মারা যাচ্ছেন সুকুমার রায়। পুত্রের পায়ের উপর মুখ গুঁজেছেন বিধবা মা। স্ত্রী সুপ্রভা দেবী মাথার কাছে একটা ছোট টুলে বসে, মুখে কথা নেই, বন্ধ চোখ থেকে বইছে জলের ধারা। মৃত্যু এল পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, ‘আবোল তাবোল’ ছেপে বেরনোর ন’দিন আগে। রোগের নাম কালাজ্বর।
তত দিনে বেরিয়ে গিয়েছে কালাজ্বরের দিশি ওষুধ, ইউরিয়া স্টিবামিন। ১৯২২ সালের অক্টোবরে, সুকুমারের মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগে, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চে তার সফল প্রয়োগের কথা লিখেছেন। তা সত্ত্বেও সুকুমার কেন সেই ওষুধ পেলেন না? সম্ভবত তার কারণ, কলকাতার সাহেব ডাক্তাররা তখনও তাকে ছাড়পত্র দেয়নি। সুকুমারের চিকিৎসা করছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, মেয়ো হাসপাতালের অধ্যক্ষ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র। তিনি ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকের আবিষ্কারের কথা জানতেন কি না, কে জানে। লীলা মজুমদার লিখছেন, ‘সেবাযত্ন, ওষুধপত্রের কোনও ত্রুটি হয়নি।’ কী ছিল সেই ওষুধ, তা অবশ্য জানা যায় না।
১৩০ বছর আগে জন্মানো মানুষটি যেন কলকাতার মুখ। এই রেনেসাঁ শহরে নইলে সুকুমারের মুক্তচিন্তা আর আদ্যন্ত শহুরে রসবোধ জন্মাত না (আর কোথায় কল্পনায় ধরা দিতে পারে ট্যাঁশগরু?)। তাঁর অকালমৃত্যুর কারণও এই শহর, পত্তনের সময় থেকেই যার পরিচয় তার মহামারী। ‘রেতে মশা দিনে মাছি’ নিয়ে জ্বরের শহর কলকাতা। ধনী-গরিব, কেউ রক্ষা পায়নি। বঙ্কিমচন্দ্রের পরিবারের এক পুত্রবধূ স্বামীকে চিঠি লিখছেন, ‘প্লিহা বড় হওয়াতে আমার পেট বড় হইয়াছে।’ স্বামীর বিরহে সে ওষুধ খায়নি, জানাচ্ছে অভিমানী মোতিরানি।
মজা হল, জোব চার্নক যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘাঁটি পত্তন করেছিলেন কলকাতায়, তার একটা কারণ ম্যালেরিয়া এড়ানোর তাগিদ। গোড়ায় গিয়েছিলেন হুগলি। সেখানে মুঘল নবাবের নায়েব-গোমস্তাদের আস্তানা। তাদের খাঁই মেটাতে নাজেহাল হয়ে গেলেন হিজলিতে। সেখানে যেমন বাঘ, তেমনি মশা। ১৬৮৭-র ফেব্রুয়ারি থেকে জুন, তিন মাসে দলের প্রায় দু’শো জন মারা গেল জ্বরে। অতঃপর উলুবেড়িয়া ট্রায়াল দিয়ে এলেন সুতানুটি। গোবিন্দপুর খাল (এখনকার টালি নালা), পূর্বে সল্ট লেক আর উত্তরে ইছাপুর খাল সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুরকে প্রায় একটা দ্বীপ তৈরি করেছে। মুঘল সেনা চট করে আক্রমণ করতে পারবে না। ১৬৯০ সালে পত্তন হল কলকাতার।
চার্নক কি আর জানতেন, এক দিন লাল কাগজে ছেপে পোস্টার পড়বে ‘শত্রুর চাইতে অনেক বেশি সৈন্য মারে ম্যালেরিয়া’? ব্রিটিশ সেনাদের নির্দেশ দেওয়া হবে, ‘তুমি ঢুকছ ম্যালেরিয়া এলাকায়। কম্যান্ডিং অফিসারের নির্দেশ মেনে সব সতর্কতা পালন করো।’ এক সাহেব লিখছেন, ১৭০০ সালে কলকাতায় প্রায় ১২০০ ইংরেজ ছিল, জ্বরের কোপে পরের বছর ৪৬০ জন কবরে। কোম্পানি গিয়ে রানির শাসন এল, তখনও ফোর্ট উইলিয়াম, ব্যারাকপুর, দমদম, আলিপুর— চারটে ক্যান্টনমেন্টে সব চেয়ে বেশি মৃত্যু জ্বরে। গোরা সৈন্য বাঁচাতে জনস্বাস্থ্যের পত্তন কলকাতায়। নেটিভ মরলে তাদেরও মরতে হয়। আর জ্বর তো নেটিভদের লেগেই আছে। নেটিভ হাসপাতালের এক ডাক্তার লিখছেন (১৮৩৩), নেহাত পিলে খুব না ফুললে, আর পেট ছেড়ে না দিলে কেউ জ্বরের জন্য ডাক্তার দেখায় না।
তবে নেহাত মরে না যায়, তার জন্য পুজো দেয়। খিদিরপুরের ওলাইচণ্ডী মন্দির, পাড়ায় পাড়ায় শীতলা মন্দির মহামারীর উত্তরাধিকার। দু’শো বছর ধরে ‘সিটি অব প্যালেস’ কলকাতা, কংগ্রেসি-স্বদেশী-সন্ত্রাস-হরতালের কলকাতার সঙ্গে গলাগলি বাস করেছে মহামারীর কলকাতা।
দু’শো বছর আগের এই গল্পই ধরুন। ডাকসাইটে ধনী রূপলাল মল্লিকের নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ। বিশপ হেবরের স্ত্রী লিখছেন, সেখানে রইসদের ‘হার্টথ্রব’ বাইজি নিক্কির গান শুনেছেন (পর পর তিন রাতের মুজরোর জন্য যাঁর ‘রেট’ ছিল হাজার টাকা আর দু’খানা কাশ্মীরি শাল), গান শুনতে গিয়ে তিনি মশার কামড়ে তিষ্ঠোতে পারেননি। তাঁর নালিশ, অতিকায় বাড়ির যেটুকু অতিথিরা দেখবে, তা বাদে বাকিটা বিশ্রী নোংরা, জমে-থাকা ময়লা এড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়েছে সাবধানে।
আজ যেমন পঞ্চাশ-লাখি পুজোমণ্ডপে অপূর্ব কারুকাজ দেখে বেরিয়ে আবর্জনার স্তূপ পাশ কাটাতে হয় সন্তর্পণে। দুর্গাদালান থেকে প্রতিমা আজ কর্পোরেশনের রাস্তায়, কিন্তু সর্বজনীন পুজোর কর্তারা ‘রিপ্যাকেজ্ড’ জমিদার। তাই জাঁকজমক আর জঞ্জালের এমন সাবেকি সহাবস্থান। তাই পুজোর পরেই শহরে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া।
কতগুলো শতাব্দী একত্রে বেঁচে আছে এই শহরে? একশো বছর আগের সরকারি রিপোর্ট বলছে, ক্যাম্বেল হাসপাতালের জলাশয়ে মিলেছে অ্যানোফিলিস মশার লার্ভা। সেই হাসপাতাল এখন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ। এনআরএস-সহ কলকাতার সব মেডিক্যাল কলেজ আজও মশার আঁতুড়ঘর। দেড়শো বছর আগে যখন বর্ধমানে, নদিয়ায় হাজার হাজার মানুষ মরছিল জ্বরে, জনসংখ্যা নেমে আসছিল অর্ধেকে, তখন কেউ বুঝতে পারছিল না রোগটা কালাজ্বর না ম্যালেরিয়া। তার পর রোনাল্ড রস কলকাতাতে বসেই মশার হুলের মাহাত্ম্য বুঝলেন, উপেন্দ্রনাথ কালাজ্বরের ওষুধ বিক্রি করে লক্ষপতি হলেন। আজ পাড়ায় পাড়ায় প্যাথ ল্যাব। তবু বোঝা যাচ্ছে না, লোকে কিসে মরছে— ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, না কি আর কোনও জ্বর। আজও নিরাময়ের উপায় হাতের কাছে, তবু বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায় মরছে মানুষ।
দাদাঠাকুরের শরৎচন্দ্র পন্ডিত ডিএল রায়ের গানে কথা বসিয়েছিলেন,
‘আমি সারা সকালটি করি নাই কিছু করি নাই কিছু আর
শুধু মাদুরেতে শুয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ম্যালেরিয়া জ্বরে কেঁপেছি…’।
বিছের হুলের মতো, এই প্যারডির বিষ শেষ দু’লাইনে লিখিত,
‘আছে সবার উপরে মাথা তব প্রভু, উপেক্ষা কভু ঘৃণা গো
ধর চৌষট্টি হাজার সহিত চাষার অন্তিম নিশ্বাস রেখেছি।’
জ্বরে মৃত্যু চৌষট্টি হাজার। তখনও যোগ হয়নি তেতাল্লিশের মন্বন্তরের তিরিশ লক্ষ মৃত্যু, যখন অনাহারে মৃতপ্রায়দের শেষ ধাক্কা দিয়েছিল ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত। দেশ যে বছর স্বাধীন হয়, সে বছর বিরাশি হাজার বাঙালি মারা যায় ম্যালেরিয়ায়। সে সময়ের একটা রিপোর্টে (১৯৪৪) জানা যায়, মহামারীর সময়ে এন্তার কালোবাজারি হত কুইনিন। আজ ডেঙ্গির বাজারে ব্ল্যাক হচ্ছে রক্তের প্লেটলেট।
তবু তফাত একটু আছে। ‘বিদূষক’ শরৎচন্দ্র বিদেশি শাসককে স্বনামেই খোঁচা দিয়েছেন।
আজও মশা কমেনি, ভয় বেড়েছে।
কেন কলকাতা মশা-মাছি আর জ্বরের আড়ত, তা নিয়ে নানা থিওরি মেলে। সাহেবদের পছন্দের ব্যাখ্যা ছিল হিন্দুদের চরিত্রদোষ। যারা দিনে তিন-চার বার চান করে, তাঁদেরই বাড়ির পাশের রাস্তায় মলমূত্র, গঙ্গায়-খালে মৃতদেহ। নেহাত শেয়াল, হাড়গিলে, কাক-চিল ছিল বলে রক্ষে। শুনে অন্যেরা তেড়েফুঁড়ে বলেন, তোমরাই বা কিসে কম বাপু? শিল্পবিপ্লবের পর লন্ডনের কী হাল ছিল, প্লেগ-পক্সে কত মরেছে, তা নিয়ে আর মুখ খুলিও না। আবার কেউ একটু সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন। আসলে কলকাতা তো কারও দেশ-মুলুক ছিল না। শহরটাই বহিরাগতদের। মজুর, কেরানি, বণিক, জমিদার, সবাই টাকার ধান্দায় এসেছে। যারা দু’পয়সা করেছে, তারা পথঘাট, মন্দির-ইস্কুল নির্মাণ করেছে দেশ-গ্রামে, কলকাতায় নয়। প্রযুক্তিবাগীশের উত্তর, ইংরেজগুলোই মুখ্যু। ভেবেছিল কলকাতার ঢাল গঙ্গার দিকে। আদতে ঢালু সল্ট লেকের দিকটা। ভুলভাল খাল কাটার ফলে নিকাশির বদলে জল দাঁড়িয়ে গেল। জ্বর তাড়াতে সল্ট লেকের জলাজমি ভরাট করে দেওয়া উচিত, উঠেছিল দাবি।
যদি সে দিন সাহেবরা তা মেনে নিত, যদি সিপাহি বিদ্রোহের আগেই ভরে যেত সল্ট লেকের জলাজমি, কলকাতার ম্যাপটা অন্য রকম হত। তা হয়নি, কিন্তু ইতিহাসের গতি ঠিক করেছে জ্বর। তৈরি হল ফিভার হাসপাতাল কমিটি। দ্বারকানাথ ঠাকুর, রসময় দত্তেরা চাঁদা দিলেন। কলকাতায় জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য চাঁদা সেই প্রথম। মতিলাল শীলের দান-করা জমিতে তৈরি হল মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল। কলেজ শুরু ১৮৩৫, হাসপাতাল ১৮৫২ সালে। এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। প্রেসিডেন্সি কলেজ যেমন তৈরি করেছিল সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহাদের, তেমনই মেডিক্যাল কলেজ থেকে উঠে এলেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, কেদারনাথ দাস, শম্ভুনাথ দে, সুবোধচন্দ্র মিত্র। বিংশ শতকে বিশ্বের চিকিৎসা মানচিত্রে স্থান পেল কলকাতা।
শুধু কলকাতা কেন? ম্যালেরিয়া নির্ধারণ করেছে বহু শহরের, এমনকী সভ্যতার ইতিহাস। মায়া সভ্যতা উজাড় করেছিল ম্যালেরিয়া। আলেকজান্ডারকে বিষ দেওয়া হয়েছিল, নাকি ভারতের মশা ঢেলেছিল ম্যালেরিয়ার বিষ? তাঁর সাকিন গ্রিস দেশ থেকে রোগ ছড়ায় রোমে। সতেরোজন পোপ মারা গিয়েছেন ম্যালেরিয়ায়। ইতালি ছিল ম্যালেরিয়ার আড়ত, যদ্দিন না মুসোলিনি নামে এক যুদ্ধবাজ ফাসিস্ত শাসক জলা বুজিয়ে ধ্বংস করেন মশার বংশ।
গত কয়েক বছর ধরে কলকাতা তথা সারা দেশেই প্রবল মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে ডেঙ্গি। এ কি কোনও নতুন রোগ? আগে তো নাম শুনিনি, এত ঘটাপটা দেখিনি? তবে পঞ্চাশের দশকে, বিশেষত যারা দমদম, বেলগাছিয়া, বরানগরে থাকতেন তাঁরা হয়তো মনে করতে পারবেন এক জ্বরের কথা, যে জ্বরের সঙ্গে ছিল গাঁটে গাঁটে অসহ্য যন্ত্রণা।
রবীন্দ্রগানের প্রখ্যাত শিল্পী প্রসাদ সেনের কলেজ বেলার কথাতেও পাওয়া ডেঙ্গুর বৃত্তান্ত। ১৯৪১ সাল, সদ্য শান্তিনিকেতনে এসেছেন তিনি, সঙ্গী বন্ধু অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনেই তরুণ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এমন সময় শান্তিনিকেতনে হল ‘ডেঙু’। এই উচ্চারণই বলেছিলেন। হোস্টেলসুদ্ধু সবাই ‘ডেঙুজ্বর’-এ কাবু। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতেন।
১৯৫২-তে আফ্রিকার মোজাম্বিক ও তানজানিয়ার সীমান্তে মাকোন্ডে উপত্যকায় শনাক্ত হল নতুন ভাইরাস। স্থানীয় জনজাতির ভাষায় নাম ‘চিকুনগুনিয়া’। মূল শব্দ ‘কুনগুনিয়ালা’, অর্থ ‘যা বেঁকে যায়’। তা থেকেই ভাইরাসটির নাম হয়েছে চিকুনগুনিয়া। কারণ, এই জ্বর হলে রোগী সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না। হাঁটতে হয় খুঁড়িয়ে, লেংচে। তা হলে শান্তিনিকেতনে ওঁদের যে ‘ডেঙু’ হয়েছিল, তা কি সত্যি ডেঙ্গি, না চিকুনগুনিয়া? এই ভাইরাসেরও বহু নাম— চিকেন গুনিয়া, চিকেন গিনি।
বাংলায় ‘আরবোভাইরাস’ অর্থাৎ মশাবাহিত ভাইরাসদের মধ্যে তিনটের প্রকোপ বেশি— ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া আর জাপানি এনসেফালাইটিস (জে ই)। জে ই মূলত আক্রমণ করে শিশুদের। মস্তিষ্কের সংক্রমণ বলে বাচ্চারা অজ্ঞান হয়ে যায়। মেরুদণ্ডের রস নিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। মৃত্যুহারও বেশি। তবে গত ক’বছরে যে হারে ডেঙ্গিতে মানুষ মারা যাচ্ছে তাতে মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের ছোটবেলার কথা। তখন কলকাতায় এত লোক মরছিল যে ঠাকুর পরিবারের সবাই পানিহাটিতে আশ্রয় নেন।
তখন ডিএনএ-আরএনএ আবিষ্কার হয়নি। তাই জানা যায়নি, ডেঙ্গির কোন কোন সেরোটাইপ তখন কলকাতায় সার্কুলেট করছিল।
ডেঙ্গির ইতিহাস নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলেই, ইতিহাসের ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ে আফ্রিকার বেড়াল। ‘ডেঙ্গি’ শব্দটাও বহিরাগত। আফ্রিকায় বহু অঞ্চলের মানুষের ভাষা সোয়াহিলি-র ‘ডিঙ্গা’ থেকে এসেছে। মূল শব্দ ‘কিডিঙ্গাপোপো’। শেক্সপিয়রের প্রসপেরো অবাধ্য ক্যালিবানের শায়েস্তায় পাঠাত ভূতপ্রেত, যাদের অস্ত্র ছিল গাঁটে ব্যথা, চিমটি-খামচি, জ্বালাপোড়া। আফ্রিকাতেও চালু ছিল বিশ্বাস, অশুভ আত্মা মানুষের উপর ভর করে, শরীরের পেশি আর গাঁটে যন্ত্রণা দিয়ে দগ্ধে মারে। আক্রান্ত মানুষের হাবভাব পালটে যেত, সেই দশারই নাম ‘কিডিঙ্গাপোপো’।
শব্দের দোহাই দিয়ে কালো মানুষের উপর রোগের দায় চাপালে অন্যায় হবে। ইতিহাস বলছে, আফ্রিকার ‘ডেঙ্গি’-তে মিশেছে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের রংও। নতুন নতুন মুলুক জয়ে (পড়ুন দমন-পীড়নে) স্পেনীয়রা কার্যত পথিকৃৎ, ষোড়শ শতকেই উত্তর আটলান্টিকের অনেকটা তাঁদের মুঠোয়। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান মেশা স্প্যানিশে পাওয়া গেল ‘dengue’। মানেটা অদ্ভুত— ‘খুঁতখুঁতেপনা, বাড়াবাড়ি’। ডেঙ্গি-রুগিরা কাঠ-কাঠ হাঁটত, শাসকের ভাষা তা সইবে কেন? কৃত্রিম হাবভাবের মানুষকে ইংরিজিতে বলে ‘ড্যান্ডি’। রোগটিরও নাম হল ‘ড্যান্ডি ফিভার’।
সাহেবদের দাস বনে কালো আফ্রিকা পাড়ি দিল সাদা চামড়াদের দেশে। সেই সাহেবরাই গেল আমেরিকা, এশিয়া। সতেরো থেকে উনিশ শতকে নানা রঙের, পেশার, সংস্কৃতির মানুষ ছড়িয়ে পড়ল পালটে যাওয়া বিশ্বমানচিত্র জুড়ে। মানুষের গান, খাবার, পোশাক, উৎসব গেল ভিন ভুঁইয়ে। পৌঁছল জাহাজের দমবন্ধ খোলে সেঁধিয়ে, পায়ে হেঁটে, সাঁতরে।
পাড়ি দিল রোগজীবাণুও। দেখা যাচ্ছে, আঠেরো শতকের শেষে প্রথম স্বীকৃত ডেঙ্গি মহামারী হানা দিচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা আর আমেরিকায়, কাছাকাছি সময়েই! আমেরিকার অন্যতম স্থপতি বেঞ্জামিন রাশ-এর রিপোর্টে আছে প্রথম ‘কনফার্মড’ ডেঙ্গি-রোগীর কথা, ফরাসি বিপ্লবের বছরে! ডেঙ্গিকে তিনি বলেছিলেন ‘ব্রেকবোন ফিভার’। ঠাকুরমার ঝুলি-র ‘হাড়মুড়্মুড়ী ব্যারাম’ মনে পড়ে? রাক্ষসী রানির বিছানার তলায় শোলাকাটি, পাশ ফিরতে মড়মড়, রানির ভান যেন গায়ে অসহ্য ব্যথা। বেঞ্জামিন সাহেবের চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে মুলাকাত হয়নি (ডেঙ্গির এই তুতো ভাইরাসটির আবিষ্কার ১৯৫২’র আফ্রিকায়, তার এগারো বছরের মাথায়, ’৬৩-তেই দমদম সহ কলকাতার বহু এলাকা এর প্রকোপে কাবু), এর লক্ষণ বরং ব্রেকবোন ফিভারের সঙ্গে মেলে বেশি।
ডেঙ্গি তাই শুধু এক রোগ নয়। দাসপ্রথা, অভিবাসন, মানুষের বিশ্বব্যাপী গতায়াতের উত্তরাধিকার সে। আর বাঙালি তো সব কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ খোঁজে। রবীন্দ্রনাথেও ডেঙ্গি আছে।
‘প্রথম যখন আমাদের শহরে ডেঙ্গুজ্বর দেখা দিল, এই ব্যাধি আমার কাছে বেরিয়ে পড়ার মস্ত সুযোগের মতো এল। গঙ্গার ধারে পেনেটির বাগানে আমরা বাস করতে লাগলুম।…’
উপরোক্ত কথাগুলো ১৯২২ সালে লিখেছিলেন তিনি। ডেঙ্গির ভয়ে ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা গঙ্গার ধারে লালাবাবুদের বাগানবাড়িতে থাকতে এসেছিলেন। তবে সেই ‘ডেঙ্গুজ্বর’ আজকের ডেঙ্গি ছিল কি না, থাকলেও তাকে ডেঙ্গি বলা যাবে কি না, গবেষকরা বলবেন।
আফ্রিকান নামটা খটোমটো, তবে এক্ষুনি ‘হাড়মুড়্মুড়ী ব্যারাম’-এর নাম করলে অনেকেই বলবেন, এ রোগের কথা শুনেছি তো, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-তে! দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-তে ছিল ‘সোনার কাটি রূপার কাটি’ গল্প। রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, কোটালপুত্র, সদাগরপুত্র দেশ ছেড়ে বেরিয়ে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে পৌঁছন বনে। বনের ভূপ্রকৃতি আর গাছপালার বর্ণনা শুনলে মনে হয়, এ বাংলারই বন, ‘কেবল পাথর কাঁকর আর বড় বড় বট পাকুড় তাল শিমুলের গাছ!’ খাবারের খোঁজ করতে করতে সামনেই হরিণের মাথা দেখা, এবং তা কাটতে গিয়ে রাজপুত্র ছাড়া বাকিরা সবাই তাদের ঘোড়াসহ রাক্ষসীর পেটে। রাক্ষসী রাজপুত্রকেও খেতে চায়। রাজপুত্র আর এক রাজার রাজত্বে পালিয়ে এসে, এক আমগাছের ভিতর লুকিয়ে থাকে, আর রাক্ষসী আমগাছের নীচে পরমাসুন্দরী সেজে কাঁদতে থাকে। সে দেশের রাজা বনে এসে কান্না শুনে সেই সুন্দরীকে বিয়ে করলেন। এই বার শুরু রাক্ষসীর খেলা। সেই রাজপুত্রকে খাওয়ার জন্য বা তাকে মারার জন্য গল্পে কিসের অবতারণা হয়, সেটাই আসলে দেখার। দক্ষিণারঞ্জন সারা বাংলা খুঁজে, দিদিমা-ঠাকুরমাদের মুখের গল্প সংগ্রহ করে, অবিকল সেই মুখের ভাষাতেই রচনা করেছিলেন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’।
বার ঠাকুরমাদের মুখের ভাষায় সেই হাড়মুড়্মুড়ী ব্যারামের ‘ইটিওলজি’ দেখা যাক। রাক্ষসী ‘সাত বাসি পান্তা, চৌদ্দ বাসি তেঁতুলের অম্বল খাইয়া অসুখ বানাইয়া বসিল।’ কী অসুখ? গা-গরম। সাবক্লিনিক্যাল ফিভার। মানে ওই একটু জ্বর আর কী। এ রকম বাসি খাবার খেয়ে পেটের রোগ হওয়াই স্বাভাবিক। টাইফয়েডে তা-ই হয়। আর তেঁতুলের জলের সঙ্গে জ্বরের একটা যোগাযোগ বাংলার মানুষের মনে চিরকালই রয়েছে। পশ্চিম বাংলার মানুষেরা খুব পুরনো তেঁতুলের টক খেতে ভালবাসেন। কথামৃতে লিখিত, ‘জ্বর বিকারের রোগীর ঘরে তেঁতুল আর জলের জালা’। রানি যে রোগী সাজতে চাইছেন তার প্রথম লক্ষণ, হালকা জ্বর। আর? ‘রাক্ষসী বিছানার নীচে শোলাকাটি পাতিল। পাতিয়া সেই বিছানায় শুইয়া রঙ্গীমুখ ভঙ্গী করিয়া…’ এখানে একটু থামা দরকার। ঠাকুরমা কিন্তু বলছেন না, ‘রঙ্গী মুখভঙ্গী করিয়া’। বলছেন ‘রঙ্গীমুখ ভঙ্গী করিয়া’। মানে রাঙা মুখে নানা বিকৃতি করে, উঃআঃ করে। এ বার আসুন চিকুনগুনিয়ায়। জ্বরের সঙ্গে রোগীর (বিশেষত মেয়েদের) নাক আর গালের দু’পাশ লাল হয়ে যায়। হেমারেজিক ডেঙ্গির ক্ষেত্রেও কিন্তু জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে মুখ লাল হয় না। হয় জ্বরের কিছু দিন বাদে, যখন ‘হেমারেজিক ম্যানিফেস্টেশন’ শুরু হয়। চিকুনগুনিয়ায় মুখ লাল হয়ে মুখে র্যাশ দেখা যায়, শরীরের অন্য জায়গার মতোই। তবে লাল হওয়াটা মুখেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
আরও পড়ি। ‘একবার ফিরে এ-পাশ, একবার ফিরে ও-পাশ’। রাক্ষসী রানির শরীরের চাপে শোলাকাঠি ভাঙে আর রাজা ভাবেন, রানির হাড়গুলো মুড়মুড় করছে। ভাইরাল জ্বরে রোগীর অস্বস্তির কী সুন্দর উপস্থাপন: ‘রাজা আসিয়া দেখেন, রাণী খান না, দান না, শুক্ন ঘরে জল ঢালিয়া চাঁচর চুলে আঁচড় কাটিয়া, রাণী শুইয়া আছেন।’ চিকুনগুনিয়াতেও রোগী সারা শরীরে অস্বস্তি অনুভব করেন। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে ‘সাইন’ ও ‘সিম্পটম’ বলা হয়, রাক্ষসী রানি দুয়েরই অবতারণা করেছেন সফল ভাবে। শেষে ডায়াগনোসিসও নিজেই করে ‘কোঁকাইয়া কোঁকাইয়া’ বলছেন ‘আমার হাড়মুড়্মুড়ীর ব্যারাম হইয়াছে’ (কারণ ওকে তো রাজপুত্রকে মারতে হবে)। শুনে ‘রাজা বলিলেন— হায় কি হইবে!’ রাজ্যের রাজা যখন রোগের নাম শুনে বলেন ‘কী হবে’, তখন এটা নিশ্চিত যে এর ওষুধ জানা নেই। আর রোগটাও সে রাজ্যে খুব সাধারণ, কারণ রাজা বলছেন না, বদ্যি ডেকে পরীক্ষা করাই তোমার কী রোগ হয়েছে। মানে, এ রোগের লক্ষণ ঠাকুমা-দিদিমাদের ভালই জানা ছিল। ‘কত ওষুধ, কত চিকিৎসা; রাণীর কি যে-সে অসুখ? অসুখ সারিল না!’ রাক্ষসী তো আসলে রোগের অভিনয় করছে। দু’টো ব্যাপার স্পষ্ট: এ রোগের কোনও চিকিৎসা ছিল না, আর এ রোগ বহু দিন ভোগায়। ‘পারসিস্টিং পলিআরথ্রালজিয়া’র সঙ্গে মিলে যাচ্ছে? মানে— ছ’মাস থেকে এক বছর গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা।
তখনকার দিনে আরও বহু রোগ জানা ছিল সবার। তার কিছু না কিছু চিকিৎসাও জানা ছিল। কিন্তু যে রোগ বাংলায় প্রায়ই হয় অথচ ওষুধ নেই, সেটাই রানির অভিনয়ের জন্য আদর্শ রোগ। এ বার মোক্ষম কথা বলল রাক্ষসী, ‘ওষুধে তো কিছু হইবে না, বনের সেই আমগাছ কাটিয়া তাহার তক্তার ধোঁয়া ঘরে দিলে তবে আমার ব্যারাম সারিবে।’ একেবারে অ্যাসিড টেস্ট। মানে এ ব্যাপারটা জানা, ওষুধে এ রোগ সারে না, কিন্তু ঘরে ধোঁয়া দিলে প্রকোপ কমে। তা হলে কি মশা থেকে এ রোগ হয়, সে ধারণা ছিল? নিশ্চয়ই ছিল, তাই রাজপুত্রকে মারার ফন্দিতে রাক্ষসী এমন রোগের রোগী সাজলেন যার কোনও চিকিৎসা নেই, অথচ এটা জানা যে ঘরে ধোঁয়া দিলে তার প্রকোপ কমে!
এই গল্পেই পরে দেখি ওই রাক্ষসীর মা, বুড়ি ‘আয়ীমা’-কে। সকাল হতেই সে ‘কাজে’ বেরিয়ে যায়, ফিরে রাজকন্যাকে বলে পায়ে প্রদীপের তেল মালিশ করে দিতে। বুড়ি মানুষ, বাতের ব্যথা থাকাই স্বাভাবিক। আমরা যাকে বলি গেঁটে বাত। কিন্তু যে বুড়ো মানুষের বাত, সে কি সারা দিন ‘হাঁপাইয়া হুঁপাইয়া’ খাবারের সন্ধান করতে পারে?
বয়স্ক বাতের রোগী মোটেই দৌড়ঝাঁপ করতে পারেন না। বরং চিকুনগুনিয়া রোগীদের দেখা যায়, সারা দিন কাজের পর ঘরে ফিরলে তাঁরা ব্যথাটা বেশি টের পান। ক্লান্ত অস্থিসন্ধি প্রদাহ জানান দেয়। সারা দিন কাজের তোড়ে ব্যথা টের পান না। একটু পুরনো চিকুনগুনিয়া রোগীদের এই কথাই বলতে শোনা যায়। বরং বাত রোগীরা ‘মর্নিং স্টিফনেস’-এর কথা বলেন। ঘুম থেকে উঠে গাঁটে ব্যথা থাকলে কিন্তু রাক্ষসী বুড়ি আয়ীমা কাজে বেরোতে পারত না। তাই সন্ধ্যায় ফিরে এসে বলে ‘হ্যাঁ লো হ্যাঁ নাঁত্নি, পাঁ-টা তোঁ কঁট্ কঁট্ই কচ্ছে। একটু টিঁপিয়া দিঁবি।’ তর্কের খাতিরে কেউ অস্টিওআরথ্রাইটিস-এর কথা তুলতে পারেন। এটুকুই বলার, সেই রোগীরা দৌড়ঝাঁপ করতে পারেন না। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, বুড়ির কিছু কাল আগে হাড়মুড়্মুড়ীর ব্যারাম হয়েছিল। সেই ব্যথায় তিনি এখনও ভুগছেন। আর তার মেয়েটি মায়ের রোগেরই অভিনয় করছে। এই গল্পে আমরা ‘অ্যাকিউট’ ও ‘ক্রনিক’, দু’রকম চিকুনগুনিয়ারই বর্ণনা পাচ্ছি।
বাংলায় প্রাচীনকাল থেকেই চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ ছিল। হালে আফ্রিকায় ভাইরাসটিকে ডেঙ্গির থেকে জেনেটিক্যালি আলাদা করা গেছে। আগে পশ্চিমের দেশগুলোতে ডেঙ্গিকেই ‘বোন-ব্রেকিং ফিভার’ বলা হত। সেই রোগীরা ডেঙ্গির নয়, চিকুনগুনিয়ার শিকার ছিলেন। এটা পরিষ্কার যে মশাবাহিত রোগ বাংলায় নতুন নয়। আগে আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না বলে রোগের ঠিক শনাক্তকরণ সম্ভব ছিল না। মশাবাহিত প্রতিটি রোগ সম্পর্কেই জনসচেতনতা দরকার। আমরা ক্রান্তীয় অঞ্চলের মানুষ, ‘রেতে মশা দিনে মাছি’ নিয়েই আমাদের বাস করতে হবে। দরকার শুধু ঠিক জ্ঞান, আর ঠিক রোগের ঠিক চিকিৎসা। সঙ্গে মশারির নিত্য ব্যবহার।
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯শে নভেম্বর ২০১৭ সাল।
২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত