সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল?
সে কি কেবলই দুঃখের শ্বাস?
প্রতিদিনের জীবনে মানুষের মধ্যে নতুন করে প্রেম আসে। মানুষ সেই ভালোবাসায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে ভালো থাকার মন্ত্র খোঁজে। আবার ফিরে আসে যন্ত্রণাও। আর সেই মানুষটির নাম যদি হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাহলে সেটা আলাদা করে ভাবতে বসায় আমাদের। যাঁর লেখনীর প্রতি ছত্রে ফুটে ওঠে ভালোবাসা। প্রেমের প্রতিটি স্তর নিয়েই আসে তাঁর লেখা। কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক প্রতি ক্ষেত্রেই তিনি প্রেমের সুরা পান করিয়েছেন মানুষকে। আজও তিনি একইভাবে জুড়ে আছে মানুষের মনে। নিভৃত কোণে একাকী বসে রবীন্দ্রনাথের কলিতে গলা মেলানো ছেলে-মেয়েটা ভালোবাসার নতুন রস খোঁজে কবির সৃষ্টিতে।
সেই মানুষটির জীবনেও পরতে পরতে প্রেম-দুঃখ দিয়ে ঘেরা ছিল। বিচ্ছেদের যন্ত্রনা তাঁকেও নিভৃতে কাঁদাত। আজকের মানুষের কিশোর জীবনে প্রেমগুলো যেমন জোয়ারের মত এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তেমনই কিশোর বয়সে রবীন্দ্রনাথকেও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আরব সাগরের পাড়ের শহর বোম্বেতে (অধুনা মুম্বই)। তাঁর জীবনেও এসেছিল ‘নলিনী’-র ভালোবাসা। এই মানুষটির নাম আমরা কবির সৃষ্টির কিছু পরতে পেয়ে থাকি। কবির এই গোপন ভালোবাসা কবির মনেই উজ্জ্বল ছিল আজীবন। সতেরো বছরের কিশোর রবীন্দ্রনাথের মন উত্তাল করেছিলেন বোম্বেবাসীনি অন্নপূর্ণা তর্খদ।
শুরু হয় কবির জীবনে কৈশোর-প্রেম। অন্নপূর্ণা কবির কাছে নলিনী হয়ে ওঠেন। সেই সময় সমাজে খুব উচ্চ স্থানীয় ছিলেন নলিনীর পিতা আত্মারাম তর্খদ। পেশায় ডাক্তার আত্মারাম নতুন সমাজ প্রবর্তনের পথে যান। আর তাঁর তৈরি ‘প্রার্থনা সমাজে’-র সঙ্গেই যুক্ত হয়ে পড়েন কবির দাদা সতীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর তাঁর ভাইয়ের ইংরেজি শিক্ষার জন্য ঠিক করেন অন্নপূর্ণাকে। শুরু হয় কবির নতুন জীবন। ধীরে ধীরে অন্নপূর্ণা কবির কাছে হয়ে ওঠেন তাঁর ‘নলিনী’। আত্মারামের বাড়িতে থেকেই কবির ইংরেজি শিক্ষার পাঠ চলছিল। আর ধীরে ধীরে বাড়ছিল কৈশোরের নতুন ভালোবাসা। যদিও নলিনী কবির থেকে ৩ বছরের বড় তবুও সেই প্রেমে ছিল বিশাল গভীরতা। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অসম ভালোবাসাকে মেনে নেননি। তাই সেটা বিয়ের গন্ডিতে বাধা পড়ে নি। কিন্তু কবির মনে এই ভালোবাসা গভীর রেখাপাত করেছিল। তাঁর লেখার পক্কতা ছিল এই ভালোবাসা।
১৮৮০ সালে অন্নপূর্ণার বিয়ে হয় অন্যত্র আর কবিও পাড়ি দেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। আপাতত দৃষ্টিতে বিচ্ছেদ হলেও দুজনের মনে দুজনেই চির প্রেমে আবদ্ধ ছিলেন। কবির লেখনীতে নলিনী চরিত্র হয়ে উঠে এসেছে বারবার। নলিনীর কাছে ইংরেজির দীক্ষা ঠিক কতটুকু নিতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা নিয়ে সবার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে! কিন্তু দুজনের মনের লেনাদেনার হিসাব ঠিকই করে নিয়েছিলেন তাঁরা। পড়ার টেবিলে যতটুকু না পড়ালেখা হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি প্রেমের বিনিময় হয়েছিল! তাই ১৯৮১ সালে যখন কবির কৈশোর প্রেম পরলোকে পড়ি দেন তখন কবির কন্দনরত মন আর কাঁপা হাতে সৃষ্টি পেল…
শুন নলিনী, খোল গো আঁখি,
ঘুম এখনো ভাঙ্গিল না কি!
দেখ, তোমারি দুয়ার-’পরে
সখি এসেছে তোমারি রবি।