প্রতিবারই তো দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর খুশীর ঈদ পালন করি। আসুন না এই ঈদে আর এক মুঠো বেশী কিছু করি। আসুন না আর একটু সহিষ্ণুতা পালন করি। মাথা গরম না করে আসুন যারা কথায় কথায় ‘দেশদ্রোহী ‘, ‘পাকিস্তানী ‘ বলে দেয়, তাদের দিকে করুণার চোখে তাকাই। মুচকি হেসে আসুন ওদের ঘরে ডেকে শির খুর্মা খাওয়াই।
এ কথায় সে কথায় সীমান্ত গান্ধী, মৌলানা আজাদ, আশফাকুল্লা খান, জাকির হুসেন, মুজাফফর অহমেদের গল্প জুরে দিই। বিরিয়ানি খেতে খেতে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এদের অবদান নিয়ে গর্ব করি। এদের মতো আরো লাখো মুসলমানের কথা বলি যারা এ দেশকে ভালোবেসে থেকে গেছিলো এ পারে। এসবের মাঝে দুম করে আবার ওদের পাল্টা প্রশ্ন করে বসবেন না স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের অবদান নিয়ে। জোর বিষম খেতে পারে। মেহেমান নৌওয়াজিতে কমতি যেন না থাকে।
আসুন না এই ঈদে শপথ করি সরকারের অনুদান বা তোষণের ওপর ভরসা না করে অন্তত দুজন মানুষের শিক্ষার দায়িত্ব নেবো। তাদের মোল্লার ফতোয়া না ইসলামে উল্লেখিত বিজ্ঞান নিয়ে গল্প বলবো। ইসলামী সভ্যতার আবিষ্কার এলকেমি, ত্রিগোনোমিট্রি, চিকিৎসাশাস্ত্র, ব্যবচ্ছেদ নিয়ে বোঝাবো। সাথে সাথে যুক্তিবাদ, সাহিত্য, ইতিহাস পড়াবো আসুন। এই পৃথিবীতে রোজ আলোর চেয়ে ও দ্রুত গতিতে পরিবর্তন হচ্ছে যা কিছুর তার সম্বন্ধে বলবো। প্রশ্ন করতে শেখাবো কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। এই ঈদে আসুন নতুন আলো আনি যাতে কোন শয়তান ইবলিস অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে কচি কচি ছেলেদের মগজধোলাই না করতে পারে। কোন রাজনৈতিক দল ফেজটুপি পরে ইনসাল্লাহ বলছে বলেই ভোট না দিয়ে ফেলি। আসুন শপথ করি আল্লার দোহাই দিয়ে কেউ যেন হাতে চাপাতি বা কালাশনিকভ ধরিয়ে না দিতে পারে আপনার সন্তানের।
এবার ঈদে হাসি ফুটুক সমস্ত গরীব দুঃখী মানুষের মুখে। হোক না তারা ফেজ টুপি বা পৈতেধারী। এই ঈদে এক থালা গরম ভাত তুলি দিই ওদের মুখে। দৃষ্টান্ত স্থাপন করি আসুন। চোখ ধাঁধানো প্যান্ডেল, লক্ষ টাকার আতসবাজি, পাথরের মূর্তিকে যারা সোনার গয়না বা নব্বই ভোগ খাওয়ায়, তারাও দেখবেন এগিয়ে আসছে। ভালো কাজে ভালো মানুষ ধর্ম নির্বিশেষে পাশে থাকে। আল্লা ও দেখবেন আনন্দ পেয়েছে তার কিচ্ছুটি না পাওয়া বান্দাদের থালায় ভাত দেখে, মাথায় ছাদ দেখে, মুখে হাসি দেখে। সুভানাল্লা।
এই ঈদে আসুন নিজের চৌহুদ্দি, পট্টি, বেল্ট, এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে আসি একবাটি ফিরনী বা সেমাই বা নারকেল বরফি হাতে। পাশের বাড়ির মুখার্জীদা যে সকালে গায়েত্রী মন্ত্র জপ করে আর ইদানীং পতাঞ্জলী ব্যবহার করে বা ঘোষ কাকিমা যে মুসলমান মানেই ভাবে রোজ বাড়িতে কিলো কিলো গরু খায়, তাদের ঈদের মিষ্টি দিয়ে আসি। আর হ্যা, ফিসফিস করে বলে আসি যে ওতে গরু নেই। গরু ন’ মাসে ছ’ মাসে হয়, বাকিদিন আর পাঁচটা বাঙালি বাড়ির মতোই মাছ, মুরগি, এঁচোড়, পুঁইশাক খাই। ইতস্তত মুখগুলোকে ভরসা জোগান। শান্তিতে চেটেপুটে খাক ওরাও। একসাথে খাই আমরা সবাই। এক পাতে খাওয়ার জোর অনেক।
এই ঈদ প্রতিজ্ঞার ও ঈদ হোক। ইবন বাতুতা, ওমর খৈয়াম, মহম্মদ রুমি, মির্জা গালীব, আমীর খুসরুর ধর্ম যে ভালোবাসার ধর্ম তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক। ইতিহাস একজন এপিজে আব্দুল কালাম, একজন এ.আর. রহমানকে মনে রাখুক। একজন বিন লাদেন, হাফিজ সৈয়দ, ডাউদ ইব্রাহিমকে না। যতবার কেউ হিংসা ছড়াতে যাবে, আল্লার দোহাই দিয়ে মানুষ খুনের কথা বলতে যাবে, কলম ছেড়ে কালাশনিকভ তুলে নেওয়ার কথা বলবে কয়ামতের আগে- তাদের বিচ্ছিন্ন করুন।
যেই ওরা কাফের মারাই ধর্ম বাতলাতে আসবে আসুন লালনের গান শোনাই ওদের। গঙ্গা, যমুনা, মেঘনা,পদ্মা দিয়ে প্রবাহিতা সভ্যতার গল্প বলি। মানুষই গল্প বলে যাবে। আয়াত বা মন্ত্রোচ্চারণ করবে। সকাল হলে আজান বা শঙ্খধ্বনি হবে। মসজিদ থেকে জল হাতে রামনবমীর মিছিলে বিতরণ হবে। মন্দিরের দরজা খুলে যাবে রোজেদারদের ইফতারির জন্য।
মানুষই ধর্ম ধারণ করতে পারে। মানুষই জাপটে ধরতে পারে অন্যকে। চুম্বন এঁকে দিতে পারে ঠোঁটে, চোখের জল মুছিয়ে দিতে, কপালে চুমু দিতে পারে। এই ঈদে ময়ূখকেও বুলানা জরুর। আর হ্যা…..
আলহামদুলিল্লাহ মানবতা মুবারক হো!
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত