‘অভিযান’ দেখতে গিয়েছেন সত্যজিতের অনুরোধে। মাঝপথেই উঠে পড়লেন। প্রকাশ্যেই সত্যজিৎকে গালিগালাজ করতে শুরু করলেন। কেন মেজাজ হারিয়েছিলেন? মদ্যপান করে একদিন তুষার তালুকদারকে বলেছিলেন তার উত্তর, ‘‘মৃণাল ছবিটি দেখে এসে বলল, ঋত্বিক ছবিটি দেখে এসো। তুমি দেখবে মানিকবাবু বহু জায়গায় অযান্ত্রিক-এর প্রায় হুবহু কপি করেছেন। আমি ইন্দিরাতে ছবিটি দেখতে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই! অসংখ্য ফ্রেম এক্কেবারে হুবহু এক। মাঝপথে খেপে গিয়ে উঠে পড়লাম। কারণ আমার মনে হল, ছবিটা কিছুই দাঁড়ায়নি।’’ অথচ, নিজের ‘অযান্ত্রিক’ রিলিজ হওয়ার পর তার বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত সত্যজিৎ রায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন! যখন সত্যজিতের ‘অশনি সঙ্কেত’ রিলিজ করল, তখনও!
ঋত্বিক হাসপাতালে। ঠিক করলেন উৎপল দত্তর ‘ব্যারিকেড’ দেখতে যাবেন। হঠাৎ করেই মত বদলে দেখলেন ‘অশনি সঙ্কেত।’ সেবারও হল থেকে বেরিয়ে হতাশ! বললেন, ‘‘অশনি সঙ্কট দেখিয়ে কেন আমার মতো অসুস্থ লোককে আরও সঙ্কটে ফেললে। মানিকবাবু চূড়ান্ত ধেড়িয়েছেন। শেষ দৃশ্যটা মনে করো, সেখানে মন্বন্তরের কোপে পড়া হাজার হাজার ভুখা মানুষের মিছিল দিয়ে ছবি শেষ হয়েছে, তাই তো?’’ ঋত্বিক মনে করতেন, গল্পের মতোই শেষটা হওয়া দরকার ছিল।বলেছিলেন, ‘‘মৃত্যুর মিছিল নয়, নতুন জীবনের সৃষ্টি। এইটাই শেষ কথা।’’ নিজেও সব ছবির শেষে তেমন ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন।
এর মানে এই নয়, মানিকের সঙ্গে ঝগড়া ছিল ঋত্বিকের। ৬৫-তে সত্যজিতের সুপারিশেই তাঁর পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে কাজ হয়। শোনা যেত, সারা কলকাতা ঘুরে ঋত্বিক লেক রোডে সত্যজিতের বাড়ি দেখিয়ে দিতেন ট্যাক্সিওয়ালাকে। আর বাইরে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতেন। ড্রাইভারকে কেবল জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘কত?’’ সত্যজিৎ মিটিয়ে দিতেন বিল! জানলায় এসে দাঁড়াবেন চিরচেনা সওয়ারিকে দেখতে, ততক্ষণে ঢোলা পঞ্জাবি, কাঁধে ব্যাগ ভবা হাওয়া! স্মৃতি থেকে সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, ঋত্বিকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই চিনতেন। সেটা ‘ছিন্নমূল’ ছবির সুবাদে। ফিল্ম সোসাইটির একটা মিটিং-এ প্রথম আলাপ হয়। স্মৃতি থেকে তিনি বলছেন, ‘‘সে সময় বোম্বেতে বিমল রায়ের সঙ্গে কাজ করছে, বিমল রায়ের ছবির চিত্রনাট্য লিখছে। তার কিছু আগে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে, সে ছবি দেখেছে এবং দেখে তাঁর খুবই বেশিরকম ভালো লেগেছিল। সে-কথা সে প্রাণ খুলে আমার কাছে বলে। কিন্তু আমার কাছে যে-জিনিসটি সব চাইতে ভালো লেগেছিল সেটা সে যে ভাবে ছবিটাকে বিশ্লেষণ করেছিল, তার কয়েকটা দৃশ্যকে, সেটা থেকে আমার মনে হয়েছিল, ঋত্বিক যদি ছবি করে তাহলে সে খুব ভালোই ছবি করবে।’’
সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ দেখে কয়েকটি দৃশ্যের সমালোচনাও করেছিলেন ঋত্বিক। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘‘দুর্গা মারা যাওয়ার আগের ঝড়বৃষ্টির দৃশ্য, সেটা বেশ কাঁচা। দুর্গার মৃত্যুর খবরে হরিহর বা সর্বজয়ার প্রতিক্রিয়াও ঠিকমতো ফোটেনি।’’ তুষার তালুকদারকে তার কারণ বলতে গিয়ে ঋত্বিক বলছেন, ‘‘অভিনয়ের দুর্বলতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে দক্ষিণা ঠাকুরের তারসানাইয়ের সুর।’’
সত্যজিৎ তাঁকে নিয়ে বলতে গিয়ে বলছেন, ‘‘আমরা যারা প্রায় গত চল্লিশ বছর ধরে ছবি দেখছি, তাদের মধ্যে তো প্রায় ত্রিশটা বছর কেটেছে হলিউডের ছবি দেখে, কেন-না কলকাতায় তার বাইরে কিছু দেখবার সুযোগ ছিল না সে সময়টা। উনিশো ত্রিশ বা পঁচিশ থেকে শুরু করে প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বা ষাট অবধি আমরা হলিউডের বাইরে খুব বেশি ছবি দেখতে পারিনি।… কিন্তু ঋত্বিক এক রহস্যময় কারণে সম্পূর্ণ সে-প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল, তাঁর মধ্যে হলিউডের কোনও ছাপ নেই। … ঋত্বিক মনে-প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল, আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তাঁর বড়ো পরিচয় এবং সেইটেই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষণীয় বৈশিষ্ট।’’
ঋত্বিকের স্মরণসভায় সভাপতি ছিলেন সত্যজিৎ রায়।শোকসন্তপ্ত সরলা মেমোরিয়াল হল। মঞ্চে মৃণাল সেন, বিজন ভট্টাচার্য। ছিলেন কবি পূর্ণেন্দুও। লিখছেন, ‘‘সভাপতি শেষ করলেন তাঁর ভাষণ। দর্শক বা শ্রোতা নিস্পন্দ। এ বার তিনি পাঠ করবেন একটি শোকপ্রস্তাব। পাঞ্জাবির পকেট ঘাঁটছেন চশমার জন্যে। তখন চোখে পড়ল, তাঁর চোখের প্রান্তে একবিন্দু গোপন অশ্রু!’’
ঋত্বিক ঘটক – সত্যজিৎ রায় – মৃণাল সেন … বলা চলে বাংলা চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা – বিষ্ণু – মহেশ্বর। একই বৃত্তে কর্মরত ছিলেন তিনজন। ছিল আলোচনা ও সমালোচনা। ছিল বৈরিতা। তা সত্বেও ছিল বন্ধুত্ব।
মৃণাল সেন থেকে দুই বছরের বড় ছিলেন শ্রী সত্যজিৎ রায় (১৯২১ – ১৯৯২), আর ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫ – ১৯৭৬) ছিলেন আড়াই বছরের ছোট। একজনকে সম্মান করতেন, অন্যজন ছিলেন বন্ধু। কিন্তু দুজনের সঙ্গেই ছিলো সম্পর্ক। চলচ্চিত্রের সূত্রে। দুজনের সঙ্গেই চলতো বাহাস। ছবি নিয়ে। ছবির ভাষা নিয়ে। তবে ঋত্বিক বন্ধু বলে ওর সঙ্গে ঝগড়াঝাটিও হতো। আরো হতো রাজনৈতিক আলাপ। পরিকল্পনা হতো কি করে তাঁরা লুকিয়ে কাকদ্বীপে চলে যাবেন; তারপর সেখানে পুলিশের নজর এড়িয়ে, গেরিলা কায়দায় ১৬ মিলিমিটারে চলচ্চিত্র বানাবেন। এরপর তাঁরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেই ছবি দেখাবেন। সত্যজিতের সঙ্গে অবশ্য সেসব আলাপ জমতো না। সত্যজিৎ এমনিতেই ছিলেন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানুষ।
মহৎ শিল্পীর ক্ষেত্রে প্রশস্তির পাশাপাশি প্রশ্ন থাকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ঋত্বিক ঘটকের নাম। বিভূতিভূষণের উপন্যাস থেকে সত্যজিতের করা চলচ্চিত্রত্রয়ী নিয়ে প্রশ্ন ছিলো ঋত্বিকেরও। ঋত্বিক নিজেও একজন মহৎ শিল্পী। তিনি চেয়েছিলেন সত্যজিতের অপু বিভূতিভূষণের ছক মেনে গ্রামেই ফিরে যাক, কিন্তু সত্যজিতের অপু গ্রামে ফিরে যায়নি, কলকাতামুখী হয়েছে। মৃণাল এখানে ঋত্বিকের সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘ঋত্বিক সম্ভবত সত্যজিতের নাগরিক মননটুকু তেমনভাবে ধরতে পারেননি, পারলে বোধ হয় মানিকবাবুর ছবিতে অপুর বদলটা মেনে নিতে পারতেন।’ এই জায়গায় ঋত্বিকের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, মৃণাল যদি ঋত্বিকের শেকড়ে ফিরে যাওয়ার মননটা ধরতে পারতেন, তাহলে হয় তো ওপরের বাক্যগুলো ভিন্নভাবে বলতেন।
বয়সে মৃণালের ছোট হলেও বন্ধু ছিলেন ঋত্বিক। যথেষ্ট সম্মান করতেন মৃণাল, ভালোও বাসতেন। কারণ তিনি জানতেন গণমানুষের কাছে গণমানুষের শিল্পকে পৌঁছে দিতে ঋত্বিক ছিলেন ‘দুঃসাহসী’ ও সবচেয়ে ‘বেপরোয়া’। সিনেমাকে বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে চলতে শিখেছিলেন ঋত্বিক। মৃণালও। বলছেন, ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অচঞ্চল বিশ্বাস রেখে সে দিন থেকেই আমরা অন্তঃস্বারশূণ্য দেশজ সিনেমাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখেছিলাম, নতুন একটা ফ্রন্ট গড়ার জন্য মুখিয়ে উঠেছিলাম প্যারাডাইস কাফের ভাঙা চেয়ার-টেবিলে ঠাসা ঐ ছোট্ট ঘরে, যে ফ্রন্টে বিপ্লব আর সিনেমা হাত ধরাধরি করে চলবে। এই প্রাণচঞ্চল আসরগুলোয় যার গলা সবচেয়ে উঁচু পর্দায় বাঁধা ছিল সে হল ঋত্বিক। ঋত্বিক ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া। কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করত না ঋত্বিক, আগু পিছু ভাবার মতো ধৈর্য ছিল না।’
তারা ঠিক করলেন স্টুডিয়োর অস্বচ্ছল কর্মী ও কলাকুশলীদের নিয়ে একটি সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলবেন। কর্মীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, তাদের সাথে কলা বলা ও বোঝানো, রাজনৈতিক এই অভিযানেও ঋত্বিক ছিলেন প্রথম কাতারে। গণআন্দোলনের জোয়ারে পশ্চিমবঙ্গ যখন ফুসছে, তখনও ঋত্বিক ও মৃণালরা কিছু করার জন্য টগবগ করে ফুটছেন। জনতার সংগ্রামের পাশাপাশি তখন কৃষক-মজদুর-মধ্যবিত্তের লড়াই থামাতে মরিয়া শাসকগোষ্ঠী। কাকদ্বীপ এলাকায় গুলি চালিয়েছে পুলিশ। মারা যায় কৃষকরমণী গর্ভবতী অহল্যা। মৃণাল ও ঋত্বিকদেরই আরেক সহযোদ্ধা সলিল চৌধুরী তখন রচনা করেছিলেন কালজয়ী কবিতা ‘শপথ’। শপথ ঠিকই নিয়েছিলেন তাঁরা। ঠিক করেছিলেন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁরা কাকদ্বীপে যাবেন। সেখানে গিয়ে ষোল মিলিমিটারে নির্বাক ছবি তুলবেন। এরপর কলকাতায় ফিরে ছবি ধোলাই ও সম্পাদনা করে গ্রামে গ্রামে সেই ছবি দেখাবেন, লুকিয়ে লুকিয়ে। চিত্রনাট্য লিখলেন মৃণাল। সলিল নাম দিলেন ‘জমির লড়াই’। আর ঋত্বিক জোগাড় করলেন একটি ভাঙা ক্যামেরা। শেষ পর্যন্ত কাকদ্বীপে যাওয়া হয়নি ঠিকই। জোগাড় করা ক্যামেরাটি চালানো শিখে নিয়েছিলেন ঋত্বিক। জানতেন এই ক্যামেরাই হবে তাঁর হাতিয়ার। সিনেমা ও বিপ্লবের সহচর ঋত্বিকের সঙ্গে প্রচুর ঝগড়াও করেছেন মৃণাল। বলছেন, ‘ঝগড়া করেছি, মতান্তর ঘটেছে, মনান্তর ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে এক এক সময়ে, আবার সময় আর ঘটনার মধ্য দিয়ে মিশে গিয়েছি আগের মতোই, এক সঙ্গে চলেছি।’
ঋত্বিকের প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ দেখে খুশি হতে পারেননি মৃণাল। কিন্তু দ্বিতীয় ছবি ‘অযান্ত্রিক’ ভীষণ ভালো লাগে তাঁর, প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘একটি অসাধারণ ছবি এবং ভীষণ ভাল ও মৌলিক ছবি। সম্ভবত তাঁর ছোট্ট জীবনে তুলনারহিত। এ-ছবির কাহিনী একটি ভাঙা মোটরগাড়ি এবং এ-মোটরগাড়ির সঙ্গে এক রাগী ড্রাইভারের ভালবাসা-যন্ত্রণার কাহিনী। সবকিছু বলা হয়েছে ভারী সুন্দরভাবে, নিটোলভাবে। এই গাড়িটিতে বসে কিছু যাত্রী যখন নিজের নিজের কাহিনী বলছে ঋত্বিকের ক্যামেরা এদের কথা, এদের মুখ অবয়ব ছুঁয়ে ছুঁয়ে অন্য আর-একটি গল্প বলে দেয়, যে গল্পে আদিবাসীদের পালাপার্বনের কথা বলা হয়। এরা সবাই খুব শক্তিশালী কিন্তু এদের ভেতরে একটা সহজাত বেপরোয়া মনোভাব কাজ করে। হয়তো ঋত্বিক নিজের ভেতর নিজেই লড়াই করত। বেপরোয়া ভাবটা তাঁর চরিত্রের মধ্যেও ছিল, যে জন্য এ-ছবিটিতে সেটিও ফুটে উঠেছে। যাই হোক, দর্শককুল ছবিটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন, এমনকী কেউ কেউ বললেন—ছবিটি সত্যজিতের যে কোনও ছবির চাইতেও উচ্চমানের ছবি।’
মৃণালের ছবি নিয়ে ঋত্বিকের প্রতিক্রিয়ার কথাও আমরা জানতে পারি মৃণালেরই বয়ানে। ১৯৭৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি সকাল সকাল উপস্থিত হন মৃণালের বাড়ি। অসুস্থ ছিলেন ভীষণ। মৃণালের স্ত্রী গীতা ঋত্বিককে দেখে চমকে ওঠেন। একদম রোগা হয়ে গেছেন। গীতাকে ঋত্বিক বললেন, ‘আর মদ খাবো না’। একটু পর আবারো বললেন, ‘আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না’। গীতা বললেন, ‘মদ না ছাড়লে কী করে বাঁচবেন আপনি?’ উদাস দৃষ্টিতে ঋত্বিক পুনরাবৃত্তি করেছিলেন, ‘আমি আর মদ খাবো না’। এরপর হুট করেই বললেন, ‘গীতা, মৃণাল খুব ভালমানুষ। কিন্তু ওর ‘ভুবন সোম’, ফুঃ!’
ঋত্বিক এমনই ছিলেন। মৃণাল জানতেন তিনি ছিলেন মহৎ শিল্পী। সব সময়েই ‘নিজের ছবিতে মহৎ সত্যকে খুঁজে বার করতে সচেষ্ট’ থাকতেন তিনি। মৃণাল লিখছেন, ‘ঋত্বিক বলত, আমি সেই ভাষার কথা খুঁজি যে ভাষায় কথা কম, যে ভাষা জানায় বোঝায়, এবং এমন এক পরিবেশে পৌঁছে দেয় যা ‘আর্কিটাইপাল ইমেজ’ হিসেবে পরিচিত।’ এই প্রতিমা ঘুরেফিরে এসেছে ঋত্বিকের ছবিতে। নিজেও যে দ্রুত প্রতীমায় পরিণত হবেন, রক্তমাংসের মানুষ থাকবেন না,সেটা যেন আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন ঋত্বিক। সেজন্যই মৃণালের বাসায় গিয়ে সেদিন বলেছিলেন, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না।
মৃণালের গৃহে মৃত্যুর কথা উচ্চারণের দেড় মাস পর, ১৯৭৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি মারা যান ঋত্বিক। অন্তিমশয়নে পাশেই ছিলেন মৃণাল। ঋত্বিক তাঁকে দেখতে পাননি। রাত এগারোটা পাঁচে সমাপ্তি ঘটে ঋত্বিক অধ্যায়ের। মৃণাল বলছেন, ‘বোধহয় মরে গিয়ে ঋত্বিক বেঁচে গেল। মৃত্যুর কয়েকবছর আগের সময়গুলো ছিল ভয়ংকর। অবাধ্য ঋত্বিক, হৃদয়হীন ঋত্বিক, শৃঙ্খলাহীন ঋত্বিক আবার সবার ওপরে সম্মাননীয় ঋত্বিক! এখনও সেভাবেই বেঁচে আছে।’
এভাবেই বেঁচে আছেন ঋত্বিক। ‘দামাল ঋত্বিক, বেপরোয়া ঋত্বিক, অসহিষ্ণু ঋত্বিক, বিশৃঙ্খল ঋত্বিক’।
একই ভাবে ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে সত্যজিৎ বলেছিলেন, “ঋত্বিক মনে-প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল– আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং সেইটেই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য।”
৯ই আগস্ট ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় ঋত্বিক ঘটকের স্মরণে কবি, লেখক, পরিচালক ও সংগীতকার গুলজার লিখেছিলেন,
“দে খলেই মনে হবে এক জন গ্রিক মাস্টার সামনে দাঁড়িয়ে। খুব লম্বা, উসকোখুসকো চুল, পাঞ্জাবির ওপর বোতাম-খোলা খাদির জ্যাকেট, কাঁধে একটা ঝোলা, আর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ— যেন এই বার অলৌকিক কোনও আখ্যান শুরু হবে।
ঋত্বিকদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা বিমলদা মারফত। ঋত্বিকদার বড়দাদা আবার ছিলেন বিমলদার প্রোডাকশন হেড। এক দিন আমায় ডেকে বললেন, ‘শোনো, তুমি ওঁর কাছ থেকে গল্পটা শুনে লিখে নাও আর নোট্স নিয়ে নাও। পরে এটার ওপর একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে।’ আমি আর ঋত্বিকদা বসে গেলাম। এর পর এই রকম বসা বহু বার হয়েছে, কিন্তু তা থেকে কোনও দিন কোনও সিনেমা তৈরি হয়নি। পরে জেনেছিলাম, কোনও বাঙালির প্রয়োজনে বিমলদা তাঁকে খালি হাতে ফেরান না। কিন্তু ঋত্বিকদাকে কোনও কাজ ছাড়া সাহায্য করাটা যে ঋত্বিকদার সম্মানে এবং মনে বড় লাগবে, সে কথা বিমলদার মাথায় থাকত। তাই দু’পক্ষের মন ও সম্মানের আশ্চর্য দেওয়া-নেওয়ার সাক্ষী হয়েছিলাম আমি।
এর পর অবশ্য মাইডিয়ার হিসেবে ঋত্বিকদাকে চিনতে আরম্ভ করি অভীদা, মানে অভিনেতা অভী ভট্টাচার্যের বাড়িতে। সেখানে রোজ সন্ধেবেলায় একটা জমাটি আড্ডা বসত। তখনকার বম্বে-বাঙালিদের দু’জায়গায় একদম নিশ্চিত করে পাওয়া যেত। এক, কাজের জায়গা— বিমল রায় প্রোডাকশন্স। কারণ, বিমলদা বড়লোক প্রোডিউসার ছিলেন। সবাইকে নাইয়ে-খাইয়ে রাখতেন। আমাকেও। আমি তো কনভার্টেড বাঙালি। আর দুই, অভীদার বাড়িতে, সেখানে সবাই আড্ডা দিতে যেত। অভীদার বাড়িতেই আমি প্রথম ‘জতুগৃহ’ পড়েছিলাম, বাংলায়।
সেই আড্ডায় রোজ আমরা একটা করে নতুন সিনেমা বানাতাম, কাস্ট ঠিক হত, বাজেট হত, স্ক্রিপ্ট কে করবে— সব ঠিক হত। পরের দিন যথারীতি ভেস্তে যেত। আবার একটা নতুন সিনেমা তৈরি হত। অন্য রকমের নতুন সিনেমা। যখনই মিউজিক ডিরেকশনের কথা উঠত, আমরা বলে উঠতাম, ‘ওই তো, সলিলদাই তো করবে, আবার কে?’ ঋত্বিকদা তাঁর প্রাণের বন্ধু সম্পর্কে বলে উঠতেন, ‘কী! সলিল মিউজিক দেবে? কোথায় মাল খেয়ে উলটে পড়ে থাকবে!’ আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম, মনে মনে বলতাম, ‘ঋত্বিকদা এই কমেন্ট করছে!’ আর তার পর একটা বিরাট হাসির রোল উঠত। আর সবাই মিলে তখন ঋত্বিকদার পেছনে লাগা হত।
ঋত্বিকদার ছবির সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় হয়েছিল। আমি এখনও ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সুপ্রিয়ার চটি ছিঁড়ে যাওয়ার সিনটা ভুলতে পারি না, কিংবা যে বিশাল গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে অনিলদা বন্দিশ গাইছিলেন, সেই দৃশ্যটা। ওই গাছটা চুজ করাই একটা মাস্টারের কাজ। ওই বিশালত্ব, ওই রাজকীয় ব্যাপারটা ওই সিনটাকে একেবারে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। ঋত্বিকদাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, ওই গাছটার মতো মনে হয়েছিল আমার। খুব আলুথালু রাজকীয়।
কিন্তু আমার মোহ ভাঙল ‘সুবর্ণরেখা’ দেখে। একটা-দুটো দৃশ্য এত মেলোড্রামাটিক যে আমার পছন্দ হয়নি। হয়তো ঋত্বিকদার অনেক কিছুই আমার পছন্দ ছিল না। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ডিন থাকাকালীন উনি যে ভাবে নিজেকে কনডাক্ট করেছিলেন, তা-ও আমার পছন্দ ছিল না। সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে একটা ফারাক রাখার দরকার ছিল বলে আমার মনে হয়। এতটা বোহেমিয়ানিজ্ম ধারণ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। শিষ্যরা যদি অন্ধের মতো ফলো করে, সেটা শিষ্যদের পক্ষে সব সময় শুভ হয় না, সেখানে একটা দায়িত্ব থাকা দরকার ছিল। কোথাও যেন ডিসিপ্লিনের ভারী অভাব ছিল। আর ওঁর যা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, নিজেকে একটু ঠিক ভাবে চালনা করলে শিল্প হয়তো আরও সমৃদ্ধ হতে পারত।
আবার ভেবেছি, ঋত্বিকদা যদি ডিসিপ্লিন্ড আর প্রথাগত ‘প্রপার’ হতেন, তা হলে ঋত্বিকদা হতেন না। অন্য মানুষ হতেন। তিনি ওই একটা রকম ভাবেই বাঁচতে পারতেন, শিল্প করতে পারতেন। ওটা তাঁর ঘরানা, তার যাপন। সেটা তাঁর সিনেমায় প্রতিফলিত। ঋত্বিকদার নিয়মছাড়া ভাব হয়তো কিছুটা জেনেটিকও। ওঁর আরও দুই ভাইকেও আমি খুব ভাল ভাবেই চিনতাম। তাঁদের মধ্যেও এই খামখেয়ালিপনা বা একসেনট্রিক ব্যাপারস্যাপার লক্ষ করেছি।
কিন্তু শিল্পের মানচিত্র তো হরেক রকম প্রতিভা দিয়ে তৈরি। কিছু মানুষ থাকবেনই, যাঁরা ছন্নছাড়া, উদ্দাম প্রতিভাধর, উল্কার মতো— স্বল্পকালীন। সেই সব মানুষকে তাঁদের মতো করেই গ্রহণ করতে শিখতে হবে।
অনেক বছর পর মুম্বইয়ের খার স্টেশনের কাছে ঋত্বিকদার সঙ্গে দেখা। সব সময়ই ওই স্টেশনের কাছে একটা লজে উঠতেন। সেই না-আঁচড়ানো উসকোখুসকো চুল, না-কামানো দাড়ি, খাদির জ্যাকেট, একই রকম রাজকীয়, কেবল চেহারা একটু ভেঙেছে, জৌলুস একটু কমেছে, এই যা। দেখা হতেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। গালে আলতো একটা থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘তুই কী এমন করেছিস রে, যে এত নাম হয়েছে তোর!’ এ কথা বলাটা ওঁরই সাজে। সেই কবে থেকে আর কত কাছ থেকে দেখেছেন তো এই ছোকরাকে! কিন্তু অত বড় হাতের চেটো, তার থাপ্পড় যত আলতোই হোক, তা হজম করার কলজে থাকতে হবে। আমার তো মনে হয়, আমার সেই কলজে ছিল বইকী! আ স্মল টোকেন অব লাভ ফ্রম আ গ্রিক মাস্টার!”
আত্মধ্বংসী কিছু প্রবণতা ছিল ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে। এই সব নিয়ে গালগল্পও কম হয়নি! একান্ত নিজস্ব এক সিনেমা ভাষা ছিল ঋত্বিকের। ঋত্বিকের ছবি দেখলে মনে হয়, হলিউড বলে যেন কখনও কিছু ছিল না! নাটকীয় সংলাপ, চরিত্রদের মঞ্চ-নাটকীয় শরীরী ভাষা, উচ্চকিত অভিনয়, আপতিক ঘটনার অতিব্যবহার, এসব বৈশিষ্ট্য ওঁর ওপর গণনাট্যের দিনগুলির প্রভাব ছাড়াও যা তুলে ধরে, তা হচ্ছে, পশ্চিমী সিনেমার প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখেছিলেন ঋত্বিক। আবার একই সঙ্গে ইউরো-মার্কিন সিনেমার সর্বশেষ চালচলন সম্পর্কে ঋত্বিকের মতো ওয়াকিবহাল পরিচালকই বা ভারতে ক’জন ছিলেন! ঋত্বিক ঘটক যখন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তখন এ ব্যাপারে কুমার সাহনি, মণি কল বা আদুর গোপালকৃষ্ণনের কাছ থেকে শোনা নানা কথা সেই সাক্ষ্য দেয়। পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষাকে পরিহার করা তাই অজ্ঞতাপ্রসূত কিছু ছিল না। ঋত্বিকের দিক থেকে তা ছিল এক সচেতন প্রয়াসই। যাঁরা শিল্প-সংস্কৃতিতে উত্তর-উপনিবেশ বিষয়টি নিয়ে চর্চা করেন, ঋত্বিকের সিনেমা-শৈলীতে চিন্তার অনেক খোরাকই তাঁরা পাবেন। একটা প্রতিতুলনা টানা যায়। কুরোসাওয়া জাপানি, আবার আন্তর্জাতিকও। কিন্তু ওজু একান্তই জাপানি। ওজুকে সঠিক ভাবে বুঝতে জাপানি শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। ঋত্বিক ঘটকও যেন তেমনই আমাদের একান্তই বাঙালি এক শিল্পী যাঁর বিষয়বস্তু, গল্প বলার ধরন, বাংলা ভাষার নাটকীয় প্রকাশভঙ্গি অনুযায়ী নাটকীয় সংলাপ, বাংলা মঞ্চ-নাটকের ধারায় উচ্চকিত অভিনয়রীতি, এমন কী ওজুর লো ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের মতো নিজের আলাদা ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল— ঋত্বিকের ছবির ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সের শটগুলো স্মরণ করুন, এ সবই এক বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালকের একান্ত নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষার প্রকাশ। তাই ঋত্বিকের শিল্পউৎসকে খুঁজতে হবে পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষায় নয়, সেটা খুঁজতে হবে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও শিল্পমাধ্যমগুলির মাঝে।
খণ্ডিত বাংলার প্রতীক এক বাংলা মাকে কল্পনা করে নিয়েছিলেন ঋত্বিক, যে মাতৃরূপটি ওঁর ছবিতে আদিমাতার এক রূপকল্প হয়ে ফিরে আসে বার বার। মার্কসবাদের পাশাপাশি ইয়ুং-এর যৌথ নিশ্চেতনার ধারণাও ততদিনে ঋত্বিকের বিশ্ববীক্ষায় গভীর ভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে। সেই আদিমাতার আবার দুই রূপ। কখনও দেখি তার কল্যাণী জগদ্ধাত্রী রূপ— ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, কখনও বা ধ্বংসের কালী— ‘সুবর্ণরেখা’।
নারীকে রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে না দেখে পুরাণের চরিত্রের প্রতীক হিসেবে দেখবার যে প্রবণতা, যা অনেকটাই পুরুষ-কল্পনা, তাতে পুরুষের ইচ্ছাপূরণ ও পিতৃতন্ত্রের আয়ু বাড়ে বটে, কিন্তু নারীর দৈনন্দিন বেদনার বারমাস্যা তাতে কিছু কমে না। ঋত্বিক আদিমাতার রূপকে নারীর পৌরাণিকীকরণ ঘটিয়েছেন বটে, তবে ঋত্বিকই আবার সেই শিল্পী যিনি সবচেয়ে সার্থক ভাবে দেশভাগ পরবর্তী নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীর তীব্র ও কঠোর জীবনসংগ্রামটাকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। একজন ঋত্বিক ঘটকের পক্ষেই সম্ভব ছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা চরিত্রটিকে পর্দায় ওই রকম জীবন্ত ভাবে তুলে আনা। সেই সংবেদ ও প্রখর বাস্তববোধ ওঁর ছিল। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে বাঙালি নারীর যে প্রতি দিনের সংগ্রাম, ঋত্বিকের ছবিগুলি থেকে তা পাওয়া যায়।
দেশভাগের বেদনার ভাষা কি আজও তৈরি হয়েছে? তবে ঋত্বিকের ছবি নিঃসন্দেহে বিষাদের সেই অতলান্ত গভীরতাকে ছুঁতে পেরেছে অনেক বারই। নিজে যন্ত্রণায় আকীর্ণ নীলকণ্ঠ এক একক শিল্পী হয়েও সমষ্টির প্রতিবাদী চেতনার প্রতি আস্থাটা ঋত্বিক অবিচল রেখেছিলেন আজীবন। ‘সুবর্ণরেখা’-তে জন্মভূমি থেকে উৎপাটিত হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘নবজীবন কলোনী’। সে যৌথতার আদর্শ থেকে নিজের একক সুখের অন্বেষায় চলে যাওয়া ঈশ্বর চরিত্রটার করুণ পরিণতি এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে তার নতুন বাড়ির সন্ধান, মানব জীবনের গোটা চক্রটাকেই যেন ধারণ করলেন ঋত্বিক। পালানোর পথ নেই। লড়াই করেই বাঁচতে হবে। অভিজ্ঞতার উপলব্ধি অপাপবিদ্ধ মননের কাছে কখনওই ধরা দেয় না। দেশভাগের আদিপাপের উপলব্ধি যখন সকল বাঙালির চেতনাকে স্পর্শ করবে, ঋত্বিক ঘটক নামের এই অসামান্য সিনেমা-শিল্পীর আজন্ম এষণা সেদিন সার্থক হবে।
ঋত্বিকের সিনেমা, গল্প, ইন্টারভিউ, চিঠিগুলি না-জানা থাকলে রস পাওয়া দুষ্কর। ইন্টারভিউতে ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘সিনেমার প্রেমে আমি পড়ে নেই, মশাই। আমি গল্প লিখতাম। দেখলাম, গল্পের থেকে নাটকে আরও বেশি লোককে অ্যারাউজ করা যায়। তার পর দেখলাম, নাটকের থেকে সিনেমা আরও শক্তিশালী। যে দিন আরও শক্তিশালী মাধ্যম বেরোবে, সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব।’ ১৯৭১ সালে স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশীর কথা, “আমাকে বলেছে, ঋত্বিক, ইউ আর দ্য ওনলি পিপল্স আর্টিস্ট।” ছবিতে সযত্নে বুনে দেওয়া হয়েছে এই সব উক্তি। যাঁরা ঋত্বিক দেখেননি, কী ভাবে বুঝবেন এই অনুষঙ্গ? উত্তর একটাই। বুঝলে বুঝবেন, না বুঝলে বুঝবেন না। বোর্হেসের গল্প বা উমবের্তো একোর উপন্যাসেও অনেক ক্রস-রেফারেন্স থাকে, ধৈর্য নিয়ে পড়তে হয়।
আর পাঁচজন বাঙালির মতো প্রেমের কবিতা দিয়েই ঋত্বিকের লেখালিখির হাতেখড়ি। প্রথম গল্প বের হয় ‘গল্পভারতী’তে। সেটা ১৯৪৭ সাল। আর সে বছরই ‘অভিধারা’ নামে একটি কাগজ বের করলেন তিনি। পর পর গল্প লেখেন সেই নিজের কাগজেই। নাটক-উপন্যাস লিখলেন আরও পরে। সে সময় তাঁর গল্প প্রকাশ হয় ‘দেশ’, ‘অগ্রণী’, ‘শনিবারের চিঠি’-তে। তাঁর নিজের দাবি, ৫০টি গল্প লিখেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখ্য ‘চোখ’, ‘কমরেড’, ‘গাছ’, ‘অয়নান্ত’, ‘আকাশগঙ্গা’ প্রভৃতি। বেশিরভাগ গল্পেই এসেছে দেশভাগ, কাঁটাতার, দুই বাংলার বিক্ষুব্ধ সময়ের কথা। আছে প্রেমও। কোনও কোনও গল্প নিছক কবিতাও। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘চারপাশে যে সমস্ত খারাপ বদমাইশি অত্যাচার ইত্যাদি দেখেছি তার রাজনৈতিক জীব হিসাবে সোচ্চার প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থেকেই গল্প লেখায় আরজ্ এসেছিল সেই ছোট বয়সেই।’’ আর কাঁচা বয়সের গল্প পড়েই নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ঋত্বিককে ‘শক্তিমান নবীন লেখক’ বলেন।
চলচ্চিত্রকার হিসেবে বিশ্বনন্দিত হলেও ঋত্বিক কুমার ঘটকের (১৯২৫-৭৬) সৃজনকর্মের উন্মেষ মূলত নাট্যকর্মী হিসেবে। নিজে নাটক লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন, এমনকি অভিনয়ও করেছেন। আত্মপ্রকাশ তথা বেশি মানুষের পৌঁছাবার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবেই তিনি সিনেমা জগতে এসেছিলেন। এর চেয়ে জোরালো মাধ্যম পেলে তাকেই তিনি মান্য করতেন, এমন দৃপ্ত ঘোষণা তিনি করেছেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায়,
“আমরা যখন মাঠে ময়দানে নাটক করতাম, তখন চার-পাঁচ হাজার লোক জমা হতো, নাটক করে তাঁদের একসঙ্গে rouse করা যেত। তখন মনে হলো সিনেমার কথা, সিনেমা লাখ লাখ লোককে একসঙ্গে একেবারে মোচড় দিতে পারে। এই ভাবেই আমি সিনেমাতে এসেছি, সিনেমা করব বলে আসিনি।”
ভবিষ্যতে সিনেমার চেয়ে শ্রেয়তর কোনো মাধ্যমের সন্ধান পেলে সিনেমাকে তিনি লাথি মেরে চলে যাবেন—এমন মন্তব্য তিনি করেছেন তাঁর লেখায়।
তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু হয়েছিল অবশ্য গল্পকার হিসেবে। তখনকার অনেক বিখ্যাত সাময়িকপত্রে লেখার সুযোগ পেলেও তিনি মনে করতেন, গল্পের আবেদন পাঠকের কাছে পৌঁছাতে বেশি দেরি হয়; কিন্তু নাট্যাভিনয়ের আবেদন তাৎক্ষণিক, একসঙ্গে বহু মানুষের কাছে তার আবেদন। তাই যৌবনের শুরুতেই তিনি প্রবলভাবে প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, নাট্য-রচনা, নাট্য অনুবাদ তথা পরিচালনা ও অভিনয়ে প্রবলভাবে ব্যস্ত থেকেছেন। অবশ্য সিনেমার দিকে ঝোঁকার কারণে নাট্যকর্মে তেমনভাবে মনোনিবেশ করতে পারেননি, কিন্তু জীবনের সায়াহ্নকাল অবধি নাট্যকর্মে নিয়োজিত হয়েছেন সুযোগ পেলেই।
ঋত্বিক ঘটকের পারিবারিক পরিমণ্ডল তাঁকে নানান সৃজনকর্মে উৎসাহিত করেছে। বালক বয়সেই তাঁর মধ্যে যে প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল, সেই প্রসঙ্গে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে পড়ার সময়কার স্মৃতি উদ্ধার করে তপতী মুখোপাধ্যায় বলেন,
“ও সেইসব নাটকে অংশ নিত অতি আগ্রহে। প্রকৃতপক্ষে এসব দিক দিয়ে ও ছিল আমার ডান হাত। তখন থেকেই নিজস্ব ধারায় ও কবিতা লিখত, অভিনয় করত। চন্দ্রগুপ্ত নাটকে (নিজেদের মতো করে লিখে নিতাম) ও সাজত চাণক্য। এ ছাড়া কোনো নাটকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজা। তলোয়ার খেলার দৃশ্য ও খুব ভালোবাসত। আর টিনের তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ আমাদের একটা অবশ্য অঙ্গ ছিল সব নাটকে। বাড়িতে ছাদে টেন্ট খাটিয়ে বা পাড়ার কারো বাগানে নাটক আমাদের চলতই।”
পরবর্তীকালে রাজশাহীর ছাত্রজীবনে ঋত্বিকের বাঁশি বাজানো, ছবি আঁকা, গল্প লেখা আর অভিনয়ের কথা নানাজনের স্মৃতিকথায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেই ১৯৪২-৪৩ সালে রাজশাহীর পাবলিক লাইব্রেরিতে তাঁর অভিনয়দীপ্ত অচলায়তন, ডাকঘর, পরিত্রাণ, ফাল্গুনী, বিসর্জন আর রাজা নাটকের কথা জানা যায়। রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চায়নে সেই বয়সেই ঋত্বিক তাঁর দক্ষতার যে ছাপ রেখেছিলেন, তা জানা যায় বন্ধু কুমার রায়ের স্মৃতিকথায়,
“রাজশাহীর দিনগুলো সেই সূচনাপর্বে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়—আমাদের কাছে। রবীন্দ্রনাথের রাজা, পরিত্রাণ দুটি নাটক আমরা করেছি সেখানে। সেই পদ্মা নদী, নদীর বাঁধ, মাছ, নৌকো, সাধারণ মানুষ, আমাদের কলেজের বিশাল মাঠ, মাঠ ঘিরে আলাদা আলাদা বিভাগের কারুকার্য করা লাল রঙের ইমারত এসবই আমাদের সংবেদনশীল মনে এই দেশভাগ, পদ্মা নদী চিরকালের একটা ছাপ ফেলে গেল। এসবের মধ্যে ওর মনটা থিতু হতে পারল না। এই অ-স্থিত মনটাই যেন তার সকল কাজে প্রতীয়মান ছিল।”
সেই সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর ঋত্বিক একটি আলেখ্য প্রস্তুত করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে কুমার রায় লিখেছেন,
“নেতাজির বার্মা আসা পর্যন্ত ছিল স্ক্রিপ্টটিতে। লেখাটির মধ্যে নেতাজি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলেন। অভিনয় সংগীত ধারাভাষ্যপর্ব উল্লেখযোগ্য ছিল।”
সেই আলেখ্যটি শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়নি নানা কারণে।
১৯৪৮ সালে কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর কলকাতায় এমএ পড়তে এসে ঋত্বিক ঘটক গণনাট্য সংঘে যোগ দেন। সে সময় নাট্যনির্মাণ ও অভিনয়ে তিনি রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সে সময়ে বীরু মুখোপাধ্যায়ের ঢেউ, পানুপালের ভাঙাবন্দর, ভোটের ভেট, রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন, প্রমথনাথ বিশীর ইন্সপেক্টার জেনারেল অবলম্বনে (মূল রচনা গোগোল) অফিসার নাটকে তাঁর অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। অফিসার নাটকটি নতুন করে লিখেছিলেন। এমনকি কালী বন্দ্যোপাধ্যায় বিবাহের কারণে অনুপস্থিত থাকবেন বলে মাত্র দুদিনের মহড়ায় মূল চরিত্রে তিনি একবার অভিনয়ও করেছিলেন। প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে নাটকটি এক মাসে বাহান্নবার অভিনীত হয়েছিল। তবে বিসর্জন নাটকে তাঁর ‘রঘুপতি’ চরিত্রে অভিনয়ের কথা সর্বজনবিদিত। তিনি শেকসপিয়রের জন্মোৎসবে শ্রীরঙ্গম মঞ্চে উৎপল দত্তের পরিচালনায় ম্যাকবেথ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। নাট্যচক্রের নীলদর্পণ ও শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় নবান্ন নাটকেও (তখনও দলের নাম বহুরূপী হয়নি) অভিনয় করেছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের হাত ধরেই কুমার রায় ‘বহুরূপী’ নাট্যদলে যোগ দেন।
মাত্র পাঁচটি মৌলিক নাটক লিখেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। জ্বালা, দলিল, সাঁকো, জ্বলন্ত এবং সেই মেয়ে। এ ছাড়া ব্রেশটের খড়ির গণ্ডী ও গ্যালিলেও অনুবাদ করেছিলেন। নাটকের সংখ্যা বেশি না হলেও সমকালীন সমাজ ও সময়ের ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর নাটকে। নাটকগুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করলেই সমাজমনস্ক ঋত্বিকের একটি উজ্জ্বল ছবি পাওয়া যাবে।
জ্বালা ঋত্বিক ঘটকের লেখা প্রথম নাটক। যদিও তিনি দলিল নাটকটি প্রথম লিখতে শুরু করেন। এই নাটকের পশ্চাৎ কাহিনী ঋত্বিক নিজেই এইভাবে বিবৃত করেছেন,
“পি.সি. কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি, সে আমাকে বলল, ‘ইউ টেক ওভার দি চার্জ অফ বেঙ্গল’। করেসপন্ডেন্ট আর কী! সে সময় আমি একতিরিশটা সুইসাইড… মানে, অ্যাজ এ করেসপন্ডেন্ট, অ্যাজ এ জার্নালিস্ট, আমাকে এই সমস্তগুলো কভার করতে হলো। তো একতিরিশটা সুইসাইড দেখে—তার ওপরে আমি ‘সুইসাইড ওয়েভ ইন ক্যালকাটা’ বলে লিখে পাঠালাম। সেটা বেরোল এবং খুব নামটাম হলো। তা আমি ভাবলাম কী, এতে তো জমবে না মাল। আরো রাগ প্রকাশ করার একটা ব্যাপার আছে। তখন আমি ফিল্মে এনক্লোজ করিনি অ্যাট অল। এই জ্বালা নাটক থেকে সিলেক্ট করা ছটা চরিত্র—ইচ ওয়ান ইজ এ ট্রু ক্যারেকটার। জ্বালা ইজ এ ডকুমেন্টারি। এই নাটক লিখলাম এবং অ্যাক্টিং করলাম। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করলাম।”
এই নাটকের একটি দুঃখময় পটভূমি আছে। ওই সময় কলকাতা শহরে এক মাসের মধ্যে বহু মানুষ আত্মহত্যা করেছিল। সেই রকম কয়েকটি চরিত্র সন্নিবেশ করে এই নাটক লেখা। একমাত্র উন্মাদ চরিত্র ছাড়া সবগুলোই জীবন্ত, বাস্তব। জ্বালা নাটকটি কলকাতা বেতারে অভিনীত হয়ে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বাংলা ছাড়াও হিন্দিতে অনূদিত হয়ে পাটনা ও দিল্লি রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছিল। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভেদের জালে জড়িয়ে পড়া যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের সম্মেলক আর্তনাদ ফুটে উঠেছে নাটকের মূল বক্তব্যে। মৃত্যুর অবিরল পদধ্বনির মধ্যে জীবনের অসামান্য জয়গান এই নাটকে প্রতীয়মান হয় শেষ পর্যন্ত।
এর পরের নাটক দলিল। গণনাট্য সংঘের সেন্ট্রাল স্কোয়াডের এই প্রযোজনা প্রথম অভিনীত হয় ২০৬ লোয়ার সার্কুলার রোড়ে ভূপতি নন্দীর বাড়ির ছাদে। তৃপ্তি মিত্র পদ্মার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং শম্ভুমিত্র। এই নাটকই ১৯৫৩ সালে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পায়।
এই নাটকটি যখন ছাপা হয়, তার ভূমিকায় ঋত্বিক ঘটক লিখেছেন,
“সম্পূর্ণাঙ্গ নাটক বলতে যা বোঝায়, দলিল একেবারেই তা নয়। পদ্মার স্রোতের মতোই বাস্তুচ্যুত বাঙালির ধারা চলেছে এগিয়ে এক অলঙ্ঘ্য পরিণতির দিকে। একদিকে রয়েছে চরম প্রতিকূল অবস্থা, আর একদিকে বলিষ্ঠ দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, এ দুইয়ে মিলিয়ে আজকের বাস্তবকে সৃষ্টি করেছে। তারই ঘাত-প্রতিঘাত চলছে ঘটনা থেকে ঘটনায়। স্রোতের ঢেউয়ের মতো ছাপিয়ে ছাপিয়ে। তিনটি প্রবাহে সেই মূল সুরটিকে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।”
দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক হানাহানি। বাঙালি জীবনে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, তারই ফলশ্রুতি ঋত্বিকের পরের নাটক সাঁকো। মনে রাখা দরকার, দেশভাগকে ঋত্বিক কোনো দিনও মেনে নিতে পারেননি। সারাজীবন তাঁকে এই কষ্ট তাড়া করে ফিরেছে। তাঁর তৈরি ছবিতেও এই প্রসঙ্গটি ফিরে ফিরে এসেছে। সাঁকো নাটকটি শুরু হচ্ছে হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার এক রাত্রির ঘটনা দিয়ে। মানুষ মারছে মানুষকে। হিন্দু মুসলমানকে, মুসলমান হিন্দুকে মারছে— এ নির্মম ঘটনা ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে বাঙালি মারছে বাঙালিকে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে যার সূচনা, অনুশোচনা ও আত্মদহনের মধ্যেই এর অবসান। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর নিবিড় মমতা দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ও ঐক্যের কথাই শেষ পর্যন্ত উচ্চারিত হয়েছে।
সাঁকো নাটকের পরে পরবর্তী তেরো বছর ঋত্বিক ঘটক নাট্যজগৎ থেকে কেবল বিচ্ছিন্ন ছিলেন না, এরই মধ্যে তাঁর জীবনেও ঘটে গেছে নানা পরিবর্তন। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান ঘটনা ১৯৫৫ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তথা গণনাট্য সংঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এদিকে একটু একটু করে সিনেমা জগতের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়তে থাকেন। প্রথম ছবি নাগরিক নির্মিত হয়েও মুক্তি পায় না। কত অজানারে ছবিটির ৭৫ অংশ নির্মাণ করেও শেষ করতে পারেননি। তবু দমে যাননি তিনি। অযান্ত্রিক মুক্তি পাওয়ার পর চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর দক্ষতা সর্বজনবিদিত হয়। ক্রমে বাড়ি থেকে পালিয়ে, কোমল গান্ধার, মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা তৈরি করে তিনি রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন। তবুও তিনি নাটক নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে থাকেন। ষাট দশকের শেষদিকে তিনি অভিনয় দর্পণ পত্রিকা সম্পাদনার কাজে যোগ দেন। সেই পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয় তাঁর সাঁকো নাটকটি। তাঁর সম্পাদনায় ওই পত্রিকার ওই সময়কার সংখ্যাগুলো দেখলেই বোঝা যাবে, ঋত্বিকের কী পরিমাণ উৎসাহ ও আগ্রহ ছিল নাট্যশিল্পে। সাঁকোর পরের নাটক জ্বলন্ত। এই নাটক লেখার ইতিহাসটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।
১৯৭৪-এ যুক্তি তক্কে গপ্পো ছবির পরে তিনি সেই বিষ্ণুপ্রিয়া নামে একটি ছবি তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। এনএফডিসিতে প্রস্তাবিত ছবিটির সংক্ষিপ্তসার জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ছবিটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। ওই চিত্রকাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছিল জ্বলন্ত নাটকটি। চারটি দৃশ্যে বিভক্ত জ্বলন্ত নাটকটি সেই বিষ্ণুপ্রিয়া চিত্রকাহিনীর অনুরূপ। সেই সময় যে মাস্তানরাজ তৈরি হয়েছিল, তাদের বীভৎস কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে কীভাবে একটি নিষ্পাপ মেয়ের জীবন শেষ হয়ে গেল অগ্নিকাণ্ডে, তারই এক নির্মম আলেখ্য জ্বলন্ত নাটকটি। ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট প্রাচীতীর্থর প্রযোজনায় নাটকটি কলকাতার একাডেমি অব ফাইন আর্টসে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। নাট্যরচনা, সংগীত, মঞ্চনির্মাণ, আলো এবং পরিচালনার দয়িত্বে ছিলেন স্বয়ং ঋত্বিক।
ঋত্বিক ঘটকের শেষতম মৌলিক নাটকের নাম সেই মেয়ে। ১৯৬৯-এ ১০ থেকে ১৪ জুলাই— এই ক’দিনের মধ্যে নাটকটি তিনি লেখেন মানসিক হাসপাতালে বসে। ওই সময় তিনি কিছুদিন সাময়িকভাবে মানসিক অসুস্থতার কারণে ওখানে ভর্তি হয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর ওখানেই নাটকটি রচনা করেন, অনুবাদ করেন কুমারসম্ভবের অষ্টম সর্গ। কলকাতার গোবরা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের দিয়ে নাটকটি অভিনয়ও করান। অভিনয় দর্পণ পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় (জুলাই-আগস্ট ১৯৬৯) নাটকটি মুদ্রিত হয়। নাটকটিতে সংযোজিত একটি গানের কথা ও সুর সংযোজনা করেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। একটি মানসিক চিকিৎসালয়ে সন্তানহারা শান্তি নামের এক গৃহবধূর জীবনের কথা ব্যক্ত হয়েছে নাটকটিতে। এই নাটকের একটি চরিত্র ডাক্তারের। তাঁর একটি সংলাপ এই রকম,
“মানুষ ব্যথা পায়, কষ্ট পায়, তরঙ্গে তরঙ্গে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ভাবে মৃত্যু এলো বুঝি। কিন্তু মৃত্যুর ছদ্মবেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসে নবজীবন… সব জন্মই তো তাই।”
ডাক্তার জানান, আসল চিকিৎসা ভালোবাসা। আর ভালোবাসা, মানুষকে ভালোবাসাই ঋত্বিক দর্শনের মূল কথা—কি থিয়েটারে, কি সিনেমায়।
আগেই জানিয়েছি, ঋত্বিক ঘটকের নাটকের সংখ্যা বেশি নয়। মৌলিক নাটক মাত্র পাঁচটি আর ব্রেশটের খড়ির গণ্ডি আর গ্যালিলেও অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর অস্থির স্বভাব কোনো কিছুতেই তাঁকে বেশিদিন নিমগ্ন থাকতে দেয়নি। মৃত্যুর চারটি দশক অতিক্রম করার পরও তাঁর নাটক আজও প্রাসঙ্গিক।
‘মানুষ, তোমাকে ভালোবাসি’ এই গভীর জীবনদর্শন নিয়ে তিনি নাট্যসৃজনে ব্রতী হয়েছিলেন। অভিনয় দর্পণ পত্রিকার প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছিলেন,
“সব শিল্পের শেষ কথা মানুষকে ভালোবাসা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ম্যাক্সরাইন হার্ডও করিয়াছিলেন, তাহারও ইতিহাস লিখিত আছে। ‘আঁদ্রে আতোয়া’ হইতে আরম্ভ করিয়া কনস্টানটাইন স্তানিশ্লাভস্কির মধ্য দিয়া অটো ব্রাহামের ইতিহাসও আমরা ভুলি নাই। কিন্তু সর্বস্তরেই, এক জায়গায় পৌঁছানো গিয়াছে, সেটা মানুষকে ভালোবাসা।”
জ্বালা থেকে সেই মেয়ে—এই দীর্ঘকালীন নাট্যপ্রবাহে এই ভালোবাসাকেই তিনি নাটকের প্রাণশক্তি হিসেবে অনুভব করেছেন। শুধু নাটকে নয়, তাঁর তৈরি সিনেমাতেও ছিল সেই ভালোবাসারই জয়ধ্বনি।
ঋত্বিক ঘটকের নাট্যচর্চার কালানুক্রমিক তথ্যপঞ্জিটি অনেকেকটা এরকম – ১৯৩৬, চন্দ্রগুপ্ত; ১৯৪৮, নটীর পূজা; ১৯৪৩, অচলায়তন; ১৯৪৩, ডাকঘর, পরিত্রাণ, ফাল্গুনী, বিসর্জন, রাজা; ১৯৪৭, জাগরণ, কালো সায়র; ১৯৪৮, নবান্ন; ১৯৪৯, ঢেউ; ১৯৫০, জ্বালা, নীলদর্পণ;১৯৫১, কলঙ্ক, ভাঙাবন্দর; ১৯৫২, ভোটের ভেট, কত ধানে কত চাল, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, দলিল, ম্যাকবেথ; ১৯৫৩, অফিসার; ১৯৫৪, ইস্পাত, নীচেল মহল; ১৯৫৫, সাঁকো, হ য ব র ল; ১৯৫৬, মুসাফিরে কে লিয়ে (হিন্দি); ১৯৫৭, স্ত্রীর পত্র; ১৯৬৩, বিদ্যাসাগর;১৯৬৪, গ্যালিলেও চরিত; ১৯৬৬, খড়ির গণ্ডী; ১৯৬৯, সেই মেয়ে।
‘নবান্ন’ নাটকে সাফল্যের পরে ৪৯-এ গণনাট্যের নতুন নাটকে হাত দিলেন। ‘ঢেউ।’ নাটকে বৃদ্ধ কৃষকের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করলেন। প্রথম অভিনয় যাদবপুর কলেজের হস্টেলের ছাদে। পরের শো সেই রাতেই। সিটি কলেজে। সে দিন ঋত্বিক মেকআপ নিয়ে উৎপল দত্তের কাছে পয়সা চাইতে গেলেন। তাড়িয়ে দিলেন উৎপল!
‘নবান্ন’ দেখার পরেই ঋত্বিকের সঙ্গে যোগ বাড়ে প্রগেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের। সেখানে তখন চাঁদের হাট। শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, সুধী প্রধান, গোপাল হালদার প্রমুখ। সভাপতি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সদস্য হয়ে গেলেন ঋত্বিক। কিন্তু এখানেও যেন স্বস্তি মিলছে না। এমন অস্থিরতাই যে তাঁকে সারাজীবন তাড়া করেছে। যার সমালোচনাও করেছেন তাঁর গণনাট্যের সহ-যোদ্ধারা।
পার্টিতে ঋত্বিককে নিয়ে নানা বিরোধ থাকলেও যখন তিনি রস্ট্রামের সামনে দাঁড়াতেন, তখন তিনি অন্য মানুষ। ১৯৫৫-তেই উৎপলের পরিচালনাতেই অভিনয় করলেন ‘বিসর্জন’ নাটকে। আবার রঘুপতি। রস্ট্রামের উপর উঠতে উঠতে তাঁর অবিস্মরণীয় সেই অভিনয়, সংলাপের থ্রোয়িং মনে রেখেছে এ শহর! উৎপলের পরিচালনাতেই একবার ঘাটশিলায় সেই নাটক করতে গিয়ে নিদিষ্ট সময়ের আগে পর্দা ফেলে দিয়েছিল গণনাট্যের এক কমরেড। তাতে ঋত্বিেকর শেষ দৃশ্যটি অধুরা রয়ে যায়। রেগে গেলেন। বেরিয়ে সেই কমরেডের গালে সপাটে চড়!
খুব অল্প বয়সেই গল্প লিখতে লিখতে একসময় তাঁর মনে হয়েছিল ‘‘গল্পটা inadequate।’’ সেই জন্য নাটকে চলে এসেছিলেন ঋত্বিক। বলছেন, ‘‘ভাবলাম গল্প ক’জন লোককে নাড়া দেয়, আর নাড়া দেয় অনেক গভীরে গিয়ে, কাজেই অনেক সময় লাগে পৌঁছতে। আমার তখন টগবগে রক্ত, immediate reaction চাই। সেই-সময়ে হল ‘নবান্ন’। ‘নবান্ন’ আমার সমস্ত জীবন-ধারা পাল্টে দিল।… আমি নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়লাম!’’ আবার নাটক করতে করতেই তাঁর মনে হল, কয়েক হাজার নয়, লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে। ‘‘এই ভাবে আমি সিনেমাতে এসেছি, সিনেমা করব বলে আসিনি। কাল যদি সিনেমার চেয়ে better medium বেরয় তাহলে সিনেমাকে লাথি মেরে আমি চলে যাব। I don’t love film. সিনেমার প্রেমে মশায় আমি পড়িনি।’’ কিন্তু নাটকই ছিল তাঁর সারা জীবনের পথের দাবি, বক্তব্য প্রকাশের জোরালো মাধ্যম! সারা জীবনে যখনই গল্প লিখতে লিখতে, ছবি করতে করতে থমকেছেন তিনি, নাটকই সেই খরার দিনে তাঁর বক্তব্য প্রকাশের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সরে যেতে চেয়েছেন, পারেননি।ঠোক্কর খেতে খেতেও টাল সামলে বার বার ভাঙা দেশ, উদ্বাস্তু জীবন আর কলোনির গল্পকে নিজের মতো করে বলেছেন মঞ্চের সংলাপে। তাঁর সুহৃদদেরই কেউ কেউ বলছেন, ‘হি ওয়াজ নেভার সিনসিয়ার টু দ্য থিয়েটার’, কিন্তু, শেষ পর্যন্ত গণনাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে ঋত্বিকই জায়গা করে নিল অনেকখানি। শোভা সেন তাই তাঁকে বলছেন, ‘নাট্য-আন্দোলনের হোতা বা পুরোহিত!’
‘চিত্রনির্মাতা’ দুই ধরনের—এক দল পরিচালক, আরেক দল স্রষ্টা। আমি স্রষ্টার দলে।’ নিজের সিনেমা সম্পর্কে বলেছিলেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটক। তিনি প্রয়াত হন ১৯৭৬ সালে। তাঁর সহধর্মিণী সুরমা ঘটক। ৭ই মে ২০১৮ সালে রাত সোয়া ১২টায় কলকাতার বাঙুর হাসপাতালে জীবনাবসান হয় এই মহীয়সী নারীর। চলচ্চিত্রের গনগনে আগুনের ফুলকি ঋত্বিককে সামলেছেন সুরমা। সুরমা ঘটকের সমস্ত জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, যেন ট্র্যাজেডির সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জীবনের রঙ্গমঞ্চে পারফর্ম করে যেতে হয়েছে তাঁকে।
‘ঋত্বিক দা, ইউনিভার্সিটিতে বার্গম্যানের সিনেমা চালাচ্ছে। যাবেন দেখতে?’ ঋত্বিকের উত্তর, ‘আরে ধুর! বার্গম্যানের পুরোটাই জালিয়াতি, এক শ ভাগ জোচ্চুরি। আন্তোনিওনির স্টাইলটা ধ্রুপদি। যাকগে, যা বোঝো না তা নিয়ে তোমরা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না। শোনো, আরও ৮-১০ বছর বাদে লোকে আমার ছবি নেবে। আমার ছবি পাগলের মতো খুঁজবে। তোমরা দেখে নিয়ো।’ নিজের সম্পর্কে ঋত্বিকের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ হয়েছে। জীবদ্দশায় দর্শকের উপেক্ষার শিকার হওয়া এই চিত্রনির্মাতার ছবি চলচ্চিত্র দুনিয়া এখন পাঠ্য করে নিয়েছে। ঋত্বিকের সব কাজ সংরক্ষণের ভার ছিল সুরমা ঘটকের কাঁধে। অসমাপ্ত ছবির রিল, অপ্রকাশিত লেখার পাণ্ডুলিপি তিনিই তুলে দিয়েছেন ঋত্বিক-ভক্তদের হাতে।
বোম্বেতে বিমল রায়, ঋষিকেশ মুখার্জিদের সঙ্গে কাজ করেছেন ঋত্বিক। চিত্রনাট্য লিখেছেন দিলীপ কুমার অভিনীত মধুমতি, মুসাফির সিনেমার। কিন্তু এই কাজ ভালো লাগছিল না তাঁর। সুরমাকে চিঠি লিখলেন, ‘দশটা-পাঁচটা গিয়ে বসে থাকতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু পয়সার জন্য এখন চেষ্টা করা। দেখো লক্ষ্মী, এ জীবন আমাদের নয়। …এসব ছেড়ে দেব। এ হবে না।’ সত্যি ছেড়েও দিলেন। বোম্বে ছেড়ে এলেন কলকাতায়। নিজের মনের মতো ছবি বানাবেন বলে। ইনিই ঋত্বিক ঘটক। আর একবার ওই মুলুকে গিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী নিজে তাঁকে পুনেতে এফটিআইআইতে ভাইস প্রিন্সিপাল করলেন যখন। আবার ঋত্বিককে পদ্মশ্রী দিলেন এই ইন্দিরা গান্ধীই। ঋত্বিকের কাজের গুণমুগ্ধ ছিলেন ইন্দিরা।
এই ঋত্বিক একবারই প্রেমে পড়েছিলেন। আর সেই পদ্মের মতো প্রেমটি নিয়ে এসেছিলেন যিনি, তিনিই সুরমা ঘটক। ঋত্বিক ডাকতেন তাঁকে ‘লক্ষ্মী’ বলে।
শিলং পাহাড়ের মেয়ে সুরমা। বাংলা ভাগ হয়ে দুই টুকরো হওয়ায় ঢাকার সন্তান ঋত্বিক তখন কলকাতায়। ঋত্বিকের বর্ণনায়, কাগজের বাবুরা তাদের নাম দিয়েছিল উদ্বাস্তু-শরণার্থী। ঋত্বিকের জীবনে শরণার্থী কথাটা শ্লেষ হয়ে কানে বাজত।
সুরমা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। ঋত্বিকও তাই। দুজনেই কেন্দ্রীয় সদস্য পদও পেয়েছিলেন। পার্টির সাংস্কৃতিক সংঘ গণনাট্য (আইপিটিএ) করতে গিয়ে পরিচয় দুজনের। উদ্বাস্তুদের জীবন নিয়ে নিজের লেখা নাটক দলিল বোম্বেতে মঞ্চস্থ করতে গিয়েছিলেন ঋত্বিক। সেখানে সুরমা ভিড়ের একটি দৃশ্যে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করে দিয়েছিলেন। তার জন্য রোগা, লম্বা চেহারার মানুষটি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে এলেন। সেই পরিচয়ের শুরু। ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল কলকাতায় ফিরে।
গণনাট্য সংঘে ঋত্বিক সুরমাদের ক্লাস নিতে শুরু করলেন। লেনিন, মার্ক্স, প্লেখানভ পড়াতেন মন্ত্রোচ্চারণকারী ঋত্বিকের মতো ভঙ্গিতে। সুরমা সে মন্ত্রে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। তিনি যে সাধারণ নারী নন। এর আগে কমিউনিস্ট পার্টির জন্য জেল খেটেছেন ১৮ মাস। সেসব লিখে গেছেন শিলং জেলের ডায়েরিতে। বিসর্জন নাটকের মহড়া করাচ্ছিলেন ঋত্বিক। সুরমা করছিলেন ‘অপর্ণা’র রোল। দুটি চোখ এক হলো। দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে গেলেন তখনই।
সুরমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া সাধনা রায়চৌধুরী ঋত্বিককে চিনতেন। পই পই করে বললেন, ‘এর সঙ্গে মিশিশ না। বরবাদ হয়ে যাবি। ও ট্রটস্কির তত্ত্ব ছড়াচ্ছে। এই জন্য পার্টি বহিষ্কার করে দিচ্ছে ওকে।’ কে শোনে কার কথা। পার্টি ছেড়ে দিয়ে দুজনে গড়লেন গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। এর মধ্যে বিয়েও করে ফেললেন দুজনে। ঋত্বিকের মা বললেন, এই মেয়ে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। ঋত্বিক এক চিঠিতে সুরমাকে লিখেছিলেন, ‘আমার বাড়ির লোকে বলছে, আমাকে কোনো মেয়ের ভালো লাগে কী করে? আমার পা নোংরা থাকে, সস্তা বিড়ি খাই, ধুতি হাঁটু অব্দি উঠে থাকে। আমি নাকি তোমার মোটেই উপযুক্ত নই, মিছিমিছি তোমাকে ডোবাচ্ছি। “লক্ষ্মী” মহিলাটি জলে পড়লেন!’
দারুণ সোনার সংসার হয়েছিল ঋত্বিক-সুরমার। কিন্তু একের পর এক ছবি ফ্লপ করতে থাকে ঋত্বিকের। হতাশ হয়ে পড়েন ঋত্বিক। পয়সা-কড়িও নেই বললেই চলে। সন্তান তিনটি—ছেলে ঋতবান, মেয়ে সংহিতা ও শুচিস্মিতা। এদিকে ঋত্বিক অ্যালকোহলিক হয়ে পড়ছেন দিনে দিনে। বাড়িতে মদের আড্ডা। ঋত্বিক একরোখা—পুরো ইন্ডাস্ট্রি তা জানে। রাজেশ খান্নার মুখের ওপর স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। নিজে জলে পড়েছেন সে নয় মানা গেল, মা হয়ে বাচ্চাদের জীবন অনিশ্চয়তায় ফেলেন কী করে সুরমা? ঋত্বিককে একা ছেড়ে দেবেন, সিদ্ধান্ত নিলেন। শিলংয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলেন সুরমা। এই সেপারেশনেও দুজন দুজনকে চিঠি লিখেছেন মাঝেমধ্যেই।
ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে সুরমার রেফারেন্স এসেছে বারবার। মেঘে ঢাকা তারায় নীতাকে দেখানো হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন জন্মেছেন। আসলে সুরমা জন্মেছিলেন জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন। কোমল গান্ধার-এ কেন্দ্রীয় চরিত্র অনসূয়ার জীবনের সংকটগুলো ছিল আসলে সুরমার সংকট থেকে অনুপ্রাণিত। আর যুক্তি তক্কো গপ্পো তো আত্মজৈবনিক ছবিই। এটিতে সুরমার ছায়া ছিল প্রকট। ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি’ গানটি ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন ঋত্বিক। এই গানটি প্রেমের দিনগুলোতে সুরমাকে গুনগুনিয়ে শুনিয়েছেন যে কতবার! আর এর চিত্রায়ণও করেছিলেন শিলংয়েই।
ঋত্বিকের মৃত্যুসংবাদ সুরমা পান শিলংয়ে বসে। মৃণাল সেন সে খবর দেন। তার পর ৪২ বছর ঋত্বিকের স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ঋত্বিককে স্মৃতিতে ধরে রাখতে লিখেছেন ঋত্বিক ও পদ্মা থেকে তিতাস বই দুটি। ২০০৯ সালে মারা যায় শুচিস্মিতা। সংহিতাও মারা যান বছর খানেক আগে। ছেলে ঋতবানও মানসিক রোগে আক্রান্ত দীর্ঘদিন। সত্যি যেন ট্র্যাজেডির নায়িকা রয়ে গেলেন সমস্ত জীবন।
নিজের চলচ্চিত্র নিয়ে ঋত্বিক বলেছিলেন, “আমি কোন সময়েই একটা সাধারণ পুতু-পুতু মার্কা গল্প বলি না- যে একটি ছেলে একটি মেয়ে প্রেমে পড়েছে, প্রথমে মিলতে পারছে না, তাই দুঃখ পাচ্ছে, পরে মিলে গেল বা একজন পটল তুলল-এমন বস্তাপচা সাজানো গল্প লিখে বা ছবি করে নির্বোধ দর্শকদের খুব হাসিয়ে বা কাঁদিয়ে ঐ গল্পের মধ্যে involve করিয়ে দিলাম, দু’মিনিটেই তারা ছবির কথা ভুলে গেল, খুব খুশি হয়ে বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল- এর মধ্যে আমি নেই।
আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝব it is not an imaginary story, বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে hammer করে বোঝাব যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই thesis-টা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্যই আমি আপনাকে alienate করব প্রতি মুহূর্তে।
যদি আপনি সচেতন হয়ে ওঠেন, ছবি দেখে বেরিয়ে এসে বাইরের সেই সামাজিক বাধা বা দুর্নীতি বদলানোর কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার protest-কে যদি আপনার মধ্যে চারিয়ে দিতে পারি, তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।…
চলচ্চিত্রশিল্পে আমি বলে নয়, যাঁরা পৃথিবীর সবচেয়ে serious শিল্পী এবং আমার বাংলাদেশেও যারা serious কাজ করেন, যাদের নাম-টাম আপনারা শুনেছেন-টুনেছেন, প্রত্যেকেই একজনের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন সের্গেই আইজেনস্টাইন। আইজেনস্টাইন না-থাকলে আমরা কাজ-কম্মর ‘ক’ও শিখতাম না। উনি আমাদের বাবা। আমাদের পিতা। তাঁর লেখা, তাঁর thesis এবং তাঁর ছবি- এগুলো ছোটবেলায় আমাদেরকে পাগল করেছিল। এবং তখন ওগুলো আসত না। বহু কষ্টে লুকিয়ে-লুকিয়ে নিয়ে আসা হত। এই আইজেনস্টাইন… সত্যজিৎ রায়কেও আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, he will admit, that he is the father of us. আর(তাঁর থেকেই) আমরা ছবি কাটতে শিখেছি… filmmaking-এ ওটা একটা ব্যাপার। তারপর পুদভকিন সাহেব। পুদভকিন এসেছিলেন ১৯৪৯ সালে। তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল পার্টির তরফ থেকে… পার্টি আমাকে চাপিয়ে দিল যে পুদভকিন-এর একটু পিছনে-পিছনে ঘোরো। এই পুদভকিন একটা কথা আমাকে বলে দিয়েছিলেন সে দিন, সেটা আমার শিক্ষার basis. সেটা হচ্ছে যে film is not made. Filmmaking কথাটা বাজে কথা। Film is built. Brick to brick যে-রকম ভাবে একটা বাড়ি তৈরি হয়, film তেমনই shot by shot কেটে-কেটে তৈরি হয়। It is built, it’s not made. এই দু’জন ব্যক্তি, তারপর কার্ল ড্রেয়ার। কার্ল ড্রেয়ার-এর ছবি আমি অনেকে দিন আগে পুনায় দেখেছিলাম। ‘The Passion of Joan of Arc’ এই ছবি দেখে আমার মস্তিষ্ক খারাপ হয়ে গেছল। আর আমাকে গুরুজন বলে মানতে হলে একটু মানতে হয়ে বুনুয়েল সাহেবকে। লুইস বুনুয়েল। এঁরা ক’জন আমার সত্যিকারের গুরু, plus মিজোগুচি। এঁর ‘Ugetsu Monogatari’ দেখে আমি staggered… মানে….মাথা-ফাতা খারাপ হয়ে গেছল। একেই বলে ছবি! ছবি কী, এই ক’টা লোক থেকে আমি পেয়েছি।”
ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র তালিকাটা অনেকটা এইরকম –
■ পরিচালনা-
নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭)
অযান্ত্রিক (১৯৫৮)
বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮)
মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)
কোমল গান্ধার (১৯৬১)
সুবর্ণরেখা (১৯৬২)
তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭)
■ কাহিনী ও চিত্রনাট্য-
মুসাফির (১৯৫৭)
মধুমতী (১৯৫৮)
স্বরলিপি (১৯৬০)
কুমারী মন (১৯৬২)
দ্বীপের নাম টিয়ারং (১৯৬৩)
রাজকন্যা (১৯৬৫)
হীরের প্রজাপতি (১৯৬৮)
■ অভিনয়-
তথাপি (১৯৫০)
ছিন্নমূল (১৯৫১)
কুমারী মন (১৯৫২)
সুবর্ণরেখা (১৯৬২)
তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭)
■ শর্টফিল্ম ও তথ্যচিত্রের তালিকা-
দ্য লাইফ অফ দ্য আদিবাসিজ (১৯৫৫)
প্লেসেস অফ হিস্টোরিক ইন্টারেস্ট ইন বিহার (১৯৫৫)
সিজার্স (১৯৬২)
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান (১৯৬৩)
ফিয়ার (১৯৬৫)
রঁদেভু (১৯৬৫)
সিভিল ডিফেন্স (১৯৬৫)
সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো (১৯৬৭)
ইয়ে কওন (হোয়াই / দ্য কোয়েশ্চন) (১৯৭০)
আমার লেলিন (১৯৭০)
পুরুলিয়ার ছৌ (দ্য ছৌ ড্যান্স অফ পুরুলিয়া) (১৯৭০)
দুর্বার গতি পদ্মা (দ্য টার্বুলেন্ট পদ্মা) (১৯৭১)
■ অসমাপ্ত ছবি ও তথ্যচিত্রের তালিকা-
বেদেনি (১৯৫১)
কত অজানারে (১৯৫৯)
বগলার বঙ্গদর্শন (১৯৬৪-৬৫)
রঙের গোলাপ (১৯৬৮)
রামকিঙ্কর (১৯৭৫)
পুণের ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অব ইন্ডিয়া-র সংগ্রহশালায় এ বার দেখা মিলবে ঋত্বিক ঘটকের অসম্পূর্ণ তিনটি ছবির রিলের। অসমাপ্ত এই ছবি তিনটি হল ‘কত অজানারে’ (৮ রিল), ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ (৪ রিল), এবং ‘রঙের গোলাম’ (৩ রিল)। ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে ছবিগুলি তৈরির চেষ্টা করেছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দফতর ও ঋত্বিক ঘটক মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সাহায্যে এই মূল্যবান রিলগুলি সংগ্রহ করেছে এন.এফ.এ.আই ।
১৯৭৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি মারা যান ঋত্বিক ঘটক। আর মাঝপথে ফেলে যান অজস্র নাটক আর সিনেমার স্ক্রিপ্ট। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘কোমলগান্ধার’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, ‘তিতাস একটি নদীর’ নাম ছাড়াও এই তিনটে ছবির কাজে হাত নিয়েছিলেন পরিচালক। ১৯৮৫ সালে এন.এফ.এ.আই-এর তৎকালীন ডিরেক্টর হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘কত অজানারে ছবিটির শেষ দৃশ্যটি কেবল ঋত্বিক শুট করেছিলেন। তবে তাঁর স্ত্রী সুরমা দেবী এই ছবির কলাকুশলীদের নাম বলেছেন। অনিল চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, ছবি বিশ্বাস, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও আরও অনেকেই ছিলেন কত অজানারে ছবিতে। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে গোঁফ ও চুলের কায়দা বদলে এমন মেক-আপ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে যেন অবিকল ঋত্বিক ঘটকের বাবার মত দেখতে লাগছিল।’
এক সপ্তাহ শুটিংয়ের পর ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ (১৯৬৪-৬৫) বন্ধ হয়ে যায়। অভিনয়ে ছিলেন সুনীল মুখোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রানু মুখোপাধ্যায়। ১৯৬৮ সালে একটা ছোট্ট আউটডোর শুটিং শেষের পর ‘রঙের গোলাম’ও বন্ধ হয়ে যায়। অনিল চট্টোপাধ্যায় এবং সিতা দেবী ছিলেন এই ছবির মুখ্য চরিত্রে।
এন.এফ.এ.আই-এর পরিচালক প্রকাশ ম্যাগডাম সংবাদমাধ্যম কে জানিয়েছিলেন, ‘‘ঋত্বিক ঘটকের সম্পূর্ণ ছবিগুলো আমাদের সংগ্রহে ছিলই। আর এ বার অসম্পূর্ণগুলো পেয়ে শূন্যস্থানটা পূরণ হয়ে গেল।’’ তবে আর্কাইভের সংগ্রহে এসেছে আরও কয়েকটি মূল্যবান জিনিস। এর মধ্যে ঋত্বিকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম'(১৯৭৩)-এর বুকলেট, জয়ললিতা অভিনীত সিনেমা ‘সেহজাদি মুমতাজ'(১৯৭৭)-এর বেশ কিছু ছবি, ১৯৩২ সালের মরাঠি ছবি ‘সান্ট তুকারাম’-এর কিছু ছবি, অমিতাভ বচ্চনের অপ্রকাশিত সিনেমা জমানাত এর পোস্টার এবং প্রথম অহমীয়া ছবি ‘জয়মতি’-এর কয়েকটা ছবি।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা তার সময়ে একেবারেই চলেনি। এক কথায় বলতে গেলে সেই সময় মানুষ তাঁর ছবি গলাধঃকরণ করতে পারেনি। ঋত্বিকের মৃত্যুর পর এক স্মরণসভায় সুবর্ণরেখার হরপ্রসাদ অর্থাৎ অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য বলেছিলেন ‘ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে।’ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ঋত্বিক ঘটককে সিনেমা বানাতে হয়েছে। সিনেমা তৈরির বিন্দুমাত্র টাকাও জুটতো না তাঁর কপালে। সুবর্ণরেখার আউটডোর হয়েছিল জাফুলিয়াতে। সেখানে রাত ন’টায় একটা ট্রেন আসতো। ঋত্বিক সেই লোকটার অপেক্ষায় বসে থাকতেন কখন তিনি ফিল্মের র স্টক নিয়ে হাজির হবেন। র স্টক এলে তবেই শুটিং সম্ভব। কোনও কোনও দিন র স্টক এসে পৌঁছতও না। শুটিং বন্ধ হয়ে যেত। চিত্রনাট্যের বাইরেও অনেক বেশি ফুটেজ ঋত্বিক ঘটক তুলে রাখতেন সুবর্ণরেখার শুটিং-এর সময়ে। পরে এডিটিং টেবলে সেগুলোকে সাজানো হত। কিন্তু ওই এক্সট্রা শটগুলোই পরে টালিগঞ্জে রুপো গলানোর কাজে এসেছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অব ইন্ডিয়া-র এই পদক্ষেপকে সাহসী বলতে হয়।
(তথ্যসূত্র:
১- মৃণাল সেন, তৃতীয় ভুবন, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১১), কলকাতা।
২- মৃণাল সেন, আমি ও আমার সিনেমা, বাণীশিল্প (২০১৫), কলকাতা।
৩- মৃণাল সেন, অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ ও থীমা (২০১৫), কলকাতা।
৪- মৃণাল সেন, মানিকবাবুর সঙ্গে তর্ক এখনও আমার শেষ হয়নি, ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পাদিত ‘আনন্দলোক’, ২ মে ১৯৯৮, কলকাতা।
৫- ‘সত্যজিৎ রায় ভিন্ন চোখে’ – শীতলচন্দ্র ঘোষ ও অরুণকুমার রায় সম্পাদিত।
৬- অনন্য সত্যজিৎ — প্রবোধকুমার মৈত্র সম্পাদিত।
৭- দৈনিক স্টেটসম্যান, ২রা মে ২০১৯ সাল।
৮- ঋত্বিক ঘটক, রজত রায়, প্রতিভাস।
৯- সাক্ষাৎ ঋত্বিক (ঋত্বিক ঘটকের ১৮ টি সাক্ষাৎকার ওঋত্বিক সম্পর্কে ২১ জনের লেখা /কথা), শিবাদিত্য দাশগুপ্ত, দীপায়ন।
১০- শিলং জেলের ডায়েরি, সুরমা ঘটক, অনুষ্টুপ।
১১- ঋত্বিক, পদ্মা থেকে তিতাস, সুরমা ঘটক, অনুষ্টুপ।
১২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭শে ডিসেম্বর ২০১৬ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত