ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা তিন ফুটবলারের নাম জিজ্ঞাসা করা হলে সেই ত্রয়ীর মধ্যে যে নামটা থাকবেই তা হল তুলসীদাস বলরাম।১৯৬১ সালে ইস্টবেঙ্গলের কলকাতা লিগ জেতার অন্যতম কারিগর ছিলেন এই তুলসীদাসই। শুধু এই লিগই নয়, ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে বহু ম্যাচ জিতেছেন তিনি। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষে দেখা মিলল না এই নায়কের। অজানা এক অভিমানে এই আনন্দের কোলাহল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন তিনি।
উত্তরপাড়ায় নবনীতা দেবসেনের ওপরের ফ্ল্যাটে যে তুলসীদাস বলরাম থাকেন, জানতাম না। তাঁর ফ্ল্যাটের তলা দিয়ে, আক্ষরিক অর্থেই ফ্ল্যাটের তলা দিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। দিনের অধিকাংশ সময় পেছন দিকের বারান্দায় বসে নৌকো, স্টিমার দেখে সময় কাটান। প্রার্থনা করেন গঙ্গার ওপারে রামকৃষ্ণদেবের স্মৃতিবিজড়িত মা ভবতারিণীর উদ্দেশে। ডান দিকে দক্ষিণেশ্বর ব্রিজ। এভাবেই নিজেকে শহরের কোলাহল থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন কিংবদন্তি ফুটবলার।
কিন্তু কেন এভাবে সব ছেড়ে আছেন তিনি? অভিমান? হয়তো। হয়তো বা নয়। কিন্তু নিজেকে ভাঙেন না। মনঃকষ্ট যদি থাকেও, কথাবার্তায় যদি বিচ্ছুরণ পাওয়াও যায়, তিনি অভিমানের বরফ গলতে দিতে চান না। রবিবার সকালে কুমোরটুলি লাল–হলুদ ছিল জমজমাট। এমন ঝলমলে অনুষ্ঠানে তুলসীদাস বলরামও তো আসতে পারতেন। আসেননি। ক্লাব আমন্ত্রণে কোনও কার্পণ্য করেনি। এমনকি প্রাক্তন ফুটবলারদের পাঠিয়ে তাঁকে আসার অনুরোধ করা হয়েছিল। তবু তিনি আসেননি। তিনি বললেন, ‘কীসের অভিমান? যে ক’বছর খেলেছিলাম ফাঁকি দিইনি। ক্লাবের অমর্যাদা হোক, এমন কাজ করিনি। একটিও বেশি টাকা দাবি করিনি। মোহনবাগানের ধীরেন দে ডেকেছিলেন বারবার। বিরক্ত হচ্ছিলাম। ট্যাক্সি চেপে ওঁর বাড়ির তলায় গিয়ে হাতজোড় করে জানিয়ে এসেছিলাম, আমার পক্ষে ইস্টবেঙ্গল ছাড়া সম্ভব নয়। তাঁর আমন্ত্রণে দোতলা পর্যন্ত উঠিনি। পাছে আমন্ত্রণের ফাঁদে আটকে যাই। শুরুতেই দুঃখপ্রকাশ করে চলে এসেছিলাম। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা চিরকাল ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। এটাই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া। মানুষের ভালবাসা টাকায় কেনা যায় না। তাই তো, হায়দরাবাদে সব থাকা সত্ত্বেও কলকাতা ছাড়তে পারিনি। এখনও কোনও রাজনৈতিক নেতা বা বিশিষ্টজনের কাছে আবদার নিয়ে গেলে ওঁরা সম্মান করেন। ওঁরা জানেন, নিজের জন্য কোনও আবদার কখনও করিনি। এই ৮৪ বছর বয়সেও করব না। মানুষের পাশে থাকতে চাই। সঙ্গতি বিশেষ নেই। কিন্তু যদি আমার উপস্থিতিতে কারও অসুবিধা দূর হয়ে যায়, কেন এগিয়ে যাব না?’
বলরাম মনে করেন, আমেদ খান, সালে, আপ্পা রাওরা যদি কোচ রহিমসাহেবের কথা শুনে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের দিকে নজর না দিয়ে, টিমগেমের দিকে নজর দিতেন, ভারত অনেক ভাল রেজাল্ট করতে পারত, ‘নাম বলব না। তবে, রহিমসাহেবের এই প্রস্তাব শুনে সেই আমলের এক দিকপাল ফুটবলার বলেছিলেন, কোচ যেন ফুটবল শেখাতে না আসেন। আমরা তখন উঠতি। সিনিয়রদের বিদায়ের পর রহিমসাহেব জোর করেই টিমগেমের দিকে মন দিতে বলেছিলেন। বাধ্য ছেলের মতো আমি–চুনী–পি কে–সহ গোটা দল নতুন ঘরানায় মন দিয়েছিলাম। ৫৬ অলিম্পিকে সেমিফাইনালে উঠেছিলাম। শুনলে অবাক হবেন, ৬৮ মিনিট পর্যন্ত নেভিল ডি’সুজার গোলে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও চেকোশ্লোভাকিয়ার কাছে হেরে গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড ঠান্ডা এবং ৭০ মিনিটের বেশি খেলার অভিজ্ঞতা না থাকায় হয়তো ফাইনালে পৌঁছতে পারিনি। কিন্তু দুনিয়া বুঝেছিল, ইন্ডিয়া ক্যান প্লে গুড ফুটবল।’ এমনকি ফিফা সভাপতি স্ট্যানলি রাউস ড্রেসিংরুমে এসে পা টিপে টিপে দেখছিলেন কী জুতো পরে খেলতে গিয়েছিলাম, ‘এখন ভারত র্যাঙ্কিংয়ে ১০৩–এ পৌঁছেছে। পরের প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন, কেন আরও মন দিয়ে খেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেলে না? আমরা তো দেশের ফুটবলকে ধ্বংস করিনি।’ শোনালেন কীভাবে ফেডারেশন কর্তারা বছরের পর বছর জঘন্য পরিকল্পনা করে উন্নতির কথা বলে গিয়েছেন। ঘোষণা সত্ত্বেও পদ্মশ্রী না পাওয়ার ব্যাপারটাও এখন আর কষ্ট দেয় না তাঁকে।
বলরাম জানালেন, “আমি চাই, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এই উৎসবের কথা যেন গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আমিও গর্ব করে বলতে পারব, এই ক্লাবে খেলেছিলাম আমিও। আমি সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলব, চুটিয়ে আনন্দ করুন। ওরা সবাই ভাগ্যবান যে, শতবর্ষের উৎসবে ওরা শামিল হতে পারছে। প্লিজ, সমর্থকদের আমার ভালবাসা ও শুভেচ্ছার কথা জানাবেন। স্বীকার করতেই হবে, ওদের ভালবাসার কারণেই আমি কখনও ইস্টবেঙ্গল ছাড়ার কথা ভাবিনি।” তবু, অভিমানের বরফ গলতে দিলেন না। একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিমায় ড্রিবল করতে করতে ছুঁতে দিলেন না সেই অপ্রীতিকর প্রসঙ্গকে। গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে থাকাটাই হয়তো তাঁকে শান্তির ভুবন তৈরি করে দিয়েছে। ড্রইংরুমের দেওয়ালে ঝোলানো আছে তা…