দ্বিতীয় মোদী সরকারের শাসনকালে সংসদে গঠনমূলক বিরোধীর ভূমিকা পালন করেছে একমাত্র তৃণমূল। কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলি বিতর্কে জড়ানো এবং এলোমেলো তর্ক জোড়া ছাড়া বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি। কখনও কখনও আপোষও করে ফেলেছে। অন্যদিকে তৃণমূলের সাংসদরা বিলের আলোচনায় অংশ নিয়েছে, জিরো আওয়ারে উল্লেখযোগ্য বিষয় তুলে ধরে সরকার ও সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সব মিলিয়ে মেরুদণ্ড সোজা রেখে গোটা সংসদ জুড়ে ঋজু থেকেছে তৃণমূল।
সদ্য শেষ হয়েছে সপ্তদশ লোকসভার বর্ষাকালীন অধিবেশন। ৩৮ কর্মদিবসের দীর্ঘ অধিবেশন জুড়ে মোদী সরকারের লক্ষ্য ছিল একটাই, যত বেশি সম্ভব বিল পাশ করিয়ে নেওয়া। সে অসাংবিধানিক, অসংসদীয় পথে সংসদকে বুলডোজ করে হলেও। বোঝা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে চললেও অধিবেশনের কর্মপদ্ধতি ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের।
এবার ৩৮ দিনের অধিবেশনে ৩০ টি বিল পাশ করানো হয়েছে। যার মধ্যে ৫ টি বিল স্ক্রটিনি করেছে সংসদীয় কমিটি। অর্থাৎ ১৭ শতাংশ বিল। বাকি ২৫ টি বিল, যেগুলি স্ক্রটিনি করা হয়নি, দূর্ভাগ্যক্রমে সেগুলিও আমজনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল।
এটাই বিজেপি সরকারের ট্রেডমার্ক। কিন্তু বিল সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর একটি স্বাস্থ্যকর প্রবণতা ছিল সংসদের। ২০০৪-২০০৯ সাল পর্যন্ত চর্তুদশ লোকসভায় ৬০ শতাংশ বিল পাশ হয় সংসদীয় কমিটির নিরীক্ষণের পর। এরপর দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে সেই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ শতাংশ। অথচ মোদী জামানার প্রথম পাঁচ বছরে মাত্র ২৬ শতাংশ বিল কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। আর দ্বিতীয় মোদী জামানার সপ্তদশ লোকসভায় সেই হার আরও নিম্নগামী।
বিলগুলিকে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে জনসাধারণের পরামর্শ নেওয়ার পদ্ধতি চালু করা হয়। বিলগুলিকে আরও শক্তপোক্ত করার লক্ষ্যে স্টকহোল্ডারদের পরামর্শও নেওয়ার কাজও শুরু হয়। এর ফলে বিলের সামগ্রী এবং গুনমান আরও উন্নত হত। কিন্তু এনডিএ সরকার স্ক্রুটিনি এড়িয়ে গেছে, সংসদীয় কমিটিকে আপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। শেষ তিনটি লোকসভার প্রথম সেশনে শাসক দল একটি বিলও পাশ করায়নি। স্ট্যান্ডিং কমিটিও তইড়ী করে উঠতে পারেনি। যাই হোক, সপ্তদশ লোকসভার অধিবেশনের ৩৮ দিনে ৩০ টি বিল পাশ করিয়ে ফেলেছে সরকার। ৩৮ দিন, যা কিনা চতুর্থ লোকসভার প্রথম ও দিতীয় অধিবেশন যৌথ ভাবে হয়েছিল।
এর ফলে প্রশ্ন উঠছে, এত তাড়াহুড়ো কিসের? তাদের অজুহাত, যে কমিটি সপ্তদশ লোকসভার জন্য পুনর্গঠিত করা হয়েছে সেখানে কোনও বিল পাঠানো সম্ভব নয়। কিন্তু তথ্য বলছে, উল্টোটা। ১৬তম লোকসভাতে ১০টি বিল যখন স্কুটিনির জন্য পাঠানো হয়েছিল তখন এই কমিটি তৈরিই হয় নি। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ লোকসভাতে এই বিলের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১১ ও ৬।
তৃণমূল বরাবরই গঠনমূলক বিরধিতার ভূমিকা পালন করেছে। চেয়েছে একটি বিলের সেরা অংশটাই আইনে রূপান্তরিত হোক। বিরোধী এবং সরকার একসঙ্গে কাজ করে উন্নত দেশ গঠন করবে, সেটাই কাম্য। বিল পাশের রেকর্ড ভেঙে শিরোনামে আসা তার লক্ষ্য হতে পারে না।
সংখ্যার জোরে মোদী সরকার সংসদে বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় হস্তক্ষেপ মোটেই মেনে নেয়নি তৃণমূল। ইউএপিএ, এনআইএ, আরটিআই, মোটর ভেহিকেলস, ন্যাশনাল মেডিকেল কাউন্সিল, কনজিউমার প্রোটেকশন, কোড অব ওয়েজেস, ড্যাম সেফটি, ইন্টারস্টেট রিভার ওয়াটার ডিসপিউটের মতো একগুচ্ছ বিলে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। তাই এসব বিলে সংশোধন বা বিরোধিতা করেও আটকানো যায়নি। কারণ বিজেপির সংখ্যার জোর। তবে বিষয়গুলি নিয়ে সংসদের বাইরে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা জারি রেখেছে তৃণমূল।