫০) কমললতা (১৯৬৯)। ৫১) মেঘকালো (১৯৭০)। ৫২) ফরিয়াদ (১৯৭১)। ৫৩) নবরাগ (১৯৭১)।৫৪) আলো আমার আলো (১৯৭২)।৫৫) হারমানা হার (১৯৭২)।৫৬) দেবী চৌধুরানী (১৯৭৪)।৫৭) শ্রাবণ সন্ধ্যায় (১৯৭৪)।৫৮) প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫)।৫৯) আঁধি (১৯৭৫) (হিন্দি)।৬০) দত্তা (১৯৭৬)।৬১) প্রণয় পাশা (১৯৭৮)।
বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে এখনো শ্রেষ্ঠ জুটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একসময় কলকাতার চলচ্চিত্র পাড়ায় উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছাড়া সে সময় কোনো ছবি ‘হিট’ হবে, এটা ভাবা নির্মাতারা ভাবতে পারতেন না। এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করে, চলচ্চিত্রের মতো বাস্তবেও হয়তো তারা একই সম্পর্ক ধারণ করেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে একটি পোস্টার ঝড় তোলে উত্তম-সুচিত্রার সংসার জীবনে। সুচিত্রার সই দেয়া ওই পোস্টারে লেখা ছিল ‘আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নিপরীক্ষা’। ভারতীয় পত্রিকাগুলোর খবর, সেই পোস্টার দেখে উত্তম কুমারের স্ত্রী গৌরিদেবী ভেঙে পড়েন। অন্যদিকে সুচিত্রাকেও সন্দেহ করতে শুরু করেন স্বামী দিবানাথ এবং অভিনয় ছেড়ে দিতেও চাপ দেন। কিন্তু অন্তত ১০টি ছবিতে এই জুটি চুক্তিবদ্ধ ছিলেন বলে, অভিনয় ছাড়া সম্ভব হয় নি। ১৯৫৭ সালে উত্তম কুমার তাঁর প্রযোজিত ‘হারানো সুর’ ছবিতে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিলে সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য সব ছবির ডেট ক্যান্সেল করব।” একদিন সুচিত্রা সেনের বালিগঞ্জের বাসায় এক পার্টিতে দিবানাথের আক্রমণের মুখেও পড়তে হয় উত্তমকে। এরপর থেকেই দিবানাথের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে সুচিত্রার। এক সময় শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার নিউ আলিপুরে। তাঁর অভিনীত ৬১ ছবির মধ্যে ৩১টি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে।
● পুরস্কার ও সম্মাননা:১) ১৯৬৩ সাল- তৃতীয় মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। চলচ্চিত্র- সপ্তপদী।২) ১৯৬৬ সাল- ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার। চলচ্চিত্র- মমতা।৩) ১৯৭২ সাল- পদ্মশ্রী। ভারত সরকার। চলচ্চিত্র শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য৪) ১৯৭৬ সাল- ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার। চলচ্চিত্র- আঁধি।৫) ২০১২ সাল- বঙ্গবিভূষণ সন্মান। পশ্চিমবঙ্গ সরকার। চলচ্চিত্রে সারা জীবনের অবদানের জন্য।
(তথ্যসূত্র:
১- সম্পূর্ণ সুচিত্রা, আনন্দলোক সংকলন, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৭)।
২- দীপ জ্বেলে যাই-অজানা অচেনা সুচিত্রা সেন, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড (২০১৬)।
৩- Suchitra Sen The Legend and the Enigma, Shoma Chatterji, Harpercollins publishers (২০১৫)।
৪- সুচিত্রা সেন (উত্তরণ ও অন্তরাল), রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, গাঙচিল (২০০৯)।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ই মার্চ ২০১৭ সাল।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭শে মার্চ ২০১৬ সাল।
৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ই জানুয়ারি ২০১৫ সাল।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে জানুয়ারি ২০১৪ সাল।
৯- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ই এপ্রিল ২০১৪ সাল।
১০- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ই জানুয়ারি ২০১৪ সাল।
১১- উইকিপিডিয়া।
১২- বাংলাপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত