(ছবিতে – মহিষাসুরমর্দিনী, খ্রিস্টীয় ১৮৩০-৩৫ সালের মধ্যে মহিশুর অঙ্কনশৈলী তে অংকিত তৈলচিত্র।
ছবি সৌজন্যে: ব্রিস্টল মিউজিয়াম অফ আর্টস, ব্রিস্টল, ইউনাইটেড কিংডোম।)
ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্থান অথবা পৃথিবীতে দুর্গোৎসবের কালক্রমিক ইতিহাস নির্মাণ করা এখনো সম্ভব হয়নি। এ কাজের উপযোগী সুস্পষ্ট ও অনুপুঙ্খ ধারাবাহিক তথ্য-উপাত্তও পাওয়া যায়নি। কোনো ইতিহাসবিদ বা সমাজবিজ্ঞানী ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীতে দুর্গোৎসবের উদ্ভবের ইতিহাস ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপঞ্জি নির্ভরযোগ্য দলিলপত্র ঘেঁটে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি। ফলে কখন, কীভাবে দুর্গোৎসব শুরু হলো তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে পূরাণ, মহাভারত, রামায়ন, ধর্মীয় কাব্য, নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও সূত্র থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
কৃষির সঙ্গে শারদীয়া দুর্গাপূজার নিবিড় সম্পর্ক আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় রঘুনন্দনের ‘দুর্গোৎসব তত্ব’-এ। এ পূজাতে সারা গায়ে লতাপাতায় সাজিয়ে ও কাদামাটি মেখে উৎসবে অংশগ্রহণ করা হতো। দুর্গাপূজার সঙ্গে মিলে আছে অরণ্য ও কৃষি সংস্কৃতির ধারা। দুর্গাপূজার সঙ্গে কৃষি সম্পর্কের প্রমাণ মেলে দুর্গোৎসব তত্ত্বে রঘুনন্দনের ‘ধত ভবিষ্য’ বচনে। রামপ্রসাদ চন্দের লিখিত ‘দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে,
‘…সুতরাং দুর্গা যদি মূলত শস্য প্রসবিনী দেবী হন তবে মহিষাসুরকে শস্য নামক বন্য পশুর এবং অনাবৃষ্টির বিগ্রহ মনে করা যাইতে পারে। সুতরাং মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার মুখ্য উদ্দেশ্য হইতেছে শস্য উত্পাদনের এবং রক্ষার জন্য বসন্তে এবং শরতে শাকম্ভরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং আনন্দ উৎসব।’
দুর্গা পূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল–তা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতা শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারনা। ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারনা অতি প্রাচীন। ইতিহাস থেকে প্রমান পাওয়া যায়, প্রায় ২২,০০০ বছর পূর্ব ভারতে প্যালিওলিথিক জন গোষ্ঠি থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি, তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তার নেতৃত্বে শত্রু নাশ হয়, আর তাই মাকে সামনে রেখে দেবী বিশ্বাসে গড়ে উঠে, গড়ে ওঠে শাক্ত সম্প্রদায় মত। এই মত অনুসারে দেবী হলেন, শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্ব সৃষ্টির আদি কারণ। অনান্য দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র। মহাভারত অনুসারে, দুর্গা বিবেচিত হন কালী শক্তির আরেক রূপে। নানা অমিল ও বৈচিত্র থাকা সত্বেও কিভাবে কালী দূর্গার রূপের সাথে মিশে এক হয়ে গেল সে রহস্য আজো অজানা। কেউ কেউ ধারনা করেন, সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা) দেবীমাতার, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দুর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী, সে হিসাবে অথবা দেবী মাতা হিসাবে পূজা হতে পারে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দুর্গা পূজার প্রথম প্রবর্তক কৃষ্ণ, দ্বিতীয় বার দুর্গা পূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার দুর্গা পূজার আয়োজন করেন মহাদেব। আবার দেবী ভাগবত পুরান অনুসারে জানতে পারি, ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন। মূল বাল্মীকির রামায়ণে, দুর্গা পূজার কোন অস্থিত্ব নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়নে দুর্গাপূজার অস্থিত্ব আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটি মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎলালীন সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ, গল্প বাংলা রামায়ণে ইচ্ছাকৃতভাবে (নাকি গৌড়েশ্বর বা অন্য কারও অনুরোধে?) ঢুকিয়ে বাংলা রামায়ণ আরো অধিক সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের এমনভাবে বঙ্গীকরণ বা বাঙালীকরন করেন, যা পড়লে মনে হবে, রামায়নের ঘটনা তাঁর সমাজের আদি কাহিনী।
তাঁর এই অনুবাদকৃত রামায়ণ পরিচিত পায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে, যা বাংলাভাষী হিন্দু সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা পায়, সেখানে তিনি কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দুর্গা পূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। শক্তিশালী রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালে শ্রী রাম চন্দ্র দেবীদহ সাগর থেকে ১০১ টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে প্রাক্ প্রস্তুতি হিসাবে দুর্গা পূজা করে দুর্গার কৃপা লাভ করেন বলে কৃত্তিবাস ওঝা বর্ণনা করেছেন। তবে দুর্গা পূজার সব চাইতে বিশদ বর্ননা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরানে। যেখানে মহির্ষী জৈমিনি ও মহির্ষী মার্কণ্ডেয়র কথোপকথনের ভিত্তিতে পুরাণটি রচিত হয়। এই পুরাণের মধ্যে তেরটি অধ্যায় দেবীমহাত্ম্যম নামে পরিচিত। বাংলায় শ্রীশ্রী চন্ডি নামে সাতশত শ্লোক বিশিষ্ট দেবী মহাত্ম্যম পাঠ আছে, যা দুর্গা পূজার প্রধান ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পূজার আসরে স্থায়ী হয়ে গেছে ।
সনাতন ধর্মের আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন। মার্কণ্ডেয় পুরান মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথ খ্রীষ্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িষ্যা) দশেরা নামে দুর্গা পুজা প্রচলন করেছিল। অধুনা নেপাল রাষ্ট্রেও দশেরা বা দাশিন নামেই পুজা হয়। যদিও প্রাচীন উড়িষ্যার সাথে নেপালের পূজার যোগসূত্র আছে কিনা সে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। পুরাণ মতে, দুর্গা পূজার ইতিহাস আছে কিন্ত ভক্তদের কাছে সেই ইতিহাস প্রামানিক নয়, বিশ্বাসের।
পরিব্রাজক, বৌদ্ধ পন্ডিত হিউয়েন সাংকে নিয়ে দুর্গাপূজার একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। চীনা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাখায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের মূল পান্ডুলিপি সংগ্রহে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সফরে আসেন। ভারত বর্ষের নানা বিহারে বিদ্যা অর্জন করেন। ৬৩৫-৬৪৩ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর তিনি হর্ষবর্ধনের রাজ সভায় ছিলেন। তবে তাঁর কাহিনী দূর্গা, কালী, কালীর আরেক রূপ চন্ডি নাকি বন দেবীকে নিয়ে, তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে তিনি তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছেন, হর্ষবর্ধনের সময়ে দস্যু তস্করের উপদ্রব খুব বেশি ছিল এবং তিনি নিজেও একাধিক বার দস্যুদের হাতে নিগৃহিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রবাস জীবনের কোন এক সময়ে গঙ্গাপথে (প্রাচীন গঙ্গারিডি) এই পরিব্রাজক কোনও বৌদ্ধ বিহারে যাচ্ছিলেন, পথে দস্যুর কবলে পড়লেন। দস্যুরা তাঁকে বন্দি করে দেবী দুর্গার সামনে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। কেউ মনে করেন, বন দেবী, কেউ মনে করেন কালী, কারণ প্রাচীনকালে নরমুন্ড ভোগ দেবার বিষয়টি বনদেবী বা কালী দেবীর জন্য প্রযোজ্য ছিল, যা এখন পাঁঠা দিয়ে পূরণ করা হয়। দুর্গা মা’কে খুশী করার জন্য নরমুণ্ড ভোগ দেবার বিষয়টি ইতিহাস থেকে জানা যায় না। তবে ইতিহাস বলে কলকাতার চিতু ডাকাত তাঁর আরাধ্য দুর্গা চিত্তেশ্বরী কে নরমুণ্ড উপহার দিতেন। যাই হোক, যখন বলির পূর্ব প্রস্তুতি প্রায় শেষ, এমন সময় প্রচন্ড বেগে ঝড় ছুটে এল। সব আয়োজন ঝড়ের কবলে লন্ডবন্ড হয়ে গেল। ডাকাতরা প্রাণ বাঁচাতে পালাতে লাগল। সেই সুযোগে হিউয়েন সাংও পালিয়ে যান।
মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গা পূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দুর্গার, যা সংস্কারের ফলে মূল চেহারা হারিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন গঠনশৈলী বৌদ্ধ মন্দিরের মত। মনে করা হয়, খ্রিস্টীয় দশম শতকে এখানে বৌদ্ধ মন্দির ছিল, পরবর্তীতে কিভাবে সেন আমলে হিন্দু মন্দিরে তা রূপান্তরিত হয়েছিল, তা ইতিহাসে লেখা নেই। খ্রিস্টীয় ১১শ বা ১২শ শতক থেকে সেখানে কালী পূজার সাথে দূর্গা পূজাও হত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণ শৈলীর সাথে এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। তবে বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠন ও স্থাপনার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং সেখানেও কালী পূজার সাথে দুর্গা পূজা হত।
খ্রিস্টীয় ১১শ শতকে ‘অভিনির্ণয়’-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির ’দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’তে দূর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বঙ্গে খ্রিস্টীয় ১৪শ শতকে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল কিনা ভালভাবে জানা যায় না। ঘটা করে দুর্গা পূজা চালুর আগে কিছু কিছু উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের গৃহকোণে অত্যন্ত সাদামাঠা ভাবে ঘরোয়া পরিবেশে এই পূজা চালু ছিল। আর ঘটা করে দুর্গা পূজার ইতিহাস, খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। তবে কখন থেকে ঘটা করে এই পূজা চালু হল, তা নিয়ে পরিষ্কার বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোন প্রমান পাওয়া যায় না। যতটুকু জানা যায় তা হল, কারো মতে, ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দূর্গা পূজা করেন। আবার কারো মতে, ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গা পুজা করেন। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কোচবিহারে দুর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দুর্গা পূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দুর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার দুর্গার ছেলে মেয়ে সহ সপরিবারে পূজা চালু করেন।
১৬১০ সাল থেকে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার বড়িশায় তাঁদের আদি বাসভবনে দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছেন। এটিই সম্ভবত কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গোৎসব। বর্তমানে এই পরিবারের সাত শরিকের বাড়িতে সাতটি দুর্গাপূজা হয়। এগুলির মধ্যে ছয়টি বড়িশায় ও একটি বিরাটিতে।
১৭১১ সালে অহম রাজ্যের রাজধানী রংপুরের শারদীয়া পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার।
নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লার আক্রমনে কলকাতার একমাত্র চার্চ ধ্বংশ হবার পর সেখানে কোন উৎসব করার অবস্থা ছিল না। পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নব কৃঞ্চদেব লর্ড ক্লাইভের সন্মানে দূর্গা পূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন।
পলাশীর যুদ্ধের চৌদ্দ বছর বাদে, ১৭৭১-এ, হলওয়েল সাহেব কলকাতার দুর্গাপূজাকে বলেছিলেন ‘গ্র্যান্ড জেনারেল ফিস্ট অব জেন্টুস’। এই গ্র্যান্ড জেনারেল ফিস্ট’-এর বাংলা করেছেন বিনয় ঘোষ ‘সবচেয়ে জমকালো উৎসব’। সেকালের কলকাতায় বাবুদের বাড়িতে দুর্গা ঠাকুর দেখার অধিকার আর সুযোগ সবার ছিল না। কেবল অতিথিরা সেখানে প্রবেশ করতে পারতেন। দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকত বাড়ির গেটে, হাতে চাবুক নিয়ে। অতিথি ছাড়া আর কেউ বাড়ির মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করলেই দারোয়ান তাকে চাবুক মারত। ফলে ঠাকুর দেখতে গিয়ে চাবুক খেয়ে ফিরে আসতে হতো গরিব-দুখীদের। অথচ সাহেবদের জন্য ছিল আপ্যায়নের বিপুল ব্যবস্থা। দুর্গোৎসব বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয় এই উৎসব সার্বজনীন হওয়ার পর। অথচ সার্বজনীন দুর্গাপূজা চালু হলে সাধারণ মানুষের কাছে এই পূজার আকর্ষণ বাড়ে। প্রথমে বাড়ির পূজা, তারপর বারোয়ারি পূজা, আর সবশেষে এসেছে সার্বজনীন পূজা।
১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপূজা শুরু করেন। তাঁর নির্দেশিত পথেই দুর্গাপূজা পরবর্তীকালে কলকাতার ধনিক বাবু সম্প্রদায়ের মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। শাস্ত্রাচার এই সব পূজায় গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যে পূজায় যত বেশি সংখ্যক আমন্ত্রিত ইংরেজ অতিথি উপস্থিত হতেন, সেই পূজার মর্যাদা ততই বাড়ত। দেবীপ্রতিমার সম্মুখেই মুসলমান বাইজি নাচের আসর বসত। ইংরেজরা এসে নাচগান করতেন, তাঁদের জন্য উইলসন হোটেল থেকে গোরু ও শূকরের মাংস আনানো হত এবং মদ্যপানের আসরও বসত। রানি রাসমণি এই প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে শুদ্ধাচারে তাঁর জানবাজারের বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করেন। তিনি ইংরেজ অতিথিদের চিত্তবিনোদনের বদলে তাঁর দেশীয় প্রজাদের বিনোদনের জন্য পূজা উপলক্ষে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ১৮৬১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর রানির জামাতাগণ নিজ নিজ বাসভবনে রানির প্রদর্শিত পথেই দুর্গাপূজার আয়োজন করতে থাকেন। কলকাতায় আরো অনেক বাড়িতে এই ভাবে দুর্গাপূজা শুরু হয়।
আধুনিক দূর্গা পূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮ম শতকে নানা বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসাযী, রাজদরবারের রাজ কর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল। বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার খ্রিস্টীয় ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে (১৭৬৭?) দুর্গা পূজা হত বলে লোকমুখে শোনা যায়। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দুর্গা পূজার ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। উড়িষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দুর্গা পূজা হয়ে আসছে। জমিদার বাড়ি থেকেই এই পূজার প্রচলন হয়েছিল।
বর্তমানে দুর্গা পূজা দুইভাবে হয়ে থাকে, ব্যক্তিভাবে, পারিবারিক স্তরে ও সমষ্ঠিগতভাবে, পাড়া স্তরে। ব্যক্তিগত পূজাগুলি নিয়মনিষ্ঠা ও শাস্ত্রীয় বিধান পালনে বেশি আগ্রহী হয়; এগুলির আয়োজন মূলত বিত্তশালী বাঙালি পরিবারগুলিতেই হয়ে থাকে। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে যৌথ উদ্যোগেও দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। এগুলি বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত।
পুরোনো অনেক বাঙালী বাবু দুর্গাকে মনে করতেন মেয়ে আর শিবকে মনে করতেন জামাই। দশমীর দিন তাঁরা দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে মেয়ে দুর্গাকে জামাই শিবের কাছে পাঠিয়ে দিতেন বলে কল্পনা করতেন। জামাইয়ের কাছে তাই আগাম খবর তারা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতেন বিজয়ার দিন নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে। ভারতের কলকাতার শোভাবাজারের নবকৃষ্ণের বাড়িতে আর চোরাবাগানের মল্লিকবাড়িতে এই প্রথা এখনো চালু আছে। হাওড়া জেলার ডাঁসাই গ্রামের কাঙালীচরণ শিকারি এই দুটি বাড়িতে নীলকণ্ঠ পাখি জোগান দিতেন বলে জানা যায়। বাবুদের সংস্কার অনুসারে নীলকণ্ঠ পাখি হচ্ছে পবিত্র বার্তাবাহক।
সেকালের কলকাতার একজন উল্লেখযোগ্য পুরুষ হচ্ছেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন বলে দুর্গাঠাকুর দেখতে যেতেন না। একবার তার বন্ধু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তাকে দুর্গাঠাকুর দেখার নেমন্তন্ন করেছিলেন, কিন্তু রামমোহন তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বিদ্যাসাগর দুর্গাপূজার ব্যাপারে কৌতূহলী ছিলেন না। পূজার সময় তিনি দরিদ্র গ্রামবাসীদের কাছে চলে যেতেন।
সমষ্ঠিগতভাবে, বারো ইয়ার বা বারোয়ারী পূজা ১৭৯০ সালের পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তি পাড়াতে বার জন বন্ধু মিলে টাকা পয়সা (চাঁদা) তুলে প্রথম সার্বজনীনভাবে বড় আয়োজনে দূর্গা উৎসব পালন করেন, যা ‘বারোইয়ার’ বা ‘বারোবন্ধুর’ পূজা নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। কাশিম বাজারের রাজা হরিনাথ ১৮৩২ সালে বারোইয়ারের এই পূজা কলকাতায় পরিচিত করান। পরে তাদের দেখাদেখি আস্তে আস্তে তা উচ্চ বর্ণের হিন্দু বাঙালী জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্ভবত সেই থেকে বারোয়ারী পূজা শুরু।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন অদ্বৈতবাদী। শাস্ত্রসম্মত দুর্গাপূজার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ১৯০১ সালে বেলুড়মঠে দুর্গাপূজার ব্যবস্থা করেছিলেন। অনেকের ধারণা, এটা ছিল শাস্ত্রশাসন আর লোকাচারের সঙ্গে তার আপস। তবে একথাও ঠিক, তার অদ্বৈতবাদের উপলব্ধি শেষ পর্যন্ত উত্তোরিত হয়েছিল মানবিকতাবাদে। সর্বোচ্চ মনুষ্যত্বকেই তিনি মনে করতেন ঈশ্বর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্ম’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। পরে সেই বিশ্বাস কেন্দ্রীভূত হয়েছিল দরিদ্র-শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। তবুও তিনি দুর্গাপূজার বিরোধিতা করেননি। আবার দুর্গাপূজার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়েও পড়েননি।
১৯১০ সালে সনাতন ধর্ম উৎসাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে একই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী পুজার আয়োজন করে।
বারোয়ারি দুর্গাপূজা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের চাঁদার টাকায় অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু সার্বজনীন দুর্গাপূজা হয়ে থাকে জনসাধারণের চাঁদার টাকায়। চাঁদা তোলার সময় উদ্যোক্তারা ধনী, দরিদ্র সবারই দ্বারস্থ হয়। অনেক সময় বাড়াবাড়িও করত। সার্বজনীন দুর্গাপূজার পত্তন হয় কলকাতায়, ১৯২৬ সালে। সিমলা আর বাগবাজার—দু জায়গায় সে বছর সার্বজনীন দুর্গাপূজা হয়। সিমলা ব্যায়াম সমিতির অতীন্দ্রনাথ বোস ছিলেন প্রথমটির উদ্যোক্তা। সিমলার প্রতিমাটি তৈরি করেছিলেন কুমোরটুলির বিখ্যাত মৃিশল্পী নিমাই পাল। প্রথম বছরে মূর্তিটি ছিল একচালা বিশিষ্ট।
১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোস জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে পূজা উৎসবে অংশ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্গা পূজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বৃটিশ শাসিত বাংলায় এই পূজা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেবী দুর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হন। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী বা কমিউনিটি পূজা হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পূজা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।
বাগবাজারে দুর্গাপূজা সার্বজনীন নামে অভিহিত হয় ১৯২৬ সালে। এই পূজা আগে ছিল বারোয়ারি। সূচনা ১৯১৮ (বা ১৯১৯) সালে। স্থানীয় কিছু যুবক এক ধনীলোকের বাড়িতে দুর্গাঠাকুর দেখতে গিয়ে অপমানিত হন। পরের বছর তাঁরা বারোয়ারি পূজা চালু করেন। সবার জন্য তারা উন্মুক্ত করে দেন পূজামণ্ডপের দ্বার। এই পূজার উদ্যোক্তা ছিলেন — রামকালী মুখার্জি, দীনেন চ্যাটার্জি, নীলমণি ঘোষ, বটুকবিহারী চ্যাটার্জি প্রমুখ। সঠিক অর্থে এই পূজাই ছিল কলকাতা তথা তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপূজা।
প্রথম সার্বজনীন পূজায় বাধা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন অনেক রক্ষণশীল পণ্ডিত। শেষ পর্যন্ত তারা সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন পণ্ডিত দীননাথ ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে। এখন সার্বজনীন দুর্গাপূজার ছড়াছড়ি। এই পূজারই রমরমা। বাড়ির পূজা আজ স্তিমিত।
১৯৩৮ সাল থেকে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর গণেশ প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা চালের ব্যবস্থা হয়। শুরু হয় কুমোরটুলি সার্বজনীনের দুর্গাপূজা থেকে। শুরু করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৩৮ সালে কুমোরটুলি সার্বজনীনের নতুন সভাপতি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ কিন্তু পঞ্চমীর দিনই ঘটে গেল মহাবিপত্তি৷ মন্ডপে চলে এসেছে একচালার ঠাকুর (সেইসময় একচালার প্রতিমাই পুজো হত)৷ হঠাৎ বিকেলে মন্ডপে আগুন লেগে যায়৷ মন্ডপ, প্রতিমা, সব পুড়ে ছাই৷ অথচ পরের দিনই বোধন৷ নেতাজি ছুটে গেলেন শিল্পী গোপেশ্বর পালের কাছে৷ বললেন, যেভাবেই হোক এক রাতের মধ্যে ঠাকুর তৈরি করে দিতেই হবে৷ সেকথা শুনে তো শিল্পী অবাক৷ তা কি করে সম্ভব? মুহূর্তের মধ্যে নেতাজি সিদ্ধান্ত নিলেন আলাদা আলাদা করে প্রতিমা গড়া হবে৷ জি পাল দুর্গা প্রতিমা গড়লেন৷ আর অন্যান্য শিল্পীরা গড়লেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ৷ একচালা ভেঙে তৈরি হল পাঁচ চালার ঠাকুর৷ এক রাতের মধ্যেই সব তৈরি৷ ষষ্ঠীর দিন মন্ডপে এল প্রথম পাঁচ চালার ঠাকুর৷ যা সম্ভব হয়েছিল নেতাজির জন্যই৷ পুজো কমিটির বহু পুরোনো সদস্যরা সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যম কে জানিয়েছিলেন, সেবার একেই তো পাঁচ চালা আর তার উপর দেবীর জমকালো সাজসজ্জা দেখে পুরোহিত সমাজ বেঁকে বসেছিল৷ তারপর শিল্পীর সঙ্গে বহু আলোচনার পর মেলে পুজোর পুরোহিত৷ তবে এটাই শেষ প্রথা ভাঙা ছিল না৷ পরের বছর নেতাজি পুজো কমিটির সভাপতি থাকাকালীন কুমোরটুলি সার্বজনীনের দেবী দুর্গার গায়ে উঠেছিল সত্যিকারের বাঘের ছাল৷ যদিও এখনকার দিনে হলে নিশ্চিতভাবে ‘পেটা’-র প্রতিবাদের মুখে পড়তে হত পুজো কমিটিকে৷
এখন দুর্গাপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে শারদীয়া বা পূজা সংখ্যা। প্রথম পূজা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১২৭৯ বঙ্গাব্দে। কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সুলভ সমাচার’ ১২৭৯ বা ইংরেজি ১৮৭২-এ ‘ছুটির সুলভ’ নামে প্রথম শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করে।
পূজার সময়ে নামী লেখকদের লেখা পাওয়ার জন্য পত্রপত্রিকার সম্পাদকেরা পূজার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের সময়েও এ ব্যাপার ছিল। নানা সম্পাদকের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাছে তাদের পত্রপত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় লেখা দেওয়ার জন্য অনুরোধ আসত। যতদূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পূজার লেখা দেন। ‘পার্বণী’ হলো প্রথম বাংলা বার্ষিকী। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৫ সালে। ‘পার্বণী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘পার্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্প ও ‘ঠাকুর্দ্দার ছুটি’ কবিতা। ‘পার্বণী’ প্রথম শারদীয় বার্ষিকী হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’র সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন,
‘তোমার ‘পার্বণী’ পড়িয়া বিশেষ আনন্দ পাইয়াছি। ইহা ছেলে বুড়ো সকলেরই ভালো লাগিবে। তোমার পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে। দেশের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত লেখকদের ঝুলি হইতে বাংলাদেশের ছেলেদের জন্য এই যে পার্বণী আদায় করিয়াছ ইহা একদিকে যত বড়ই দুঃসাধ্য কাজ অন্যদিকে তত বড়ই পুণ্য কর্ম। বস্তুত ইহার বৈচিত্র্য। সৌষ্ঠব ও সরসতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি—অথচ ইহার মধ্যে পাঠকদের জানিবার ভাবিবার বুঝিবার কথাও অনেক আছে। তোমার এই সংগ্রহটি কেবলমাত্র ছুটির সময় পড়িয়া তাহার পরে পাতা ছিঁড়িয়া, ছবি কাটিয়া, কালি ও ধূলার ছাপ মারিয়া জঞ্জালের সামিল করিবার সামগ্রী নহে—ইহা আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে নিত্যব্যবহারের জন্যই রাখা হইবে। প্রথম খণ্ড ‘পার্বণী’তে যে আদর্শে ডালি সাজাইয়াছ বত্সরে বত্সরে তাহা রক্ষা করিতে পারিলে মা ষষ্ঠী ও মা সরস্বতী উভয়েরই প্রসাদ লাভ করিবে। আজকাল কাগজ প্রভৃতির দুর্মূল্যতার দিনে কেমন করিয়া দেড় টাকা দামে তুমি এই বই বাহির করিলে বুঝিতে পারিলাম না। বোধ করি সংগ্রহ করিবার উত্সাহে লাভ লোকসান খতাইয়া দেখিবার সময়ও পাও নাই।
ইতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৯ই আশ্বিন, ১৩২৫।’
১৯৩৫ সালে ‘আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে পূজা সংখ্যায় লেখা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে ‘একশ টাকা বায়না’ দেওয়া হয়। ঘটনাটির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালের ২৯শে আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন,
‘এখানকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ-চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এমন সময় ‘দেশ’ ও ‘আনন্দবাজার’-এর দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দুটি কবিতার জন্য একশ টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে। আগেকার মতো অনায়াসে লেখবার ক্ষমতা এখন নেই। সেজন্য ‘বিস্ময়’ কবিতাটি দিয়ে ওদের ঋণশোধ করব বলে স্থির করেছি। ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।…’
শারদীয়া সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা পাওয়ার জন্য সম্পাদকের চেষ্টার অন্ত থাকত না। যে সম্পাদক তার কাছ থেকে পূজার লেখা আদায় করতে সক্ষম হতেন না, তিনিও রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুযোগ করতেন। এ ব্যাপারে কখনো কখনো উড়ো খবরও প্রচারিত হতো। যেমন, ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর কাছে খবর এল যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি সে বছর পূজাতে সঞ্চয় ভট্টাচার্যের পত্রিকায় লেখা দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের উত্তরে বুদ্ধদেব বসুকে শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট একটি চিঠিতে লিখলেন, ‘নিজের কাজের ভিড় জমে উঠেছে—তাছাড়া শরীর ক্লান্ত। লিখে ওঠা সম্ভব হবে না।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে দুর্গাপূজা সামাজিক মিলনের একটি উদার ক্ষেত্রস্থল হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে। এখানে মলিনতা নেই, হীনতা নেই, নেই কোনো ছোট-বড়র হিসাব কিংবা অভিজাত্যের বড়াই। এখানে সবাই সব ভুলে মিলবে, মেলাবে, ‘যাবে না ফিরে’। এখানে সবার আমন্ত্রণ রয়েছে।
আগে পূজায় তেমন জাঁকজমক হতো না, তাই ছুটিরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রথম দুর্গাপূজায় ছুটির উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৮৭ সালে। কলকাতার পূজার বাজারকে গ্রামের মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৯২৭ সালে পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে (ই. বি. রেলওয়ে) কর্তৃপক্ষ পূজার আগে ‘পূজা বাজার স্পেশাল’ নামে তিন কামরার একটি ট্রেন প্রায় মাস খানেক ধরে বিভিন্ন স্টেশনে চালিয়েছিল। গ্রামের মানুষদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্য নিয়ে মোট ১৬টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ওই ট্রেনে পশরা সাজিয়ে যোগ দিয়েছিল।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব, বিনয় ঘোষ।
২- বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বিনয় ঘোষ।
৩- দুর্গা রূপে রূপান্তরে, পূর্বা সেনগুপ্ত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৪- বঙ্গে শারদোৎসব ও ব্যতিক্রমী দুর্গাপূজা, শিবশংকর ঘোষ, প্রভা প্রকাশনী।
৫- দুর্গাপূজা ও কিছু কথা, সনজিৎ ঘোষ, অর্পিতা প্রকাশনী।
৬- বাংলায় পটের দুর্গা, দীপঙ্কর ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স।
৭- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত