প্রত্যেকটা মানুষেরই কিছু না কিছুনা দক্ষতা থাকে, থাকে শখ, থাকে প্যাশন। যদি তার নাম সিরিয়াল কিলিং হয় তবে অবশ্যই তা ভাল শোনাবেনা। হয়তো আপনার আশেপাশেই এমন কেউ লুকিয়ে আছে জানেন না। হয়তো পরমূহুর্তেই আপনিই হতে পারেন টার্গেট। এমনই ভয়ংকর আশংকা নিয়ে ১৮৮৮ সালে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল ডিসট্রিক্টের লোকজনকে চলাফেরা করতে হত। যার কারিগর ছিল জ্যাক দ্যা রিপার। যাকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় সিরিয়াল কিলার, যাকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা যায় নি। এতদিন পরে বাংলার মাটিতে ফিরে এল সেই ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলার। বর্ধমানে ৬ মাসে ৬ মহিলাকে খুন করে ধৃত হলেন বাংলার সিরিয়াল কিলার।
২৭ জানুয়ারি কালনার আনুখাল গ্রামে রহস্যজনক ভাবে খুন হয়েছিলেন পুষ্পা দাস নামে এক মাঝবয়সি মহিলা। ২১ মে কালনার গোয়ারাতে খুন হন আরও এক মহিলা, একই ভাবে। ফের মে মাসেরই ২৭ তারিখে মন্তেশ্বরের বাঘাসনে খুন হন অঞ্জনা রায়। এরই মাঝে আবার মেমারির সাতগাছিয়ায় একই দিনে খুন করা হয় দুই মহিলাকে। হুগলির বলাগড়েও খুন হয়ে যান আরও এক মহিলা।
আপাত দৃষ্টিতে এই খুনগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও, একটা জায়গায় এসে মিলে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। কারণ প্রতিটা ক্ষেত্রেই খুনের কায়দা অবিকল এক, এবং তা খুব একটা প্রচলিত নয়। প্রতিটা ক্ষেত্রেই পুলিশ দেখে, মৃত মহিলাদের গলায় বিশেষ রকমের চেনের প্যাঁচের চাপে ক্ষত তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ শ্বাসরোধ করে খুন করতে গিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে কোনও ধাতব চেন।
ফরেন্সিক তদন্তে পরিষ্কার হয়, মৃতদের গলার ক্ষতর যে প্যাটার্ন, তা একই। এবং তা তৈরি হয়েছে সাইকেলের একটি নির্দিষ্ট চেনে। অর্থাৎ সাইকেলের চেন পেঁচিয়েই মারা হয়েছে তাঁদের। এবং আরও কাকতালীয় ভাবে, প্রতিটা ক্ষেত্রেই খুন হয়েছেন কোনও না কোনও মহিলা। এবং ঘটনার সময়ে তাঁরা প্রত্যেকেই ঘরে একা ছিলেন। কারও কারও গলার প্যাঁচের পাশাপাশি মাথায় ভারী লোহার রডের আঘাতেরও চিহ্ন মেলে।
কিন্তু এতকিছুর পরেও পরেও হদিশ মিলছিল না আততায়ীর। জেলা পুলিশের রক্তচাপ বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের আতঙ্ক, রাজনৈতিক দলগুলির আসরে নামা বাড়ছিল। রবিবার বিকেলে অবশ্য সিসিটিভির ফুটেজে দেখা ছবি মিলিয়ে ওই আততায়ীকে ধরে ফেললেন এক সিভিক পুলিশ।
শনিবারই কালনার পুরশ্রী মঞ্চে পুলিশের তরফে বৈঠক করা হয়। প্রতিটি পঞ্চায়েতের ১০ জন করে সিভিক ও ভিলেজ পুলিশদের ডাকা হয় সেখানে। প্রোজেক্টারের মাধ্যমে সিসিটিভি থেকে পাওয়া বেশ কিছু তথ্য পুলিশকর্মীদের সামনে রাখা হয়। দুষ্কৃতীর বাইকের রং, পোশাক, জুতো, হেলমেটের রং, সঙ্গে থাকা ব্যাগের ছবি দেখানো হয়। এ দিন দুপুরে সাধপুকুর থেকে মেদগাছি যাওয়ার রাস্তায় নাকা তল্লাশি চালাচ্ছিলেন সিভিক পুলিশ অনির্বাণ। আড়াইটে নাগাদ একটি লাল মোটরবাইক দেখতে পান তিনি। পুলিশ কর্তাদের ফোনে জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই বলা হয়, বাইক আরোহীকে বুলবুলিতলা পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যেতে। ফোন শেষ হতেই আরও এক জন এসে নিজেকে ওই বাইক আরোহীর আত্মীয় দাবি করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তাদের অনুমতি নিয়ে নাম, নম্বর জেনে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় বাইকটি। তার পরেও ওই লাল বাইকটি পাশে রেখে আরোহী ও তাঁর আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন অনির্বাণ।
তাঁর দাবি, ৩টে নাগাদ ওই রাস্তায় আরও একটি বাইক আসতে দেখেন তিনি। তাঁর দাবি, সিভিক পুলিশ দেখেই গতি বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ওই ব্যক্তি। দ্রুত গতিতে যেতে গিয়ে গ্রামের এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় বেসামাল হয়ে দুষ্কৃতী সোজা ধাক্কা মারে দাঁড় করানো বাইকটিতে। মুহূর্তে নেমে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি দৌড়ে এসে বাইকের হাতল ধরে চাবি কেড়ে নেন বলে দাবি অনির্বাণের। সাহায্যে এগিয়ে আসেন আশপাশের বাসিন্দারাও। হাতেনাতে ধরে ভাল করে দেখতেই দেখা যায়, সিসিটিভি-র ছবির সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই বুলবুলি তলা ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় ওই যুবককে।
ওই আততায়ীর নাম কামরুজ্জামান সরকার। কালনার সুজনপুর গ্রামের বাসিন্দা, ‘ভাল মানুষ’ বলে এলাকায় পরিচিত কামরুজ্জামান যে এমন কাণ্ড করতে পারে, তা যেন অবিশ্বাস্য সকলের কাছে! স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দেড় বছর আগে মুর্শিদাবাদ জেলার কালিনগর এলাকা ছেড়ে সপরিবার বর্ধমানে চলে আসে কামরুজ্জামান। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কালনার সুজনপুর গ্রামে বসবাস শুরু করে। গ্রামে রীতিমতো শান্তশিষ্ট মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিল সে। প্রতিদিন সকালে সেজেগুজে মোটরবাইক নিয়ে কাজেও বেরোত। তবে সে কী কাজ করত, তা অবশ্য কেউ টের পেত না।