আদি চিত্তেশ্বরী দুর্গা মন্দিরটি কলকাতার কাশীপুরের ‘গান-অ্যান্ড-শেল’ কারখানার পাশে অবস্থিত। জনশ্রুতি, প্রাচীন কলকাতার চিৎপুর (‘চিত্রপুর’) অঞ্চলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ‘চিত্তেশ্বরী’/’চিত্রেশ্বরী’। দেবীমূর্তি প্রাচীন হলেও বর্তমান চিত্তেশ্বরী মন্দিরটি অপেক্ষাকৃত নবীন। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রী মনোহর ঘোষের নাম উল্লিখিত আছে। যদিও ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে স্থানীয় জমিদার শ্রী মনোহর ঘোষ প্রথম আদি চিত্তেশ্বরী দুর্গা কে কুটির থেকে মন্দিরে স্থাপিত করার পূর্বেও এই স্থানে মন্দির ছিল এবং তাতে দেবী পূজিত হতেন। শ্রী মনোহর ঘোষের নির্মিত মন্দির ধ্বংস হয়েছে বহুকাল আগেই। তারপরে এই মন্দির সংস্কার ও পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। যদি বর্তমান মন্দিরের গায়ের প্রতিষ্ঠা ফলক অনুসারে এই মন্দিরের বয়স মাপা হয় তাহলে এটি বর্তমান হিসাবে ৪৩২ বছরের বেশী প্রাচীন। কারণ সেই ফলকে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, তারও ৩৫৬ বছর আগে এই দেবী পূজিত হতেন চিতু ডাকাতের হাতে। অর্থাৎ সেই হিসাবে এই প্রতিমা বর্তমান হিসাবে প্রায় ৭৮৮ বছরের বেশি প্রাচীন এবং এই স্থানে তখনও একটি মন্দির ছিল যাতে দেবী পূজিত হতেন।
বঙ্গের ডাকাতদের দ্বারা তৈরি প্রাচীন কালীমন্দিরে নরবলির ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু ডাকাতের আরাধ্য দেবী দুর্গা এবং সেখানে নরবলির ইতিহাস বিরলতম। চিতু ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত চিত্তেশ্বরী মন্দির এক্ষেত্রে ইতিহাসের এক ব্যতিক্রম।
প্রায় চারশো বছর আগের কথা। গঙ্গানদীর দুই কুল যখন ভীষণ শ্বাপদসঙ্কুল বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ, তখন কাশীপুর চিৎপুরের গভীর অরণ্যে চিতু ডাকাত নরবলি দিয়ে দশভুজা দুর্গাদেবীর পূজা করতেন। সেই দেবী, একই মূর্তিতে আজও বিদ্যমান। ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে কোম্পানীর রাজত্বকালেও চিৎপুরের জঙ্গলের বিষয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উল্লিখিত রয়েছে। রেভারেন্ড লঙ সাহেবের লেখনী অনুসারে –
“Northward was the native town with the old Chitpur Road, as now, in the centre the houses were much mixed up with jungle and surrounded by stagnant pools and all kinds of filth. The jungle on all sides of the city was very thick. (Calcutta Review, 1846) “
হরিসাধন মুখোপাধ্যায় লিখেছেন –
“চিৎপুর রোড কলিকাতার একটি অতি পুরাকালের পথ। মোগল বাদশাহদিগের আমল হইতে এই পথটির অস্তিত্ব। তখন ইহার দুই পার্শ্বে ভীষণ জঙ্গল ছিল। এই জঙ্গলের মধ্যস্থলে অপ্রশস্ত বনপথ। এই পথের যাত্রীরা, কাপালিক এবং শাক্ত-সন্ন্যাসীরা, সেই পুরাকালে চিত্রেশ্বরী ঠাকুর দেখিয়া জঙ্গল সমাচ্ছন্ন চৌরঙ্গীর মধ্য দিয়া কালীঘাট যাইতেন। চিত্রেশ্বরীর নাম হইতেই এই পথটির নাম ‘চিৎপুর’ হইয়াছে। চিত্রেশ্বরীর মন্দির বহুকালের। স্বনামপ্রসিদ্ধ হল ওয়েল সাহেবের আমলের ব্লাক (ব্ল্যাক) জমিদার শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র এই মন্দিরটি নূতন করিয়া নির্ম্মান করিয়া দেন।”
কলকাতা কোনও দিন এতবড় শহর রূপে গড়ে উঠবে সেটা তখন কেউ হয়ত কল্পনাও করেন নি। তখন তিনখানা মাত্র গ্রাম ছিল – সুতানুটি, কলিকাতা ও গোবিন্দপুর। তখন এই তিনটি গ্রামই ছিল বনে জঙ্গলে ভরা। চিৎপুর খালের কাছে, ভাগীরথী নদীর কিনারা থেকে একটা রাস্তা সাপের মতন সাপের মতন এঁকে-বেঁকে সুতানুটি, বড়বাজার, কলকাতা, গোবিন্দপুরের খাল, চৌরঙ্গী পার করে এসে পড়ত আদিগঙ্গার (বর্তমানের টালি নালা) তীরে অবস্থিত কালীঘাটের মন্দির পর্যন্ত। এই পথের নাম ছিল ‘তীর্থযাত্রার পথ’, ব্রিটিশরা ইংরেজিতে বলত ‘পিলগ্রীম রোড’। যদিও বর্তমানের নিরিখে এটাকে পথ বলা উচিত হবে কিনা জানা নেই। কারণ গোটা রাস্তা জুড়ে ছিল বেতঝোপ, বড় বড় ঘাসের বন, ছোট-বড় খাল, বিল, পচা ডোবা, পানা পুকুর, জলা, হোগলা বন, বাঁশের ঝাড় আর তার মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়ে হাঁটা রাস্তা। বনের মধ্যে ছিল ঠ্যাঙ্গাড়ে-ডাকাতদের আড্ডা। এছাড়াও ছিল বিষাক্ত সাপ, বুনো শুয়োর সমেত অন্যান্য বন্য জন্তুদের আবাস। এমনকি এই জঙ্গলে সুন্দরবনের বাঘ পর্যন্ত ছিল, তার উল্লেখ প্রাচীন দস্তাবেজ পাওয়া যায়। বর্ষাকালে এই রাস্তা চলার অগম্য হয়ে উঠত। হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে যেত। জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ বলতে যা বোঝায়, এই রাস্তার অবস্থা ঠিক তাই ছিল। এরকম আরও একটি রাস্তা ছিল সেকালের কলকাতায়। সেটা ছিল, এখন যেখানে লালদীঘি রয়েছে সেখান থেকে পুবের দিকে লবন জলের হ্রদ বা সল্ট ওয়াটার লেক পর্যন্ত।
বঙ্গদেশে বহু প্রাচীনকাল থেকে পুণ্যার্থীগণ পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য ও ডাকাতেরা অর্থসংগ্রহের জন্য কালীর কাছে নরবলি দিতেন। ডাকাতদের ধারণা ছিল দেবী প্রসন্না হলে তাঁরা বহু ধনরত্ন পাবে। বঙ্গদেশের সর্ব্বত্র “ডাকাতে কালী” দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু “ডাকাতে দুর্গা” একমাত্র কাশীপুর – চিৎপুর ব্যাতীত কোথাও নয়নগোচর হয় না। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আম লেফটেন্যান্ট হিকস এই নরবলি প্রথা রদ করতে সচেষ্ট হয়েও বিশেষ ফলবতী হন নি। ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যন্ত এই প্রথা বঙ্গদেশে প্রচলিত ছিল বলে লঙ সাহেব তাঁর লেখায় লিখেছেন –
“Human sacrifices were also frequent even as late 1832.”
১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ছয় বৎসর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ক্যাপ্টেন ক্যাম্বেল ও মেজর ম্যাকফারসন পূজায় নরবলি দেবার প্রথা এদেশ থেকে দূরীভূত করেন।
গুণের দিক থেকে শক্তির প্রকাশ তিন ধরনের – সত্ত্ব, রজঃ, ও তমঃ। দুর্গাপূজা রাজসিক পূজা, আসুরিক শক্তির ধ্বংস এই পূজার লক্ষ্য। শক্তি উপাসনা করলে মনস্কামনা সিদ্ধ হয় বলে বঙ্গদেশের জনগণ যেমন ধন, যৌবন, রূপ, যশ, শত্রু বিজয়, ও সুন্দরী স্ত্রী লাভের জন্য দুর্গাপূজা করতেন, ডাকাতেরা সেকালে তদনুরূপ অর্থলাভের জন্য কালীপুজা করতেন। তথাপি চিতু ডাকাত কালীপূজা না করে দুর্গাপূজা করতেন, এটাই ছিল তাঁর বিশেষত্ব।
সেকালের কলকাতায় দুটো প্রাচীন মন্দির ছিল। একটা উত্তরে ও একটা দক্ষিণে। একটি কালীঘাট ও অপরটি চিত্রেশ্বরী। চিত্রেশ্বরী বা বর্তমানের চিত্তেশ্বরী মন্দিরের চারিদিকে ছিল ঘন বন। যাঁরা দল বেঁধে এই ‘তীর্থযাত্রার পথ’ ধরে তীর্থ করতে যেতেন, তাঁরা আগে চিত্রেশ্বরী দর্শন করে তারপরে কালীঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেন। আজকের মতন অবস্থা ছিল না। কেউ সাপের কামড়ে মরতেন, তো কেউ আবার বাঘের পেটে যেতেন। কেউ আবার ডাকাতের খপ্পরে পড়ে প্রাণ দিতেন। ডাকাতরা সবকিছু লুঠ করে হত্যা করে দেহ হয় জঙ্গলে ফেলে দিত আর না হয় খালের জলে ভাসিয়ে দিত।
চিতু বা চিতে ডাকাতের সম্পূর্ণ নাম ছিল চিত্তেশ্বর রায় বা চিত্রেশ্বর রায়। সেকালে তাঁর নাম শুনলে পশ্চিমবঙ্গের লোক ভয়ে কেঁপে উঠত। খালি তিনটে গ্রাম নয়, আশেপাশের সব গ্রামের লোক, এমনকি সাহেবরা পর্যন্ত তাঁর নামে ভয়ে কাঁপত। আগে চিঠি মারফত খবর দিয়ে, চিতু ডাকাত ডাকাতি করতে যেতো ও যাবার আগে দেবী দুর্গার ষোড়শোপচারে পূজা করে নরবলি দিয়ে তারপর চিতু ডাকাত যাত্রা করত। তাঁর দলে প্রায় পাঁচশো ডাকাত ছিল। তাঁদের কেউ ছিল ঠ্যাঙ্গাড়ে, কেউ ছিল লেঠেল, কেউ ছিল তলোয়ারী (তলোয়ার চালাতে দক্ষ), কেউ আবার ছিল ধানুকী (তির চালাতে দক্ষ)। নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানো অসংখ্য জল দস্যুও তাঁর অনুগত ছিল। হাওড়া, হুগলি, নদীয়া, বর্ধমান পর্যন্ত ছিল চিতে ডাকাতের লোকেদের আড্ডা। তাঁর দলে ছিল নানা জাতির লোক, সকলে বাঙালি নয়। কেউ ছিল বিহারি, কেউ ছিল উড়িয়া, কেউ ছিল বেদে, আবার কেউ ছিল শিকারী জাতির। প্রচুর মুসলিমও তাঁর ডাকত দলে ছিল। চিতে ডাকাত এমন একটি দল চারিদিকে গড়ে তুলেছিল এবং শহর ও পল্লীর এমন সব স্থানে তাঁর ঘাঁটি ছিল যে তাঁকে ধরা তৎকালীন প্রশাসনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। যদি ধরা পড়ার কোনও সম্ভাবনা ঘটত, তাহলে সে ও তাঁর সঙ্গীরা চন্দননগর, হুগলি ও বর্ধমানের কোনও দূর পল্লীগ্রামে গিয়ে গা-ঢাকা দিত। চিতে ডাকাত নিজে ছিল দুঃসাহসী। সে তাঁর আড্ডা ছেড়ে সচরাচর কোথাও পালাত না। পূর্বেই লিখেছি যে ডাকাতি করতে বের হবার আগে চিতে ডাকাত ও তাঁর সঙ্গীরা মায়ের মন্দিরে পূজা দিত। পূজা করত সে নিজের মন্ত্রে, কোন মন্ত্রে সেটা চিতে ডাকাত ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে ও জানতে পারে নি। পূজার অর্ঘ্য ছিল নরবলি। চিতে ডাকাত পূজা করার পরে মায়ের আশীর্বাদ ভিক্ষে করত। তারপরে ভক্তিভরে জবা, অন্যান্য ফুল, বেলপাতা ইত্যাদি মায়ের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে অপেক্ষা করত। যদি সেই পুষ্পাঞ্জলি মায়ের পায়ে স্থির থাকত, তাহলে সে মনে করত যে, মা সম্মতি দিয়েছেন। এরপরেই সে নিজে দলের সাথে ডাকাতি করতে বের হত বা তাঁর দলকে জলে বা স্থলে ডাকাতি করতে পাঠিয়ে দিত। আজ যেখানে চিত্তেশ্বরী দেবীর মন্দির অবস্থিত একদা তার খুব কাছেই ছিল গঙ্গা। এই চিতু ডাকাতের বংশেই পরে রঘু ডাকাতের জন্ম হয়েছিল। ডাকাতির জন্য রঘু ডাকাতের নামও বঙ্গদেশে খ্যাতিলাভ করে এবং তাঁর সম্বন্ধেও বহু অলৌকিক কাহিনী আজও প্রবাদের ন্যায় প্রচলিত রয়েছে।
চিতুর দুর্গা, চিতুর দেবী বা চিত্তেশ্বরী বলে প্রাচীন গ্রন্থে এই দেবীর বিষয়ে উল্লেখিত হয়েছে। নিউরেল সাহেব লিখেছিলেন –
“This traverses the ancient village Chittrapur, now pronounced Chitpur once framed for the temple of Chittrue Dabi, worshipped here with human sacrifices.” (Calcutta – H. A. Newel).
চিতু ডাকাতের পূজিত দুর্গাদেবীর মূর্ত্তিতে কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখনীয়। দেবী অসুরদলনী সিংহবাহিনী হলেও, তাঁর দুইপার্শ্বে লক্ষ্মী-সরস্বতী ও কার্ত্তিক-গণেশ নেই। প্রচলিত দুর্গামূর্ত্তিতে কোথাও বাঘ দেখা যায় না। কিন্তু চিতুর দুর্গাপ্রতিমার পাদদেশে একটি বাঘ আছে। প্রাচীনকালে কাশীপুর থেকে কলকাতা যখন জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল ছিল, তখন ডাকাতেরা বন জঙ্গলে বাঘকে সন্তুষ্ট করার জন্য পূজা করত। দক্ষিণরায়ের বাহন বাঘ। ২৪ পরগণার দক্ষিণাণাঞ্চলে দক্ষিণ রায় ও বাঘের পূজা একত্রে হয়। চিতু ডাকাতের পূজিতা দেবী দুর্গার নাম হয় চিত্তেশ্বরী ও কাশীপুরের অরণ্য ছিল চিতু ডাকাতের আবাসভূমি তাই তার নাম হয় চিত্রপুর। কালক্রমে চিত্রপুর হয়ে ওঠে চিৎপুর। রেভারেন্ড লঙ সাহেব ১৮৪৬ খ্রীষ্টব্দে চিতু ডাকাতের দেবী চিত্তেশ্বরীর নিকট যে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক নরবলি হত সেটাও উল্লেখ করেছেন। তাঁর বর্ণনার অংশবিশেষ নীচে উদ্ধৃত হল –
“It was old then written Chittrapur and was noted for the temple of Chottreswari Devi, or the Godess of Chittru, known among Europeans as the temple of Kali at Chitpore. According to popular and uncontradicted tradition, it was the spot where the largest number of human sacrifices was offered to Godess in Bengal, before the establishment of British Government.” (Calcutta Review, Vol – III 1846)
চিতু ডাকাতের দুর্গা, দেবী চিত্তেশ্বরী খুবই জাগ্রতা বলে সেকালে খ্যাতি লাভ করেছিল, সেই জন্য দিনের বেলা বহু ধনীব্যক্তি লোক লস্কর নিয়ে মনস্কামনা সিদ্ধির জন্য ঘন জঙ্গলের মধ্যে দেবীকে পূজা দেবার জন্য আসতেন।
যার শুরু আছে, তার শেষও আছে। চিতে ডাকাতের শেষও লেখা ছিল। এক শনিবারের অমাবস্যায় মন্দির প্রাঙ্গনে ডাকাতের দল মিলিত হয়েছিল। মায়ের পূজার সময় উপস্থিত হল। পুরোহিত ছিল দুইজন – এক কাপালিক ব্রাহ্মণ আর চিতে ডাকাত নিজে। তান্ত্রিক মতে পূজার সব আয়োজন সমাপ্ত, নরকরোটি তে কারণ রয়েছে, কিন্তু শব নেই! শব না থাকলে দেবীর পূজা সম্পুর্ন হওয়া সম্ভব নয়। রক্ত যে চাই! সেদিন দুর্ভাগ্যবশত এক যুবক তীর্থযাত্রীদের দল থেকে দলছুট হয়ে একাই হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কালীঘাটের দিকে যাচ্ছিল। তাঁকে পেয়ে ডাকাত দল তাঁকেই ধরে নিয়ে এল। যুবক সভয়ে নিজেকে ব্রাহ্মণ পরিচয় দিল। মিনতি করে ডাকাতদের বলল তাঁকে ছেড়ে দিতে, এটাও জানাল যে সে তাঁর বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। কিন্তু কে তাঁর কথা শোনে! রক্তলোলুপ পিশাচের দলের মতন ডাকাতরা যুবক কে ধরে যুপকোষ্ঠের দিকে নিয়ে গেল। প্রাণ রক্ষার আর কোনও উপায় না দেখে সেই যুবক তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল। যুবক যথেষ্ট বলশালীও ছিল। ডাকাতরা সেদিন একটু মদমত্ত ছিল, তাই ধস্তাধস্তিতে যুবক হঠাৎ তাঁদের হাত ছাড়িয়ে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে দৌড় লাগলো। ডাকাতরাও তাঁকে ধরার জন্য ছুটলো। ঠিক সেই সময়ে তীর্থযাত্রীদের অন্য একটা দল, যাতে প্রায় একশো’র বেশি লোক ছিল, মশাল জ্বালিয়ে ওই পথেই আসছিল। তাঁরা কালীঘাট দর্শন করে ফিরছিল। যুবক তাঁদের কাছে পৌঁছে প্রাণে বেঁচে গেল। সেদিন ডাকাতদের দেবীর আশীর্বাদ মিলল না, বলি হল না আর পূজাও সম্পন্ন হল না। বলি একবার বন্ধ হয়ে গেলে আর তা চালু করা যায় না। এই ঘটনার পর থেকেই চিত্রেশ্বরী মন্দিরে নরবলি বন্ধ হয়ে গেল। চিতে ডাকাতের মনে একটা খুঁতখুঁতানি রয়ে গেল, তবে কি দেবী তাঁর ওপরে রুষ্ঠ হয়েছেন?
চিতে ডাকাত শুধুমাত্র সাধারণ মানুষকে লুঠ করত না। সে এতটাই দুঃসাহসী ছিল যে, নদীপথে কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদে কোম্পানির যে মাল বোঝাই নৌকাগুলো যেত আর আসত, সেগুলোও অনবরত লুঠ করত। তখন গোবিন্দপুর তুলা আর সুতোর জন্য বিখ্যাত ছিল। সুতো বোঝাই, কোম্পানির একটা নৌকা যাচ্ছিল মুর্শিদাবাদের দিকে, সেটা পড়ল চিতে ডাকাতের দলের হাতে, নৌকা তো লুঠ হলোই, সাথে নৌকার পাহারাদার থেকে মাঝি-মল্লা সকলে প্রাণ দিল। এমনি চিতে ডাকাতের দল, হিজলী থেকে ছোট নৌকায় করে কলকাতায় যে লবন আমদানি হত, সেগুলোও লুঠ শুরু করলো। তাঁর ডাকাতির কাছে কুখ্যাত পর্তুগিজ দস্যুরাও হার মানলো। কোম্পানির টনক নড়লো। তারা তাদের ক্ষতি আর হজম করতে পারছিল না। উপরন্তু অন্যান্য ব্যবসায়ীরা যারা কোম্পানির সাথে ব্যবসা করত, তাঁরাও চিতে আর তাঁর দলের হাতে পড়ে প্রাণ ও সর্বস্ব খুইতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই চিতে কে কব্জা করা যাচ্ছিল না। ধরা তো অনেক দূরের ব্যাপার।
সেই সময় চিৎপুরের কাছে দত্ত পদবীর একঘর সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বাস করতেন। চক্রপাণি দত্ত বলে সেই পরিবারের একজন নবাবের সেনাপতি ছিলেন। তিনি বীর ও দুঃসাহসী দুটোই ছিলেন। চক্রপাণি দত্ত বিদেশে থাকতেন বলে কথিত, কেউ বলেন তিনি গৌড়ে থাকতেন, আবার কেউ বলে তিনি মুর্শিদাবাদে থাকতেন। একবার চক্রপাণি নিজের পরিবার সমেত, নিজের গ্রাম চিৎপুরে আসেন চিত্রেশ্বরী দেবীর পূজা দিতে। সেখানেই তাঁর সাথে চিতে ডাকাতের সংঘর্ষ বাঁধল। আশেপাশের গ্রামের লোকেরা আর কোম্পানি এমনিতেই চিতে ডাকাতের ওপরে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। কথা পৌঁছেছিল নবারের কানেও। গ্রামের লোকেরা চক্রপাণির বীরত্ব আর রণনৈপুণ্যের কথা জানত। তাঁরা চক্রপাণি কে সঙ্গ দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। তিনিও পাল্টা প্রতিশ্রুতি দিলেন যে চিতে ডাকাত কে শেষ তিনি করবেনই। চক্রপাণি দত্ত, কোম্পানি আর নবাবের সাথে গোপনে পরামর্শ করে ডাকাত ধরার ব্যবস্থা করলেন। এক রাত্রে তিনি গোপনে গভীর অরণ্যের মধ্যে কোম্পানি আর নবাবের সৈন্য নিয়ে চিতে ডাকাত কে ধরার জন্য প্রস্তুত হলেন। লোকের মনে ধারণা ছিল যে, চিতে ডাকাত একবার যদি দেবীর পূজা শেষ করে ফেলে, তাহলে দেবীর আশীর্বাদে সে অপরাজেয় হয়ে যায়, তখন সে অসাধ্য সাধন করতে পারে। চিত্রেশ্বরী মন্দিরে কিভাবে নরবলি বন্ধ হয়েছিল, সেটার উল্লেখ আগেই করেছি, এটা নিয়ে চিতে ডাকাত বড়োই অস্বস্তিতে ছিল। সেদিন রাতেও সে পূজায় বসেছিল। হঠাৎ চক্রপাণি দত্তের নির্দেশে নবাব আর কোম্পানির সশস্ত্র বাহিনী এসে গোটা মন্দির ঘিরে ফেললো। চিতে ডাকাতের যে সঙ্গীরা বাধা দিতে গেল, তাঁরা সেখানেই মরলো, বাকিরা প্রাণভয়ে পলায়ন করলো। চিতে ডাকাত সেদিন তাঁর দেবীপূজা শেষ করতে পারে নি। লোকে বলে, যদি সেদিন সে পূজা শেষ করতে পারত, তাহলে সেদিনও সে বেঁচে যেত। কিন্তু প্রাণভয়ে পালাতে গিয়ে চিতে ডাকাতও ধরা পড়লো। এরপরে যা হবার সেটাই হল। সেকালের বিধান ও শাস্তি অনুসারে তাঁকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
শ্রীরামপুরের রেভারেন্ড ওয়ার্ড সাহেব তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থেও চিৎপুরে নরবলির উল্লেখ রেখে গিয়েছেন –
“At Chit-poore near Calcutta, it is said that human sacrifices have been occasionally offered. A respectable native assured me that at Chit-poore near the image of Chittreswaree, about the year 1788, a decaplated body was found, which in the opinion of the spectator has been evidently offered on the preceding night to this Goddess.” (History, Literature and Religion of the Hindoos – W. Ward)
চিতু ডাকাতের পরলোকপ্রাপ্তি হবার পর থেকে দেবী চিত্তেশ্বরীর দারুবিগ্রহ (নিম কাঠের তৈরি বিগ্রহ) জঙ্গলে পড়ে রইলো, বন্ধ হল তাঁর পূজা-পাঠ। এইরূপে বহুবৎসর অতিক্রান্ত হবার পরে নৃসিংহ ব্রহ্মচারী নামে জনৈক তান্ত্রিক সাধু ভাগীরথী তীরে চিৎপুরের বনে সাধনা করতেন। সেখানে স্থানীয় মৎসজীবিরা গঙ্গায় মাছ ধরতেন ও তাঁরা সাধুর অনুগত ভক্ত ছিলেন। সাধু সেখানে তারাচক্র আসন স্থাপনা করার পরে একদিন গভীর রাত্রে দেবী চিত্তেশ্বরী তাঁকে জঙ্গল থেকে বের করে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য স্বপ্নে নির্দ্দেশ দেন। পরেরদিন বহু অনুসন্ধান করবার পর দেবীকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে তাঁর দারুমূর্ত্তিতে পুনরায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়। দেবী চিত্তেশ্বরীর মূর্ত্তি উদ্ধারের সময় নৃসিংহ ব্রহ্মচারী দেবীর বক্ষস্থলে আটটি চরণে লেখা দুটি শ্লোক দেখতে পান। তিনি সেই মন্ত্রে দেবীর পূজা করেন এবং আজও সেই গুপ্ত মন্ত্রে চিতু ডাকাতের পূজিতা চিত্তেশ্বরী দুর্গাদেবীর পূজা হয়ে থাকে।
ভাগীরথী তীরবর্তী কাশীপুরের উক্ত জঙ্গলাকীর্ণ স্থান মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম জমিদার শ্রী মনোহর ঘোষের জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত ছিল। বসতি স্থাপনের জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করবার সময় সাধুকে দুর্গাপূজা করতে দেখে কর্ম্মচারীগণ তাঁকে স্থান পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দ সাধুর অলৌকিক শক্তি সম্পর্কে জমিদারকে অবগত করলে তিনি দেবীর জন্য ৩৬ বিঘা জমি সাধুলে ব্রহ্মোত্তর দান স্বরূপ করেন এবং মনোহর ঘোষই দেবী চিত্ত্বেশ্বরীকে প্রথমবার কুটির থেকে একটি মন্দির স্থাপন করে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর নির্মিত পুরানো মন্দির ভগ্নাবস্থা প্রাপ্ত হলে ১৫৮৬ খ্ৰীস্টাব্দে কাশীপুর নিবাসী স্বর্গীয় কুমার শ্রী কালীকৃষ্ণ রায় বাহাদুরের বণিতা শ্রীমতী সূর্য্য রাণি দাসী বর্ত্তমান মন্দিরটি নির্ম্মাণ করে দেন বলে একটি ফলকে উৎকীর্ণ আছে।
শ্বেতপ্রস্তর মন্ডিত বিরাট নাটমন্দির মধ্যে এই দেবীকে ভূসম্পত্তি প্রদান সম্বন্ধে নিম্নলিখিত কথাগুলি আরেকটি ফলকে উৎকীর্ণ আছে –
“শ্রীশ্রীচিত্ত্বেশরী দুর্গাদেবী ৩৫৬ বৎসর পূর্ব্বে শ্রীচৈতন্য অন্তরঙ্গ পার্ষদ অগ্রদীপের ও ঘোষ পাড়ার বাসুদেব ঘোষের বংশধর বর্দ্ধমান ও মুর্শিদাবাদ জেলার সীমানায় কুলাই গ্রামের জমিদার মোনহর ঘোষ ও তাঁহার পত্নী শেওড়াফুলি রাজার কন্যা উভয়ে ১৫৮৬ খ্রীষ্টাব্দে এই চিত্তেশ্বরী দেবীর মন্দির স্থাপন করিয়া কিছু ভূসম্পত্তিসহ তদীয় সেপবায়েত মহান্ত নৃসিংহ ব্রহ্মচারীকে দান করেন। পূর্ব্বে চিতু ডাকাত এই দেবীকে পূজা করিতেন।”
দেবীর প্রধান সেবায়েত এই বিধান করে যান যে, তাঁর শিষ্যগণের মধ্যে যিনি সবায়েত হবেন তাঁর জ্যোতিষশাস্ত্রে বুৎপত্তি থাকবে এবং তিনি বিবাহ করতে পারবেন না। সাত পুরুষ ধরে পরম্পরাগত ভাবে সেই নিয়ম পালিত হয়। কিন্তু অষ্টম সেবায়েত, শ্রী শ্যামসুন্দর ব্রহ্মচারী সর্ব্বপ্রথম বিবাহ করেন ও তাঁর দুইটি কন্যাসন্তান হয়। কনিষ্ঠা কন্যা ক্ষেত্রমণির সঙ্গে হালিশহর নিবাসী আনন্দমোহন রায়চৌধুরীর বিবাহ হয় ও তাঁদের পুত্রদ্বয়ের নাম চন্ডীচরণ ও তারাচরণ রাখা হয়। ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দে চন্ডীচরণের সময়কালে, তৎকালীন ইংরেজ সরকার কাশীপুরে কামান ও গোলাবারুদ প্রস্তুত করার কারখানা প্রস্তুত করবার জন্য ভূমিসংস্কার আইনানুসারে চিত্ত্বেশ্বরীর ২৪ বিঘা জমি নিয়ে কাশীপুরস্থ গঙ্গাতীরে “কাশীপুর গান শেল ফ্যাক্টরি” প্রতিষ্ঠা করেন। চন্ডীচরণের পর তাঁর ভ্রাতা তারাচরণ ও তারপর তৎপুত্র পঞ্চানন সেবায়েত হন। তিনি অকালে একপুত্র ও দুই কন্যা রেখে পরলোকগমণ করলে তাঁর স্ত্রী ব্রহ্মচারিণী বিল্বমাতা দেবী সেবার ভার গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্রের নাম রবীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী।
(তথ্যসূত্র:
১- পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘোষ তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ১৭১-১৭৪।
২- বাংলার ডাকাত, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান (২০১২)।
৩- বাংলার ডাকাত, ধীরেন্দ্রলাল ধর, দে’জ পাবলিশিং (২০১৭)।
৪- বাংলার ডাকাত, খগেন্দ্রনাথ মিত্র।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত