ফেলুদা, তোপসে ও জটায়ুকে সঙ্গে নিয়ে একবার পৌঁছে গিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের মহিতোষ সিংহ রায়ের জমিদারিতে। একটি ধাঁধাঁর রহস্য সমাধান করার দায়িত্ব পড়ে তাঁর ঘাড়ে। সেই রহস্য সমাধান করতে করতে গিয়ে গল্পের শেষে তাঁদের ভাগ্যে জুটেছিল ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’-এর দর্শন। কিন্তু আমরা কি আর চাইলেই এই দর্শন পাবো? পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা দেশে ছড়িয়ে আছে অনেক জঙ্গল। কিন্তু জঙ্গল শুনলেই যে প্রাণীদের কথা শৈশব থেকে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, স্বচক্ষে তাঁদের দর্শন মেলা ভার।
যতদিন যাচ্ছে আমরা আধুনিক হচ্ছে। আর সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে আমাদের মধ্যে ঐতিহ্যের মাত্রা। আর এই ঐতিহ্যের মধ্যে জড়িয়ে থাকা বহু সংস্কৃতি, বহু ভাস্কর্য, বহু স্থাপত্য সঙ্গে বহু প্রজাতি। দিনে দিনে বিলুপ্ত হচ্ছে সব। জাদুঘরে যেমন সংরক্ষিত আছে বহু বিলুপ্ত সংস্কৃতি, তেমনই বহু বিলুপ্ত প্রজাতি সংরক্ষিত চিড়িয়াখানা বা ‘জাতীয় সংরক্ষিত বন’-এ। তেমনই এক প্রজাতি কিংবা বাংলার গর্ব ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ও আজ বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মধ্যে। দিনে দিনে যে পরিমাণ বাঘের সংখ্যা কমতে থাকছে তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ডাইনোসর যেমন আজ আমাদের কাছে রূপকথার গল্প, ঠিক তেমনই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই ‘বেঙ্গল টাইগার’ও সেই জায়গায় স্থান পাবে।
মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে এই বাঘের অস্তিত্ব এখনও আছে। মূলত, এই দুইদেশের মধ্যে বিস্তৃত সুন্দরবন অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব বর্তমান। বাংলাদেশের খুলনা থেকে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা পর্যন্ত বিস্তৃত এই সুন্দরবন। আর এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যেই বিচরণ করে বাঘেদের মধ্যে অন্যতম সুন্দর প্রজাতি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। দিনে দিনে এই সংখ্যা তলানিতে ঠেকছে। ২০১৫ সালের গণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে এই বাঘের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০৩টি। আর দুই দেশ মিলিয়ে সেই সংখ্যা মাত্র ২০০টি। আর এই কমে যাওয়ার পেছনে আছে মূলত মানুষের হাত। তাছাড়াও আছে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা। শিকার, চোরাশিকারের মতো কারণে সংখ্যা ক্রমহ্রাস ঘটছে। এছাড়া আবহাওয়ার পরিবর্তনের মতো ঘটনাও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে আইইউসিএন রেড লিস্টে বিপন্ন হিসাবে তালিকাভুক্ত এই প্রজাতি।
যদিও ভারত সরকার ও বনবিভাগের পক্ষ থেকে নানান উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তাঁদের সংরক্ষণ করার জন্য। তবুও কোথাও যেন খামতি থেকে যাচ্ছে। উপযুক্ত পরিকাঠামো বা নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলি সঠিক ব্যবহার না হওয়ায় বিপন্ন হচ্ছে ঐতিহ্য। আর পরিবেশে বাস্তুতন্ত্রের ওপর পড়ছে প্রভুত প্রভাব। পরবর্তীকালে এই ভারসাম্যহীনতা মানুষের জীবনধারণের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বাঘেদের অস্তিত্ব বজায় রাখা কর্তব্য। তাই আমাদের শপথ নেওয়া উচিৎ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যেন রূপকথার গল্প না হয়ে ওঠে তা আমাদেরই দেখা উচিৎ।
অন্যদিকে, এই সুন্দরবনবাসীর কাছে তাঁদের প্রাণকর্ত্রীর নাম বনবিবি। হিন্দুদের কাছে তিনি দেবী, মুসলমানদের কাছে পিরানী। তাকে বলা হয় সুন্দরবনের ‘গার্ডিয়ান স্পিরিট’ বা রক্ষাকারী শক্তি। মৌয়াল বা মধু সংগ্রাহক, কাঠুরে, বাওয়াল, জেলে সম্প্রদায়ের কাছে তিনি পরম আস্থার প্রতীক। সুন্দরবনের ৬০-৪০ ভাগ অংশ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত, দুই অঞ্চলের মানুষের কাছেই সমান জনপ্রিয় বনবিবি। দক্ষিণবঙ্গের আবহমান সংস্কৃতির সাথে মিশে থাকা বনবিবিকে স্মরণ করে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ‘মা বনবিবির পূজা’। সুন্দরবনের শুধু মানুষ নয়, পুরো এলাকাই এই দেবীর পায়ের কাছে রত। সব মিলিয়ে আমাদের এই পৃথিবীকে সুন্দর করে তৈরি করতে হবে। প্রার্থনা রইল সবার কাছে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত