১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ। মার্চ মাসের মাঝামাঝি এক ভোর। হালকা কুয়াশায় ঢাকা নির্জন ঝিলাম নদীর ঘাটে একখানি নৌকা দেখা যায়। সে নৌকায় কালো রঙের চাদরে মুড়ি দিয়ে বসে আছে একজন মাঝবয়েসি মাঝি। স্পষ্টই বোঝা যায় যে মাঝিটি যাত্রীর অপেক্ষায় রয়েছে। মাঝির মুখ ভরতি কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় একটি সাদা রঙের উলের টুপি। মাঝির কোলে একটি সাত/আট বছর মেয়ে চুপ করে বসে আছে। মেয়েটির ছোট্ট শরীরে একখানি ধূসর রঙের ময়লা চাদর জড়ানো । মাথায় বেগুনি রঙের উলের টুপি।
নদী পাড়ের কুয়াশার ভিতর যেন পাশাপাশি দুটি আবছা ছায়ামূর্তি দেখা যায়।
মাঝিটি সে দিকে তাকাল। হাতে বৈঠা তুলে নেয় মাঝি।
একটু পরেই দু’জন তরুণ সন্ন্যাসী কে দেখা যায়। তারা ঘাটে নেমে নৌকার গলুইয়ের খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। সন্ন্যাসীদের পরনে হলুদ রঙের গেরুয়া বসন; মাথায় হলুদ পাগড়ী।
… মাঝির জানার কথা নয়- এ দু’জন তরুণ সন্ন্যাসী বাঙালি। এদের একজন স্বামী বিবেকানন্দ, তখন বয়স ৩৫; অন্যজন স্বামী অক্ষদানন্দ। ইনি বয়েসে স্বামী বিবেকানন্দর চেয়ে বছরখানেক ছোটই হবেন। এরা দু’জনই ভারতবর্ষ সফর করছেন। বেদান্ত দর্শন অধ্যয়নের পাশাপাশি মানবীয় অভিজ্ঞতার ঝুলিটি পূর্ণ করে নিচ্ছেন। এদের দুজনের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ কে মুখখানি ভাবগম্ভীর এবং দৃষ্টি অর্ধ-মুদিত; সে কারণে তাঁকে কিছুটা অর্ন্তমুখীই মনে হয়; সেই তুলনায় স্বামী অক্ষদানন্দ যেন অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত আর জড়তামুক্ত …বাঙালি সন্ন্যাসী দু’জন বেশ কিছুকাল হল কাশ্মীরে অবস্থান করছেন। তাঁরা মেধাবী বলেই এরই মধ্যে স্থানীয় ভাষাটি মোটামুটি রপ্তও করে ফেলেছেন …
স্বামী অক্ষদানন্দ মৃদু হেসে সুমধুর কন্ঠে স্থানীয় ভাষায় মাঝিকে বললেন, আমাদের পাড় করে দাও গো মাঝি।
নৌকায় উঠে আসুন হজুর। মাঝিটি হেসে বলল। ভিনদেশির মুখে মায়ের ভাষা শুনে কার না ভালো লাগে! তাছাড়া গরীব মাঝি সে। তার উপর তার মাতৃভূমিটি দীর্ঘদিন হল ইংরেজরা দখল করে রেখেছে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রায়শ উদ্বিগ্ন থাকে সে। এই ভোরে দু’জন তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে মাঝির মনের উদ্বেগ দূর হয়ে যায়।
সন্ন্যাসী দু’জন ধীর প্রসন্ন ভঙ্গিতে নৌকায় উঠে এলেন। মুহূর্তেই নৌকায় রজনীগন্ধার মৃদু সৌরভ যেন ছড়িয়ে পড়ল। গভীর শ্বাস ফেলে নৌকার দড়ি খুলে নদীর শীতল জলে বৈঠা নামায় মাঝি । মাঝির কোলে বসে থাকা ছোট্ট মেয়েটি দুজন যাত্রীর দিকে অপলক চোখে চেয়ে আছে।
স্বামী অক্ষদানন্দ মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি নাম হে তোমার?
আমার নাম ইব্রাহীম হজুর। বৈঠা বাইতে বাইতে মাঝি বলল। মৃদু ছলাত শব্দ শোনা যায়। সেকালে ঝিলাম নদীর গন্ধ আজকের দিনের মতো আঁষটে হয়ে ওঠেনি সম্ভবত।
আর এইটে বুঝি তোমার মেয়ে?
ইব্রাহীম মাঝি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হজুর । ও আমার মেয়ে। ওর তো মা নেই, তাই হজুর সারাদিন ও আমার সঙ্গেই থাকে।
অলখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন স্বামী বিবেকানন্দ। আহ্, এই অনাথ বালিকাটির তাঁর মাকে দেখতে পায় না। সেই দেখতে না- পাওয়ার গভীর শূন্যতা অনুভব করলেন তিনি। জগতে জীবের এই কষ্ট … ভাবতেই সমগ্র জগতের জীবের কষ্ট যেন মুহূর্তে অনুভব করলেন ওই তরুণ যোগী। তারপর মুহূর্তেই সচেতন হয়ে উঠলেন। ইব্রাহীম মাঝির দিকে তাকিয়ে জলদ মধুর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কি নাম ওর?
এতক্ষণে তরুণ মুসাফিরের ভরাট কন্ঠস্বর শুনে ইব্রাহীম মাঝি মুগ্ধ হয়ে গেল। মুসাফিরের ভরাট মুখটি কেমন নূরানি। সে নূরানি মুখে বড় বড় দুটি স্পষ্ট আয়ত চোখ। তরুণ মুছাফির যে সামান্য লোক নয়- মস্ত বড় কামেল দরবেশ, সেটি ইব্রাহীম মাঝি তার নির্মল হৃদয়ের বিবেচনায় ঠিকই উপলব্দি করতে পারে। আর, তরুণ দরবেশ শীতে মোটেও কাহিল নয় দেখেও বিস্মিত হল সে। ইব্রাহীম মাঝি ভক্তিভরে বলল, ওর নাম সাবিহা হজুর।
সাবিহা? বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো। বলে গভীর অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন আয়ত চোখে সাবিহার মুখখানি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন স্বামী বিবেকানন্দ। সাবিহার ফরসা মুখটি ঈষৎ লম্বাটে। গালে হালকা লালের ছোঁয়া। বেগুনি রঙের উলের টুপি ছাপিয়ে সোনালি রঙের কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে পড়েছে। সাবিহার চোখ দুটি বড় বড়; ভারি নিষ্পাপ আর নীলাভ। মুখটি যেন এর আগে কোথাও দেখেছি …. হাজার বছর আগে যেন … যখন বিগত জন্মে বেঁচে ছিলাম সুপ্রাচীন শ্রাবস্তী নগরে … তার রোদজলের ভিতর … তার বৃষ্টির ভিতর … তার অন্ধকারের ভিতর … রূপশালী অন্নের ভিতর … অশ্বক্ষুরধ্বণির ভিতর … গোধূমের গন্ধের ভিতর … দেবালয়েরর আবছায়ার ভিতর … ধূপের গন্ধের ভিতর … সন্ধ্যালগ্নে … তখন … তখন এই কুমারী বালিকাটি কি আমায় স্নেহময়ী মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি? আশ্বিনের ভোরে আমাকে কি নদীপাড়ের উদ্যান থেকে একখানি জবা ফুল ছিঁড়ে দেয়নি পূজার উদ্দেশ্যে?
সহসা তরুণ সন্ন্যাসীর কেমন ঘোর লাগে। তিনি ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে থাকেন। তাঁর ভরাট গম্ভীর মুখে ফুঠে উঠতে থাকে প্রবল ভক্তির চিহ্ন। তিনি হাত জোড় করে সাবিহাকে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। যেন কোনও মাতৃসমা মহাদেবীকে প্রণাম করছেন এক নতজানু ভক্ত।
ওই দিব্য দৃশ্যটি দেখে স্বামী অক্ষদানন্দ প্রগাঢ় বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। এতকাল একসঙ্গে রয়েছি, কই, এর আগে এ রকম তো কিছু চোখে পড়েনি। স্বামী অক্ষদানন্দ মনে মনে ভাবলেন ।
ইব্রাহীম মাঝিও কম বিস্মিত হয়নি। তরুণ দরবেশ তাঁর কন্যা সাবিহাকে প্রণাম করছে বলে তার হৃদয়ে সে গভীর এক আনন্দের অনুভূতি টের পায়। এই মা মরা মেয়েটিই ইব্রাহীম মাঝির সব। আল্লাহ যেন মেয়েটির উপর অশেষ রহমত বর্ষন করেন- নামাজ আদায় করে এই দোয়াই সে করে। ইব্রাহীম মাঝির চোখের কোণটি জলে ভিজে উঠে।
কুমারী সাবিহার প্রতি প্রণামের ভঙ্গিতে আচ্ছন্ন ও স্থির হয়ে রইলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সম্পূর্ন আত্ববিস্মৃত হয়ে কুমারী সাবিহাকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করতে থাকেন ।সহসা তরুণ যোগীর কন্ঠ থেকে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হয় :
“সুসংকাশা মাতৃমৃষ্টেব যোষাবিস্তন্বং কৃণুষে দৃশে কম্ …”
স্বামী অক্ষদানন্দ জানেন শ্লোকটি ঋগ্বেদের ১/১২৩/১১ নং সূক্ত। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়,
“… যেন মায়ের নিজের হাতে সাজিয়ে দেওয়া সুরূপা কন্যাটি মানুষের দৃষ্টি সামনে নিজের তনু প্রকাশ করছে।”
নৌকার বাতাসে রজনীগন্ধার সৌরভ ঘন হয়ে উঠতে থাকে। আর সময় যেন থমকে গেছে – এরকমই বোধ হয় স্বামী অক্ষদানন্দের। তাঁর চোখের কোণে চিকচিক করছে দু ফোঁটা আনন্দের অশ্রু। জাতপাতের ভেদাভেদ সম্বন্ধে আজ তাঁর এক পরম অভিজ্ঞান হল: যা তাঁর ভবিষ্যতের দীর্ঘ মানবিক ও কল্যাণকর যাত্রাপথে দান করবে গভীর প্রত্যয় ।
এই শীত শেষের ভোরে ঝিলাম নদীর জল নিস্তরঙ্গ হয়ে রয়েছে।
সেই তরঙ্গশূন্য জলে মনের আনন্দে বৈঠা বায় ইব্রাহীম মাঝি ।
নৌকায় একজন নিষ্পাপ কাশ্মিরী কুমারী বালিকার উদ্দেশ্যে মাতৃজ্ঞানে অর্চনারত এক বাঙালি যোগী গভীর ধ্যানে নিমগ্ন …
যখন নদী ও নদীপাড়ের হালকা কুয়াশা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছিল অনাবিল সূর্যের আলো …
মাতৃপূজার প্রচলন পৃথিবীর বিভিন্নভাবে দেখা গেলেও ভারতবর্ষের মতো শক্তির সাধনা আর কোথাও দেখা যায়না। এখানে বহুরূপে শতনামে শক্তির আরাধনা হয়। দুর্গাপূজার সময় কিছু কিছু পূজামণ্ডপে দেবীর কুমারী রূপের পূজার আয়োজন করা হয়। মহাশক্তির বরেণ্য সাধক-সন্তান শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরীজী তাঁর শ্রীশ্রী দশমহাবিদ্যা গ্রন্থে নানাভাবে দর্শন করেছেন নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের প্রসূতী ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী আদ্যাশক্তি মা’কে।
তাঁর দৃষ্টিতে এই মা ব্রহ্মশক্তি ব্রহ্মময়ী, নির্গুণ ব্রহ্মের অচিন্ত্যগুণ প্রকাশিনী আদ্যাশক্তি সনাতনী, সমগ্র জীব-জগতের আশ্রয় স্বরূপ। নিষ্কলা হয়েও পরমাকলা-পরম ঐশ্বর্য্যময়ী। তাঁর বাণী- আকাশে আকাশবরণী নিত্য প্রকাশ ইনি যে দুহিতর্দিবঃ।। মাগো তুমি যে আকাশেরই মেয়ে! তুমি আকাশ ক্রোড়ে আকাশরাণী।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবী মাহাত্ম্য শ্রীশ্রী চণ্ডী নারায়ণীস্ততির পঞ্চদশ শ্লোকে রয়েছে- কুমারী রূপ সংস্থানে নারায়ণী নমোহস্তুুতে।। কুমারী কে? অপাপবিদ্ধা নিত্যশুদ্ধা সৃজনকারিণী ব্রহ্মশক্তি। কুমারী ব্রহ্মরূপিণী স্ত্রীশক্তি। এটির ইংরেজী প্রতিশব্দ নিষ্কল পবিত্র ও অসঙ্গা।
দেবী ভগবতে কুমারীর নামকরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে এক বছরের কন্যা পূজার যোগ্য নয়। দু’বছর থেকে দশ বছর পর্যন্ত কুমারীর পূজা হবে। কুমারী প্রসন্না হলে সাধকদের অভীষ্ট প্রদান করেন। এখানে বয়স অনুসারে নামকরণও পৃথক। দুই বৎসরের কন্যার নাম কুমারিকা, তিন বছরে ত্রিমূর্তি, চতুর্থ বর্ষীয়া কন্যা কল্যাণী, পঞ্চম বর্ষে রোহিণী, ছয় বছরে কালিকা, সপ্তম বর্ষে চণ্ডিকা, আট বছরের কন্যা সুভদ্রা, নয় বছর পর্যন্ত বয়সের কুমারী পূজার ফলও পৃথক পৃ্থক।
দু’বছরের কুমারীর পূজা দ্বারা দুঃখদারিদ্র ও শত্রুনাশ এবং আয়ু বৃদ্ধি হয়। ধনসম্পদ, ধান্যাগম, ও বংশবৃদ্ধি হয়। কল্যাণীর পূজা সাধককে বিদ্বান, সুখী এবং বিজয়ী করে। রোহিণীর পূজায় ধনেশ্বর্য লাভ। ষষ্ঠ বর্ষীয়া শঙ্করী, দুর্গা বা কালিকার অর্চনায় শত্রুরা মোহিত হয়, দারিদ্র ও শত্রু বিনষ্ট হয়। অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য সুভদ্রার পূজা বিধেয়। তন্ত্রে যে কোন বর্ণ ও জাতির কুমারীকে দেবী জ্ঞানে পূজার কথা বলা হয়েছে। জগৎজননীর অনন্য প্রকাশ এই কুমারীর মধ্যে। মাতৃশক্তি ছাড়া এই জগতে কোন প্রাণের সৃষ্টি কী সম্ভব!
কুমারী পূজা শারদীয়া দুর্গাপূজার এক বর্ণাঢ্য পর্ব। দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিন কুমারীপূজা উৎযাপন করা হয়।কুমারী পূজা সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে বেশ কৌতূহল দেখা যায়। বালিকা প্রতিমায় মহামায়ার পূজা ঈশ্বরের মাতৃভাবে আরাধনার ফলিতরূপ বলা যায়।
নারী জগদ্ধাত্রীর অংশবিশেষ। সমগ্র বিশ্বে তিনি মহামায়া রূপে প্রকাশিতা। প্রত্যেক নারীকে মাতৃভাবে ভাবনা মহামায়ার শ্রেষ্ঠ উপাসনা এবং নারী মর্যাদার সর্বোচ্চ বিধান।
কুমারী হলো দেবী দুর্গার পার্থিব প্রতিনিধি।সব নারীর মধ্যেই আছে দেবী দুর্গার শক্তি। তাই নারী পূজনীয়- এ দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কুমারীকে দেবীর আসনে বসিয়ে কুমারী পূজা করা হয়। এ যেন কুমারীরূপে বিশ্বের নারীশক্তি, বিশ্ব মাতৃশক্তির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন। দুর্গাপূজা ছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাসহ বিভিন্ন শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে।
ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছিলেন,
“দিব্যচক্ষু চাই। মন শুদ্ধ হলেই সেই চক্ষু হয়। দেখনা কুমারীপূজা। হাগা-মোতা -মেয়ে, তাকে ঠিক দেখলুম সাক্ষাৎ ভগবতী।” তিনি আরও বলেছেন,- “সারদা মা কে কুমারীর ভিতর দেখতে পাই বলে কুমারীপূজা করি।”
কুমারী হল শুদ্ধ আধার।
কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে।
প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয় তবে মতান্তরে নবমী পূজার দিনও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে।
সূদূর অতীত থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন ছিলো এবং তার প্রমাণ পাওয়া যায় “কুমারীপূজাপ্রয়োগ” গ্রন্থের পুথি থেকে।
যোগিনীতন্ত্র, কুলার্ণবতন্ত্র, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্ত্রসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হযে়ছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেযে়র পূজা করা যায়। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়।
১) এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা।
২) দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী।
৩) তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি।
৪) চার বছরের কন্যা — কালিকা।
৫) পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা।
৬) ছয় বছরের কন্যা — উমা।
৭) সাত বছরের কন্যা — মালিনী।
৮) আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা।
৯) নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা।
১০) দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা।
১১) এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী।
১২) বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী।
১৩) তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী।
১৪) চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনাযি়কা।
১৫) পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা।
১৬) ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা।
বৃহদ্ধর্মপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন। দেবীপুরাণে বিস্তারিত এ বিষয় উল্লেখ আছে। তবে অনেকে মনে করেন যে, দুর্গা পূজায় কুমারী পূজা সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনামতে। এক সময় শক্তিপীঠ সমূহে কুমারী পূজার রীতি প্রচলিত ছিল। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও কুমারীর কথা উল্লেখ আছে। আর এ থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে, দেবীর কুমারী নাম অনেক পুরনো। দেবীর কুমারী নাম যেমন পুরনো, তার আরাধনা ও পূজার রীতিনীতিও তেমনি প্রাচীন এবং ব্যাপক।
যোগিনীতন্ত্রে কুমারী পূজা সম্পর্কে উল্লেখ আছে ব্রহ্মাশাপবশে মহাতেজা বিষ্ণুর দেহে পাপ সঞ্চার হলে সেই পাপ থেকে মুক্ত হতে হিমাচলে মহাকালীর তপস্যা শুরু করেন। বিষ্ণুর তপস্যায় মহাকালী খুশি হন।দেবীর সন্তোষ মাত্রেই বিষ্ণুর পদ্ম হতে সহসা ‘কোলা’ নামক মহাসুরের আবির্ভাব হয়। সেই কোলাসুর ইন্দ্রাদি দেবগণকে পরাজিত করে অখিল ভূমণ্ডল, বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ এবং ব্রহ্মার কমলাসন প্রভৃতি দখল করে নেয়।তখন পরাজিত বিষ্ণু ও দেবগণ ‘রক্ষ’ ‘রক্ষ’ বাক্যে ভক্তিবিনম্রচিত্তে দেবীর স্তব শুরু করেন। বিষ্ণু ও আদি দেবগণের স্তবে সন্তুষ্টা হয়ে দেবী বলেন“হে বিষ্ণু! আমি কুমারীরূপ ধারণ করে কোলানগরী গমন করে কোলাসুরকে সবান্ধবে হত্যা করিব।” অতঃপর তিনি কোলাসুরকে বধ করলে-সেই থেকে দেব-গন্ধর্ব, কিন্নর-কিন্নরী, দেবদেবী গণ সকলে সমবেত হয়ে কুসুম-চন্দন-ভারে কুমারীর অর্চনা করে আসছেন।
পুরাণে আছে, ব্রহ্মার নির্দেশানুসারে শ্রীরামচন্দ্র দেবীপূজার আয়োজন করলেন। কিন্তু দেবী কি তখন জাগ্রত না নিদ্রিত? দেবী কি এখন আবির্ভূত হতে প্রস্তুত। তাই ধ্যানে খোঁজ নিলেন যে দেবী এখন কোথায় আছেন? ধ্যানমানসে উদ্ভাসিত হলেন দেবী এবং জানতে পারলেন যে, দেবী তখন কুমারীরূপে শায়িত আছেন বিল্বশাখায়। স্রষ্টা ব্রহ্মার নির্দেশ অনু্যায়ী শ্রীরামচন্দ্র শুক্লা ষষ্ঠীর সকালে কল্পারম্ভ এবং সন্ধ্যায় বিল্ব বৃক্ষমূলে শুরু করলেন দেবীর বোধন। ষষ্ঠীতে বোধিত হলেন দেবী। সপ্তমীতে ষোড়শোপচারে দেবীকে পূজা করলেন শ্রীরামচন্দ্র; কিন্তু তখন পর্যন্ত দেবীর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তখন অষ্টমী তিথিতে সকল যোগিনীদের ডেকে আবার সমস্ত পূজা-অর্চনা করে আরাধনা করা হল দেবীকে। দেবী তখনও কোন সাড়া দিলেন না। আগত যোগিনীদের হৈ-চৈ-তে দেবী তখন কেবল একটু নড়ে চড়ে পাশ ফিরে শয়ন করলেন। কিন্তু জাগ্রত হলেন না। তখন অষ্টমীর শেষ এবং নবমীর শুরুতে মহা সন্ধিক্ষণে করলেন দেবীর আবার বিশেষ পূজা। যাকে বলা হয় সন্ধিপূজা। অষ্টমীর ২৪ মিনিট এবং নবমীর ২৪ মিনিট নিয়ে মোট ৪৮ মিনিটের পূজা হল সন্ধিপূজা। সন্ধিপূজা হল দেবী চামুন্ডার বিশেষ পূজা। শ্রীরামচন্দ্র তখন চামুন্ডা দেবীকে আবাহন করে বললেন-যেভাবেই হোক দেবী দুর্গাকে জাগাতে হবে। চামুন্ডার সহযোগীতায় দেবী তখন জেগে উঠলেন নবমী তিথিতে। শ্রীরামচন্দ্র দেবীকে যোগিনীদের সঙ্গে বিশেষ পূজা করলেন। এবং দেবীকে দর্শন করলেন কুমারীরূপে। সেই থেকে কুমারীরূপী দেবীপূজা শুরু। শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গাকে একসঙ্গে একশ আটটি নীলপদ্ম অঞ্জলি দিলেন এবং দেবী নবমীর দিন কুমারীরূপে পূজিতা হলেন।
মহাভারত অনুসারে, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন কুমারী পূজা করেন। শ্বেতাশ্বর উপনিষদেও কুমারী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া প্রাচীন শাস্ত্র ও গ্রন্থ থেকে নেপাল, ভুটান ও সিকিমেও কুমারী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়।
স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা করেন ১৮৯৮ সালে, তাঁর কাশ্মীর ভ্ৰমনকালে। তিনি যখন ১৮৯৮ সালে কাশ্মীর ভ্রমণে গেছিলেন, তখন তিনি এক মুসলমান মেয়েকে কুমারীপূজা করেছিলেন। শাস্ত্ররীতিতে ব্রাহ্মণ কন্যাকেই কুমারীপূজার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি সমস্ত রীতির উর্ধ্বে গিয়ে পূজা করেছেন মুসলমান -কন্যাকে। তিনি জাতপাতের উর্ধ্বে দেবী দর্শন করেন। দেবীত্ব কেবল ব্রাহ্মণত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বা দেবীত্ব ও মাতৃ্ত্ব কারোর একচেটিয়া সম্পদ নয়। মাতৃত্ব ও দেবীত্ব প্রতিটি নারীর আজন্ম সম্পদ। স্বামীজির ধ্যানে ও দর্শনে তা প্রমাণিত। তাই তিনি মুসলমান -কন্যার মধ্যে দেবীত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন দর্শকদের, যেদিকে তাকাচ্ছি দেখছি কেবল মা’র মূর্তি। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন দর্শকরা স্বামীজির ভাবমূর্তি দেখে।
১৮৯৯ সালে তিনি কন্যাকুমারী শহরে ডেপুটি একাউণ্ট্যাণ্ট জেনারেল মন্মথ ভট্টাচার্যের কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করেছিলেন।
১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ, বেলুড় মঠে দুর্গা পূজা ও কুমারী পূজা শুরু করেন। ১৯০১ সালে বেলুড় মঠের প্রথম কুমারী পুজায় স্বামী বিবেকানন্দ নয় জন কুমারী কে পূজা করেন। এখন বেলুড়মঠে একজনকেই করা হয়ে থাকে। এটাই নাকি শাস্ত্রীয় রীতি। স্বামীজির দিব্যদৃষ্টিতে সকল কুমারীই দেবীর এক-একটি রূপ। সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি পূজা করেছিলেন ৯ জন কুমারীকে। স্বামীজি প্রতিটি কন্যাকে ভক্তিভরে পূজা করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেছিলেন শ্রদ্ধাভরে। এই নয়জন কন্যার মধ্যে একজন ছিলেন গৌরীমার পালিতা কন্যা দুর্গামা। যাঁর কপালে টিপ পরাতে গিয়ে স্বামীজি ভাবাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। চন্দনের টিপ পরানোর সময় তিনি ভাবে শিহরিত হয়েছিলেন। আবেগভরে তিনি বলেছিলেন, “আঃ! দেবীর বোধ হয় তৃ্তীয় নয়নে আঘাত লেগে গেল।” তাঁর দৃষ্টি ঠিকই। আমাদের দুটো চোখ থাকলেও, তৃ্তীয় চোখ থাকে দেবী দুর্গার। তিনি সেই কুমারীর মধ্যে তৃ্তীয় নয়ন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে তিনি যেমন ‘সেদিন দুর্গারূপে প্রতিষ্ঠিতা’- পরবর্তীকালেও সেই কন্যা দুর্গামা নামে পরিচিতা হয়েছিলেন। স্বামীজির স্নেহধন্যা ছিলেন এই কন্যা। স্বামীজির কুমারীপূজায় যেন সত্যিই সত্যি ঠিক ঠিক দুর্গামারূপে তিনি পরিগণিতা হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘দুর্গামা’ অধ্যক্ষারূপে প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন সারদেশ্বরী আশ্রমে। স্বামীজির অন্তর্দৃষ্টি যেন বাস্তবায়িত হয়েছিল এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। অবশ্য এই নয়জন কুমারীর মধ্যে দুর্গামা যেমন ছিলেন, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাইপো রামলালদাদার কনিষ্ঠা কন্যা রাধারানীও ছিলেন। স্বামীজি এই পূজার দ্বারা যেন একটা নূতন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। সমস্ত নীতির উর্ধ্বে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক নূতন নীতি। তিনি নারীজাতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিদর্শন করেছেন এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, ইদানীং যে দুর্গাপূজার সময় জীবন্ত কন্যাকে কুমারীপূজা করার প্রচলন তা স্বামীজিরই আবিষ্কার বা তিনিই এর প্রচারক।
অন্য একটি ঘটনার মধ্যে আমরা পাই তাঁকে দিব্যভাবের পূজক হিসাবে। তিনি তখন উত্তর প্রদেশের গাজীপুরে (খুব সম্ভবত ১৯০০ সাল)। সেখানে এক প্রবাসী বাঙালির কুমারী মেয়েকে কুমারীপূজা করেছিলেন। সেই মেয়েটির নাম ছিল মণিকা। পরবর্তীকালে এই মণিকাদেবী হয়ে উঠেছিলেন যশস্বিনী সন্ন্যাসিনী। এ যেন স্বামীজির ঐ দিব্য বীজের বপন, যেন অনাঘ্রাত কুসুমকে দেবসেবায় উৎসর্গ করা। যথার্থ তাঁর দেবী দর্শন। কুমারীপূজায় উৎসর্গীকৃ্তা মণিকা যেন দেবীমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিতা। এই মণিকাদেবী শেষজীবনে সন্ন্যাসিনী হয়ে যশোদা-মাঈ নামে পরিচিতা হয়েছিলেন জগতে। এও স্বামীজির এক অন্য আবিষ্কার।
কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশব ব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে; তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। পৌরাণিক কল্পকাহিনিতে বর্ণিত আছে, এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
কালের অতলে দুর্গাপূজায় কুমারীপূজা হারিয়ে গেলেও স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ১৯০১ সালে বেলুড় মঠে কুমারী পূজা পুনঃপ্রচলন করেন। এর পেছনে স্বামীজির মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। তখনকার সমাজ নারীকে যথাযথ মর্যাদা দিত না। যার কারণে সমাজে নারীর অবস্থান ছিল খুব দুর্বল।
স্বামীজি অনুভব করেছিলেন, দেশ তথা জাতির উন্নতিকল্পে নারী-পুরুষ উভয়েরই অংশগ্রহণ করা একান্ত জরুরি। আর সেই কারণে নারী যাতে তার যথাযথ মর্যাদা পায় -তার জন্যই নারীকে পূজা করা। ভারতবর্ষের সন্ন্যাসীরা সাধন পথের বাধা হিসেবে বিবেচনা করে নারী জাতিকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু অত্যন্ত সচেতনভাবে নারী জাতির কথা চিন্তা করেছেন, কারণ যদি নারী এবং পুরুষ উভয়েই জীবনে সমানভাবে এগিয়ে না যায়, তবে দেশ বা জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন সম্ভব নয়। কুমারী পূজা একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া হলেও এটি আধ্যাত্মিক উপলব্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
কুমারী কথার সাধারণ অর্থ কন্যা। দেবী পুরাণ মতে, কুমারী দেবীরই প্রতীক। কুমারী পূজার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে বৃহদ্ধর্ম পুরাণে উল্লেখ পাওয়া যায়, দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন। দেবী পুরাণে বিস্তারিত এ বিষয়ে উল্লেখ আছে। তবে অনেকে মনে করেন, দুর্গাপূজায় কুমারী পূজা সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনামতে।
বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে কোনো কুমারীই পূজনীয়। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। তবে অন্য জাতির কন্যাকেও কুমারীরূপে পূজা করতে বাধা নেই। অবশ্যই অব্রাহ্মণ কন্যায়ও অতি উত্তম কুমারী পূজা হবে। কুমারী মানেই সর্ববিদ্যা স্বরূপা।
দুর্গাপূজায় কুমারী পূজার দিন সকালে পূজার জন্য নির্দিষ্ট কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় এবং ফুলের গহনা ও নানাবিধ অলংকারে তাকে সাজানো হয়। পা ধুয়ে পরানো হয় আলতা, কপালে এঁকে দেওয়া হয় সিঁদুরের তিলক, হাতে দেওয়া হয় মনোরম ফুল।
কুমারীকে মণ্ডপে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা হয় বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য ও পূজার নানাবিধ উপাচার। তারপর কুমারীর ধ্যান করতে হয়। প্রতিমায় দেবীর পূজাতে আংশিক ফল হয়, কিন্তু কুমারীতে দেবীর প্রকাশ উপলব্ধি করে তার পূজায় পরিপূর্ণ ফল পাওয়া যায়।
কুমারীর পূজা নয়। কুমারীতে পূজা। কুমারীতে ভগবতীর পূজা। এটি একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানব বন্দনা, আর নারীর মর্যাদা। নারীর সম্মান, মানুষের জয়গান আর ঈশ্বর আরাধনাই কুমারী পূজায় অন্তর্নিহিত।
(তথ্যসূত্র:
১- ড. আর. এম দেবনাথ তাঁর ‘সিন্দু থেকে হিন্দু’ বইতে লিখেছেন: “রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাণপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) ১৮৯৮ সালে কাশ্মীরে একটি সাত-আট বছরের মুসলমান মেয়েকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেন। (কৃষ্ণ কুমার দাস:প্রবন্ধ: কুমারী যখন দেবী: সংবাদ প্রতিদিন: কলকাতা: ২৬.৯.৯৮)। এই নিষ্পাপ ও পবিত্র মেয়েটি ছিল মাঝির কন্যা।” (পৃষ্ঠা, ৯০)
২- সুসংকাশা মাতৃমৃষ্টেব যোষাবিস্তন্বং কৃণুষে দৃশে কম্ … ঋগ্বেদের এই মন্ত্রটি (১/১২৩/১১) রয়েছে সুকুমারী ভট্টাচার্যের ‘প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য’ (পৃষ্ঠা ২৫) বইতে ।
৩- কুমারী পূজা, তারাপদ আচার্য, তরফদার প্রকাশনী।
২- স্বামী বিবেকানন্দ নতুন তথ্য নতুন আলো, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
৪- যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ, অলোককুমার সেন, গীতাঞ্জলি (২০১২)।
৫- ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ, অমলেশ ত্রিপাঠী, আনন্দ পাবলিশার্স।
৬- দুর্গা রূপে রূপান্তরে, পূর্বা সেনগুপ্ত,মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত