‘কালকেউটের ফণায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি, বেহুলা কখনো বিধবা হয় না এটা বাংলার রীতি’।
সুমন চাটুজ্জ্যের এই দু’টো লাইন অনেক কিছু বলে যায়। বলে যায় প্রেম, বিশ্বাস থেকে শুরু করে অতীত বাংলার গভীরের কিছু রীতি, কিছু আঁকড়ে থাকার গল্প। তেরো থেকে আঠেরো শতকের মাঝের কিছু ইতিহাস, কিংবা কোনও গল্পকথা, যার উপর ভর করে এখনো বাংলা সংস্কৃতিতে মেয়েরা শাঁখায় সিঁদূর ছুঁইয়ে বলে, ‘সিঁথির সিঁদুর’ অক্ষয় হোক। একুশ শতাব্দীর মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে, এই প্রজন্মের মানুষগুলোর কাছে যেখানে ভালোবাসা একপ্রকার বিলাসিতা, বা প্রহসন, তাঁদের শিকড়ের গল্প শোনায় মা-কাকিমারা। জানায় ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’…
তবু এখনো নারীর মহিমা নিয়ে কথা উঠলেই সতী বেহুলার নাম ওঠে। মৃত স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার যে পৌরানিক কাহিনী বাংলায় প্রচলিত আছে, তার কোনায় কোনায় লুকোনো আছে এক ভালোবাসার গল্প, আঘাত, বিচ্ছেদ, ফিরে পাওয়া। হ্যাঁ, পৌরানিক গল্প কথায় বেহুলা-লখিন্দরের প্রেমকথা এক অন্য মাত্রা পায়।
মনসা-মঙ্গল কাব্যে সর্বপ্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তাদের ভালোবাসার গল্প বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বেহুলা ও লখিন্দরের প্রেমগাঁথা এমনই এক অমর কাহিনী। মাইথোলজিতে ডুব দিয়ে পৌঁছাতে হবে একদম দেবলোকে। দেবতা শিবের কন্যা ছিলেন মনসা। কিন্তু সাপের দেবী হবার কারণে কেউই মনসাকে পূজা করতো না। এতে তার দেবীত্বের দিক থেকে প্রশ্ন দেখা দেয়। এমন অবস্থায় দেবতা শিব তার কন্যাকে একটি সমাধান দিলেন। কোনো ভক্তিমান শৈবকে যদি পূজা করার জন্য কোনোভাবে রাজি করানো যায়, তাহলে মর্ত্যলোকে তার পূজার প্রচলন করা যাবে। চম্পকনগর এলাকার চাঁদ সদাগর ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনিই লখিন্দরের বাবা। দেবী মনসা পূজা কামনার জন্য তাকে নির্বাচন করলেন।
সদ্য বিবাহিত বেহুলার বাসর ঘরে মনসার আদেশে প্রবেশ করে এক কালকেউটে। বেহুলার স্বামীর সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়। তখনকার দিনে নদীতে সাপে কাটা রোগীকে ভেলা ভাসিয়ে দেওয়া হতো। বেহুলা সেই ভেলায় চেপে বহু প্রতিকুলতা পেরিয়ে স্বর্গ থেকে স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা করে ফিরে আসেন। এবং এসে চাঁদ সওদাগরের হাত দিয়ে মনসাকে পুজো দেওয়ানোয় রাজি করান। এতে মনসার দেবীত্ব লাভ হয়। তিনি মর্তে পুজিত হন।
যুগ যুগ ধরে প্রচলিত বেহুলা ও লখিন্দরের এই প্রেমকাহিনী প্রভাব রেখেছে বাংলার রমণীদের উপর। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সকলের মুখে মুখে ফেরে এই কাহিনী। স্বামীভক্তি ও স্বামীর প্রতি প্রেমের অনন্য উদাহরণ হিসেবে যুগ যুগ ধরে টিকে আছে এটি। এই কাহিনীকে কেন্দ্র করে অনেক সিনেমা, নাটক ও সিরিয়ালও তৈরি হয়েছে। সেসব সিনেমায় বড় বড় অভিনেতারা অভিনয় করেছেন, পরিচালনাও করেছেন বড় বড় পরিচালকেরা। সাহিত্যিক, গল্পকার ও কবিদের সৃষ্টিকর্মেও এই কাহিনীর প্রভাব বিদ্যমান। ভালোবাসার এমন উদাহরণ একদমই বিরল, এমনকি পুরাণ ও উপকথাতেও বিরল। এমন দুঃসাহসী ভালোবাসার গল্প যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে ফেরে অমর হয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।