কৃতী ছাত্রী কৃত্তিকা পালের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কিনারা করতে গিয়ে একটার পর একটা রহস্যে আটকে পড়ছে পুলিশ। জি ডি বিড়লার দশম শ্রেণীর এই ছাত্রীর মৃত্যুকে প্রাথমিক ভাবে আত্মহত্যার ঘটনা বলেই মেনে নিচ্ছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু যে ভাবে এই আত্মহত্যা, এবং আত্মহত্যার আগে যে ভাবে ঠান্ডা মাথায় তিন পাতার চিঠি লিখে গিয়েছে কৃত্তিকা, তদন্তকারী পুলিশ অফিসাররা তাতে রীতিমতো বিস্মিত।
চিঠিতে কৃত্তিকা কাউকে দায়ী করে যায়নি। কিন্তু চিঠিতে তাঁর মনের ক্ষোভ, অসন্তোষ, অভিমান প্রকাশ হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু এতো কিছুর মধ্যে চিঠির একটা লাইন বড় ধোঁয়াশায় ফেলেছে পুলিশকে। কৃত্তিকা লিখেছে, “…আই লভ ইউ কে (K), ডোন্ট ফরগেট মি…”। এই ‘কে’ কারও নামের আদ্যক্ষর বলেই মনে হয়। কিন্তু কে এই ‘কে’? এই ‘কে’র সঙ্গে কি তার মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক রয়েছে? এই ‘কে’র সঙ্গে কৃত্তিকার সম্পর্কই বা কী ছিল? অন্যরকম ভাবে ভাবলে, কৃত্তিকার নিজের নামের আদ্যক্ষরও কিন্তু ‘কে’। তবে কি মৃত্যুর আগে নিজের সঙ্গেই নিজে এমন নিঠুর পরিহাস করে গেল সে? তদন্তকারীদের কাছে এখনও এর উত্তর একেবারেই স্পষ্ট নয়।
পুলিশ জানতে পেরেছে, এর আগেও একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল কৃত্তিকা। তার অভিভাবকরা সেই ঘটনার কথা স্কুলে রিপোর্ট করেননি। শুক্রবারের ঘটনা ঘটার পর তা স্কুলকে জানানো হয়। দক্ষিণ কলকাতার রানিকুঠিতে জি ডি বিড়লা স্কুলের ক্লাস টেনে পড়ত মেধাবী ছাত্রী কৃত্তিকা পাল। বাড়ি বৈষ্ণবঘাটায়। শুক্রবার স্কুলের শৌচাগারে অচৈতন্য অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। মুখ প্লাস্টিকে মোড়া ছিল। বাঁ হাতের শিরা কাটা। পাশে পড়ে তিন পাতার চিঠি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। রিজেন্ট পার্ক থানার পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও, শুক্রবারই এর তদন্তের ভার তুলে নেয় লালবাজারের হোমিসাইড শাখা।
এক পুলিশ অফিসারের বক্তব্য, “আত্মহত্যার ধরন এবং উদ্ধার হওয়া সুইসাইড নোট দেখে মনে হচ্ছে, সে এতটাই মনোকষ্টে ভুগছিল, যে করে হোক মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। নিজে থেকে প্লাস্টিক জড়িয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টিও খুবই বিরল।”
ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে পেনসিল কাটার শার্পনারের ব্লেড। তা দিয়ে শিরা কাটা হয়েছে। হাতের আঘাত দেখে তদন্তকারীরা মনে করছেন, সে ঠিক ভাবে শিরা কাটতে পারেননি। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই যে কৃত্তিকা এই কাজ করেছে, তা স্পষ্ট। কারণ, ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের শিরা কাটা হয়েছে। যদি তা সফল না হয়, এ বিষয়ে হয়তো নিজেই সন্দিহান ছিল কৃত্তিকা। সে জন্যেই হয়তো প্লাস্টিক নিয়ে শৌচালয়ে ঢুকে ছিল! শৌচালয় থেকে কৃত্তিকাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তার মুখ প্লাস্টিকে মোড়া ছিল। কৃত্তিকা ছাড়া তাতে অন্য কারও হাতের চিন্থ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে ওই প্লাস্টিক ইতিমধ্যেই ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্যে পাঠানো হয়েছে। শৌচালয় থেকে নমুনাও সংগ্রহ করেছে ফরেন্সিক বিভাগ।
সুইসাইড নোটে কাউকে দোষারোপ করা হয়নি। কৃত্তিকা লিখেছে, ‘আমাকে আর ঝাঁকিয়ে লাভ নেই, আমি আর উঠব না।’, ‘অক্সিজেন নিতে পারছি না, আমার ভাল লাগছে।’ ‘আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়’। পুলিশ যেন বাবা-মাকে বিরক্ত না করে তা লিখেও, আবার তাদেরই উদ্দেশ্যে লেখা রয়েছে, ‘আমি যখন থাকব না বুঝতে পারবে…’।
পুলিশের অনুমান, সিনেমা-ভিডিয়ো ক্লিপ-ওয়েব সিরিজ জাতীয় কোনও কিছু থেকে এ ভাবে আত্মহত্যার পরিকল্পনাটা মাথায় এসেছিল তার। এমনটাও হতে পারে, আত্মহত্যার পরিকল্পনা করতে সে নিজে এ ধরণের মুভি, ভিডিয়ো বা লেখাপত্র সার্চ করে দেখেছে। কৃত্তিকার ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কেন আত্মহত্যা করল কৃত্তিকা? লেখাপড়ায় দুর্দান্ত। ক্যারাটে শিখত। আত্মবিশ্বাসী ছিল সব বিষয়ে। ক্লাস টুয়েলভ পাশ করার পর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট বা আইএসআই-তে পড়ার পরিকল্পনা ছিল। তার প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই সে শুরু করে দিয়েছিল। পুলিশ এবং মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, হঠাৎ করে কিছু ঘটেনি। এত কিছুর পরও, একটি ছেলে বা মেয়ের মনের ভিতরে এমন কিছু ঘটতেই পারে যা তাকে জীবন সম্পর্কে হতাশ করে ফেলে। কৃত্তিকার চিঠি পড়ে তদন্তকারীদের মত, দীর্ঘ সময় ধরেই তার মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বা হতাশা দানা বাঁধছিল। প্রবল মানসিক চাপ তার উপর কাজ করছিল।