আজ দুর্গাপূজার মহাষষ্ঠী। শাস্ত্রমতে মহাষষ্ঠীর দিনেই কৈলাস থেকে বাপের বাড়িতে আসেন মা। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে শুরু হয় দুর্গাপূজো, তাই একে দুর্গাষষ্ঠীও বলা হয়। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের শুভারম্ভ।
প্রাচীন শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজো বসন্তকালে বিধেয়। কিন্তু রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করার পূর্বে ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র দুর্গাপূজো করেছিলেন আশ্বিন মাসে, তখন ছিল সূর্যের দক্ষিণায়ণ। দেবতারা সব ঘুমিয়ে। তখন অকালবোধনের মাধ্যমে দেবতাদের জাগিয়ে পূজা নিবেদন করেন রামচন্দ্র। সেই থেকেই ষষ্ঠীর দিনে বোধনের রীতি চলে আসছে, প্রথমে কল্পারম্ভ, প্রক্রিয়াটি শুরু হয় সকাল বেলাতেই। সকল শাস্ত্রীয় রীতিনীতি মেনে পুজো যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, সেজন্য এই আচার। ঘট ও জলপূর্ণ তাম্রপাত্র মণ্ডপের এককোনে স্থাপন করে দুর্গা ও চণ্ডীর পুজো করা হয়। এরপর দেবীর বোধন অর্থাৎ দেবীকে জাগরিত করা হয়। তারপরেই হয় অধিবাস এবং আমন্ত্রণ। বোধনের পর বিল্ব শাখায় দেবীকে আবাহন করা হয়। রীতি হল অশুভ শক্তিকে দূর করার জন্য ঘটের চারদিকে তীরকাঠিতে লাল সুতো বেষ্টন করা হয়, এরপর আমন্ত্রণ প্রক্রিয়া। এভাবেই মহাষষ্ঠীর আচার শেষ হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে পুজোর উপাচার শুরু আজ থেকেই। সিদ্ধিদাতা গণেশকে দিয়েই শুরু হয় পুজো। তারপর হয় দেবী দুর্গার পুজো। পরিবারের কল্যানার্থেই ষষ্ঠীপুজোর মাধ্যমে শুরু হয়ে গেল দেবী আরাধনা। সন্তানদের কল্যাণে নতুন বস্ত্র পরে অঞ্জলি দেন মায়েরা।
অকালবোধন হল শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি অথবা শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গার পূজারম্ভের প্রাক্কালে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, শরৎকাল দেবলোকের রাত্রি দক্ষিণায়নের অন্তর্গত। তাই এই সময় দেবপূজা করতে হলে, আগে দেবতার বোধন (জাগরণ) করতে হয়। কৃত্তিবাসী রামায়ণে উল্লিখিত হয়েছে যে, রাবণ বধের পূর্বে রাম দেবী দুর্গার কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বিল্ববৃক্ষতলে বোধনপূর্বক দুর্গাপূজা করেছিলেন। শরৎকাল দেবপূজার ‘শুদ্ধ সময়’ নয় বলে রাম কর্তৃক দেবী দুর্গার বোধন ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য, শাস্ত্রমতে বসন্তকাল দুর্গাপূজার প্রশস্ত সময় হলেও, আধুনিক যুগে শারদীয়া দুর্গাপূজাই অধিকতর প্রচলিত।
এই দিনে কালীঘরে গিয়ে তো বটেই, অন্য সময়েও প্রায়ই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একটি গান আপনমনে গাইতেন। গানটির পদকার ছিলেন দেওয়ান রঘুনাথ রায়। গানটির শেষ পংক্তিটি হল,
“উপায় না দেখি আর, অকিঞ্চন ভেবে সার,
তরঙ্গে দিয়ে সাঁতার, দুর্গা নামের ভেলা ধরি।।”
দুর্গা নামের ভেলা ধরতে হবে। শ্রীশ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ের অংশে মহাঋষিগণ দেবীর স্তব করেছেন। তাঁরা এই শক্তিরূপার মঞ্জুল শোভা (স্বর্গীয় সৌন্দর্য) প্রত্যক্ষ করেছেন। স্মরণ করেছেন,
“সিংহস্থা শশীশেখরা মরকতপ্রেক্ষাঃ চতুর্ভিভুজৈঃ, শঙ্খং চক্র ধনু শরাংশ্চ দধতিনেত্রৈঃ স্থিভিঃশোভিতা, আমুক্তাঙ্গদ হারকঙ্কন রণংকাঞ্চী কন্বংনূপুরা –দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী, ভবতুয়ো রত্নোলস্যৎকুন্তলা।”
প্রতি পদক্ষেপে মহামায়া দুর্গাকে স্মরণ করেছেন,
“ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরণন্তবীর্যা
বিশ্বাস্য বীজং পরমাসি মায়া
সম্মোহিতং দেবি সমস্তশেতৎ
ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তি-সিদ্ধিহেতুঃ।।”
অর্থাৎ, মা সিংহবাহিনী, তোমার শক্তি, তোমার বীর্য অনন্ত অপার। তুমিই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের জগৎপালিনি শক্তি। এই ব্রহ্মাণ্ডের তুমি আদির আদি কারণ মহামায়া। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডজগৎকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছ; কিন্তু তুমি প্রসন্না হলে শরণাগত মুক্তিসিদ্ধি লাভ করে।
এই হল বোধনের আদি মন্ত্র।
‘বোধন’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘বোধ’-এর ‘অনট্’ ধাতু – অর্থাৎ জাগ্রত করা – অপরা জগতের ‘ধী’শক্তি দিয়ে পরাজাগতিক মহাশক্তিকে বোধিত্বে অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় অধিষ্ঠিত করা, প্রতিষ্ঠিত করা।
সংস্কৃত ‘অকাল’ ও ‘বোধন’ শব্দদুটি বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ‘অকাল’ শব্দের অর্থ ‘অসময়, শুভকর্মের অযোগ্য কাল বা অনুপযুক্ত কাল’। অন্যদিকে ‘বোধন’ শব্দটির অর্থ ‘উদ্বোধন, নিদ্রাভঙ্গকরণ, বা জাগানো’ ‘অকালবোধন’ শব্দবন্ধটির অর্থ ‘অসময়ে বোধন বা জাগরণ, (হিন্দু সংস্কারে) অসময়ে দেবী দুর্গার আরাধনা’। এই প্রসঙ্গে পন্ডিত জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস লিখেছেন:
“যে সময় (শ্রাবণ হ’তে পৌষ) দুর্গা পূজা হয় তখন সূর্য্যের গতি দক্ষিণ দিক্ দিয়া হয়। এই ছয় মাস দক্ষিণায়ণ। অপর ছয় মাস (মাঘ হ’তে আষাঢ়) উত্তরায়ণ। উত্তরায়ণ দেবতাদের দিন এবং দক্ষিণায়ণ রাত্রি। রাত্রিকালে দেবী (দুর্গা) নিদ্রিত থাকেন বলিয়া তাঁহার বোধন করিয়া পূজা করিতে হয়। সাধারণত ষষ্ঠীতেই বোধন আরম্ভ হয়, পূজার পূর্ব্বদিন সায়ংকালে ষষ্ঠী না থাকিলে ও তৎপূর্ব্বদিনে থাকিলে তৎপূর্ব্বদিনেই বোধন হয়।”
অপরপক্ষে দুর্গাপূজার বিধিসম্মত সময়কাল হল হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে চৈত্র মাস; যে পূজা বাসন্তীপূজা নামে পরিচিত। হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে, রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য দুর্গাপূজা করেছিলেন বসন্তকালেই। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থে রয়েছে, রাজা সুরথ চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে শাস্ত্রবিধিমতে দেবী দুর্গতিনাশিনীর (দুর্গা) পূজা করেছিলেন। বসন্তকাল উত্তরায়ণের অন্তর্গত। উত্তরায়ণে দেবতারা জাগ্রত থাকেন বলে বাসন্তীপূজায় বোধনের প্রয়োজন হয় না।
সত্য যুগে দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গার বসন্তকালে বোধন করেছিলেন রাজর্ষি সুরথ। তাঁর সঙ্গী ছিলেন সমাধি বৈশ্য। সময়টি ছিল চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষ। একে আমরা বাসন্তীপূজা বলি। দেবীর বোধনের আলোচনা পাওয়া যায় মৎস্যপুরাণ, মার্কেণ্ডয়পুরাণ, শ্রীশ্রীচণ্ডী, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ এবং দেবী ভাগবতে।
পরবর্তী যুগে অর্থাৎ ত্রেতা যুগে রাবণও চৈত্র মাসে দেবী দুর্গার বোধন এবং আরাধনা করতেন। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাহিনি অনুসারে লঙ্কা থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য যে রাম-রাবণের অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ, সেখানে রাবণকে বধ করার জন্য রামচন্দ্রকে দেবীর শরণাপন্ন হতে হয়। দেবাদিদেব মহাদেবকে কঠোর তপস্যায় তুষ্ট করে রাবণ বর লাভ করেছেন। দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপের একনিষ্ঠ সাধক ও পূজারি হলেন রাবণ। যুদ্ধক্ষেত্রে মহাকালী স্বয়ং রাবণকে নিজের কোলে স্থান দেন। এ হেন রাবণকে বধ কী করে হবে? রাম পড়লেন দুশ্চিন্তায়। দেবরাজ ইন্দ্রদেবও দুশ্চিন্তায়। এ দিকে অশুভশক্তি অহংকারী দাম্ভিক রাবণের বিনাশ ঘটবে রামের হাতে, এই হল দৈববাণী। তাই দেবতারা প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণ নিলেন। তখন মহামায়া একাক্ষরী আদ্যাদেবী মা দুর্গা সমাধিনিদ্রায় নিদ্রিতা। ব্রহ্মা স্বয়ং তাঁর পুজো করে তাঁকে তুষ্ট করে উপায় জিজ্ঞাসা করলেন। দেবী বললেন, রামচন্দ্রকে ‘বোধন’ করতে বলো। তবেই রাবণকে বধ করার জন্য তিনি রামকে সাহায্য করবেন।
রামকে দেবীর নির্দেশের কথা বললেন ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। যদিও সময়টা শরৎকাল – রামচন্দ্র নিজের হাতে দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরি করে পুজো করলেন, অকালে বা অসময়ে প্রকট হওয়ার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা করলেন।
ব্রহ্মা স্বয়ং দুর্গার বোধনপূজা করেন। পূজার প্রারম্ভে স্বয়ং প্রজাপতি পদ্মযোনি ব্রহ্মা দেখেছিলেন সাগরের বালুকাবেলার অনতিদূরে গভীর অরণ্যের প্রান্তসীমায় একটি বিল্ববৃক্ষের নীচে একটি আট থেকে দশ বছরের বালিকা আপন মনে খেলছে। ব্রহ্মা ধ্যানস্থ হয়ে জানলেন, সেই বালিকাই স্বয়ং গৌরী – কন্যকা। ব্রহ্মা চোখ মেলতেই সেই বালিকা ওই বিল্ববৃক্ষে লীন হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মা স্থির করলেন, দেবী দুর্গার সেই বোধনের পূজার্চনা হবে ওই বিল্ববৃক্ষের নীচে। তাই আজও দেবীর বোধনের পূর্বে বিল্বশাখা বা বিল্ববৃক্ষকে পূজা করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হয় দেবীর মৃন্ময়ী বিগ্রহের মহাঘটে। শুরু হয় ‘বোধন’-এর আরাধনা, বেজে ওঠে শঙ্খ, ঢাক।
তাই বোধন হল মহাপূজায় দেবী মা দুর্গার প্রারম্ভিক আবাহন, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পরম্পরাগত ভাবে প্রবহমান। বসন্তকালের সঙ্গে ত্রেতা যুগে যুক্ত হল শরৎকাল – অর্থাৎ অকালে হল দেবীর বোধন, তাই এ হল অকালবোধন।
উচ্চারণ করি বোধনের মন্ত্র,
“রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানু গ্রহায় চ
অকালে ব্রহ্মনা বোধো দেব্যাস্ত্বয়ি কৃতঃ পুরা। অহমপ্যাশ্বিনে ষষঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়ামি বৈ।।”
দুর্গাপূজায় রামচন্দ্রের পূজার কোনো বিধান নেই। তাই সম্ভবত বাংলায় অকালবোধন থিমের আকাল। তবে অকালবোধনের গল্প বাঙালিরা শিশুকাল থেকে শুনে আসছে। সৌজন্যে কৃত্তিবাস ওঝা। পনেরো শতকের এই বাঙালি রামায়ণ অনুবাদক বেশ ফলাও করেই রামচন্দ্রের দুর্গাপুজোর গল্প শুনিয়েছেন। তবে গল্পটা সবিস্তারে খুব কম লোকই জানেন। তাই একবার বলে রাখা ভাল।
যুদ্ধে একে একে মারা পড়েছেন লঙ্কার সব বড়ো বড়ো বীর। রাবণ তখন একা কুম্ভের মতো রক্ষা করছেন লঙ্কাপুরী। তিনিও শ্রান্ত, বিধ্বস্ত। এমনকি একবার তো হনুমানের হাতে প্রচুর মার খেয়ে অজ্ঞানই হয়ে গেলেন। বেগতিক বুঝে রাবণ অম্বিকার স্তব করলেন,
“আর কেহ নাহি মোর ভরসা সংসারে।
শঙ্কর ত্যজিল তেঁই ডাকি মা তোমারে।।”
রাবণে কাতর স্তবে হৈমবতীর হৃদয় টলল। তিনি কালী রূপে রাবণকে কোলে তুলে নিয়ে তাঁকে দিলেন অভয়। এই খবর রামের কানে যেতেই তিনি গুণলেন প্রমাদ। দেবতাদের ঘুম উড়ে যাওয়ার জোগাড় হল। ইন্দ্র ব্রহ্মার কাছে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করে একটা কিছু করার অনুরোধ জানালেন। বুড়ো ঠাকুরদাদা ব্রহ্মা এসে রামকে পরামর্শ দিলেন, “দুর্গাপূজা করো। আর কোনো উপায় নেই।” রাম বললেন, “তা কেমন করে হয়? দুর্গাপূজার প্রশস্ত সময় বসন্তকাল। শরৎকাল তো অকাল। তাছাড়া বিধান রয়েছে, অকালবোধনে নিদ্রা ভাঙাতে হবে কৃষ্ণানবমীতে। সুরথ রাজা প্রতিপদে পূজারম্ভ করেছিলেন। কিন্তু সেকাল তো আর নেই। পূজা করি কিভাবে?” ব্রহ্মা বললেন, “আমি ব্রহ্মা, বিধান দিচ্ছি, শুক্লাষষ্ঠীতে বোধন করো।” শুনে রাম মহাখুশি হলেন।
“চণ্ডীপাঠ করি রাম করিল উৎসব।
গীত নাট করে জয় দেয় কপি সব।।”
রাম চণ্ডীপাঠ করে উৎসব করলেন।
সে কথা যাক, রামচন্দ্র কিভাবে দুর্গাপূজা করেছিলেন; তার একটু বর্ণনা দেবো।
চণ্ডী-তে আছে, সুরথ রাজা দুর্গার মাটির মূর্তি গড়ে পূজা করেছিলেন,
‘তৌ তস্মিন্ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্বা মূর্ত্তিং মহীময়ীম্।’
(শ্রীচণ্ডী, ১৩।১০)।
রামচন্দ্রও পূজা করেছিলেন নিজের হাতে তৈরি মাটির প্রতিমায় (‘আপনি গড়িলা রাম প্রতিমা মৃন্ময়ী’)।
ষষ্ঠীর সন্ধায় বেল গাছের তলায় হল দেবীর বোধন। অধিবাসের সময় রাম স্বহস্তে বাঁধলেন নবপত্রিকা।
“সায়াহ্নকালেতে রাম করিল বোধন।
আমন্ত্রণ অভয়ার বিল্বাধিবাসন।। …
আচারেতে আরতি করিলা অধিবাস।
বান্ধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।।”
সপ্তমীর দিন সকালে স্নান করে রাম ‘বেদবিধিমতে’ পূজা করলেন। অষ্টমীর দিনও তাই। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাম সন্ধিপূজা করলেন। দুই দিনই রাতে চণ্ডীপাঠ ও নৃত্যগীত হল।
রামচন্দ্রের নবমী পূজার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন কৃত্তিবাস। বহুরকম বনফুল ও বনফলে পূজার আয়োজন হল। ‘তন্ত্রমন্ত্রমতে’ পূজা হল। কিন্তু দেবী দর্শন দিলেন না। তখন বিভীষণ উপদেশ দিলেন, “নীলপদ্মে পূজা করুন। দেবী নিশ্চয় দর্শন দেবেন।” কিন্তু নীলপদ্ম দুর্লভ। দেবতারাও তার খোঁজ রাখেন না। পৃথিবীতে একমাত্র দেবীদহ নামক হ্রদেই নীলপদ্ম মেলে। কিন্তু সেও লঙ্কা থেকে দশ বছরের পথ। শুনে হনুমান নিমেষে উপস্থিত হলেন দেবীদহে। এনে দিলেন একশো আটটি নীলপদ্ম। কিন্তু দুর্গা ছলনা করে একটি পদ্ম রাখলেন লুকিয়ে। রাবণকে তিনি কথা দিয়ে রেখেছিলেন কিনা। কিন্তু রামও ছাড়বার পাত্র নন। একটি নীলপদ্মের ক্ষতিপূরণে তিনি নিজের একটি চোখ উপড়ে নিবেদন করতে চাইলেন।
“চক্ষু উৎপাটিতে রাম বসিলা সাক্ষাতে।
হেনকালে কাত্যায়নী ধরিলেন হাতে।।
কর কি কর কি প্রভু জগত গোঁসাই।
পূর্ণ তোমার সঙ্কল্প চক্ষু নাহি চাই।।”
বাধ্য হয়েই দুর্গা রামচন্দ্রকে রাবণ বধের বর দিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন:
“অকালবোধনে পূজা কৈলে তুমি দশভূজা
বিধিমতে করিলা বিন্যাস।
লোকে জানাবার জন্য আমারে করিতে ধন্য
অবনীতে করিলে প্রকাশ।।”
এরপর রাম দশমীপূজা সমাপ্ত করে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন দিলেন। তারপরে রাবণ বধের গল্প তো সবাই জানে।
রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার এই ইতিহাস বাল্মীকি রামায়ণে নেই। আছে দেবীভাগবত পুরাণ ও কালিকাপুরাণ-এ। খ্রিস্টীয় নবম-দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লেখা এই দুই পুরাণ, গবেষক মহলের মতে, বাঙালি স্মার্তদের দুই মহাকীর্তি। কৃত্তিবাসের আগেও যে বাংলায় দুর্গাপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল, তার প্রমাণ ভবদেব ভট্টের মাটির মূর্তিতে দুর্গাপূজার বিধান (একাদশ শতাব্দী), বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তি-তরঙ্গিনী (চতুর্দশ শতাব্দী), শূলপাণির দুর্গোৎসব-বিবেক (চতুর্দশ শতাব্দী) ও স্মার্ত রঘুনন্দনের দুর্গাপূজা-তত্ত্ব (পঞ্চদশ শতাব্দী)। অর্থাৎ, কৃত্তিবাসের যুগে (পঞ্চদশ শতাব্দীতে) দুর্গাপূজা ছিল বাঙালির এক প্রধান উৎসব। আর সেই জন্যই তিনি রামচন্দ্রকে দিয়ে দুর্গাপূজা করালেন সনাতন বাঙালি পন্থায়।
যদিও কৃত্তিবাসী রামায়ণের দুর্গোৎসব বিবরণের সঙ্গে পৌরাণিক দুর্গোৎসব বর্ণনা ঠিক হুবহু মেলে না। যেসব পুরাণমতে আজ বাংলায় দুর্গাপূজা হয়, তার একটি হল কালিকাপুরাণ। এই পুরাণে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বর্ণনা পাই। সংস্কৃত শ্লোক ক্লান্তিকর ঠেকতে পারে, তাই সর্বজনবোধ্য বাংলা ভাষায় কালিকাপুরাণ-এর ষাট অধ্যায়ের ২৬ থেকে ৩৩ সংখ্যক শ্লোকগুলি অনুবাদ করে দিচ্ছি,
‘পূর্বে রামের প্রতি অনুগ্রহ করে রাবণ বধে তাঁকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা রাত্রিকালে এই মহাদেবীর বোধন করেছিলেন। বোধিতা হয়ে দেবী গেলেন রাবণের বাসভূমি লঙ্কায়। সেখানে তিনি রাম ও রাবণকে দিয়ে সাত দিন ধরে যুদ্ধ করালেন। নবমীর দিন জগন্ময়ী মহামায়া রামের দ্বারা রাবণ বধ করেন। যে সাত দিন দেবী রামরাবণের যুদ্ধ দেখে আনন্দ করলেন, সেই সাত দিন দেবতারা তাঁর পূজা করেন। রাবণ নিহত হলে নবমীর দিন ব্রহ্মা সকল দেবতাকে সঙ্গে নিয়ে দেবীর বিশেষ পূজা করলেন। তারপর দশমীর দিন শবরোৎসব উদযাপিত হল। শেষে দেবীর বিসর্জন হল।’
এখানে রাত্রিকাল কথাটির একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এই ব্যাখ্যার মধ্যেই রয়েছে, শরৎকালকে রাম কেন দুর্গাপূজার পক্ষে অকাল বলেছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর। সূর্যের দক্ষিণায়ণ দেবতাদের রাত। এই সময় দেবতারা ঘুমান। শরৎকাল পরে দক্ষিণায়ণের সময়। এই সময় দেবতাকে পূজা করতে হলে, তাকে জাগরিত করতে হয়। এই প্রক্রিয়াটিই হল বোধন।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এই পুরাণের মতে, কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গের পর রামচন্দ্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় দেবতারা হলেন শঙ্কিত। তখন ব্রহ্মা বললেন, দুর্গাপূজা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাই রামচন্দ্রের মঙ্গলের জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা যজমানী করতে রাজি হলেন। তখন শরৎকাল। দক্ষিণায়ণ। দেবতাদের নিদ্রার সময়। এতএব ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করলেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি পরমাসুন্দরী বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন-স্তবে তাঁকে জাগরিত করলেন। ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধরলেন। ব্রহ্মা বললেন, “রাবণবধে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে অকালে জাগরিত করেছি। যতদিন না রাবণ বধ হয়, ততদিন তোমার পূজা করব। যেমন করে আমরা আজ তোমার বোধন করে পূজা করলাম, তেমন করেই মর্ত্যবাসী যুগ যুগ ধরে তোমার পূজা করবে। যতকাল সৃষ্টি থাকবে, তুমিও পূজা পাবে এইভাবেই।” একথা শুনে চণ্ডিকা বললেন, “সপ্তমী তিথিতে আমি প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে রাম-রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুণ্ড বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমুণ্ড আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।” হলও তাই। মহাবিপদ কেটে গেল অষ্টমীতে; তাই অষ্টমী হল মহাষ্টমী। রাবণ বধ করে মহাসম্পদ সীতাকে লাভ করলেন রাম; তাই নবমী হল মহানবমী।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুর্গাপূজা করেছিলেন রাম। কিন্তু পুরাণ বলে, রামের মঙ্গলের জন্য দেবগণ করেছিলেন পূজার আয়োজন। পুরোহিত হয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। কৃত্তিবাসের দুর্গাপূজা বিবরণে বাংলায় প্রচলিত লৌকিক প্রথার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই বিবরণ সম্পূর্ণ শাস্ত্রানুগ নয়। যদিও কৃত্তিবাসকে ধরে লোকে আজকাল মনে করে, শরৎকালের দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন রাম। কিন্তু এই সম্মান বুড়ো ঠাকুরদাদারই পাওয়া উচিত। আমাদের মনে রাখা উচিত, বাংলার লক্ষ লক্ষ দুর্গাপূজায় আজও বোধনের মন্ত্রে উচ্চারিত হয়,
“ওঁ ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যস্তয়ি কৃতঃ পুরা।।
অহমপাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়মি বৈ।”
(হে দেবী, রাবণবধে রামকে অনুগ্রহ করার জন্য ব্রহ্মা তোমার অকালবোধন করেছিলেন, আমিও সেইভাবে আশ্বিন মাসের ষষ্ঠী তিথিতে সন্ধ্যায় তোমার বোধন করছি।)
(তথ্যসূত্র:
১- বাল্মীকি রামায়ণ, রাজশেখর বসু, নবযুগ প্রকাশনী।
২- রামায়ণ: কৃত্তিবাস বিরচিত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ।
৩- কালিকাপুরাণম্, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, নবভারত পাবলিশার্স।
৪- পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়।
৫- বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)।
৬- ইতিহাসের আলোকে রামায়ণ, সূধাময় দাস, দিব্য প্রকাশ।
৭- কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও বাংলার লোকঐতিহ্য, তনিমা চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি (২০১১)।
৮- বাল্মীকী রামায়ণ, ড. কানাই লাল রায়, সময় প্রকাশন (২০১৯)।
৯- মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, দেব সাহিত্য কুটীর (২০১০)।
১০- দুর্গা রূপে রূপান্তরে, পূর্বা সেনগুপ্ত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
১১- দুর্গা দেবীর তথ্য প্রশ্ন ও মন্ত্র সাধারণ জ্ঞান, প্রেমেন্দ কুমার সাহা, অর্পিতা প্রকাশনী (২০১৬)।
১২- দুর্গা পূজা পদ্ধতি, নন্দী কেশ্বর পুরাণোক্ত, বুক চয়েস।
১৩- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত