ইতিহাসের সূক্ষ্ম মোড়গুলোতে অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে চিরকাল বাংলা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সমাজে জগদ্দল পাথরের মত রীতি,নীতি,নিয়ম যখনই সমাজের অগ্রগতির বৈরী হয়ে উঠেছে বাংলা থেকে আওয়াজ উঠেছে, পরিবর্তন এসেছে, বাংলা ভারতকে পথ দেখিয়েছে। সেই বাংলার নবজাগরণের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যখন মধ্যযুগীয় নিয়ম কানুনে ভারতের হিন্দু সমাজ কুসংস্কারাচ্ছন্ন , বিদ্যাসাগর প্রদীপের আলোর মতন সকল অন্ধকার কাটিয়ে আমাদের অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
যদি কোনো বই সকল বাঙালি পড়ে থাকে তা হবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা বর্ণপরিচয় যা পড়ে আমরা বাংলা মাকে লিপিবদ্ধ করতে শিখেছি। আর সেই ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ওপর কোনো বাঙালি সজ্ঞানে হাত ওঠাতে পারে কি? আমি মনে করিনা পারে। কোনো বাংলা মায়ের সন্তান এ কাজ করতে পারে না। কিন্তু কলকাতা দেখলো এক দল দাঙ্গাবাজ রাতের অন্ধকারে কিভাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্থাপন করা কলেজে তাঁর মূর্তি ধ্বংস করলো। কিন্তু কেন ?
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে কি এমন আছে যাকে বাংলার শত্রুরা ভয়ে পায়? আছে, অনেক কিছু আছে। সেই মূর্তিতে লুকিয়ে আছে বাঙালির জাতিসত্তাবোধ, ধর্মের গোঁড়ামি উপড়ে ফেলে যুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার রসদ, সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলতারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কুসংস্কারকে ধ্বংস করে এক উন্নততর সমাজ তৈরি করার প্রতিজ্ঞা যাকে ওরা ভয়ে পায়। ভয় পায় ওরা বিদ্যাসাগর মনস্কতাকে, ভয় পায় ওরা বিদ্যাসাগরের দুঃসাহসকে।
এই বছর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি-শততম জন্মবার্ষিকী। আজ দুশো বছর পেরিয়েও আমাদের সমাজ সেই প্রতিক্রিয়াশীলতার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে যার বিরুদ্ধে চিরকাল লড়াই করে গেছেন বিদ্যাসাগর। আজ ভোট চাওয়া হচ্ছে বাল্য বিবাহের নামে, নারী অধিকারে যারা বিশ্বাসী নন তাদেরকে সিংহাসনে বসানো হচ্ছে। প্রশ্ন করা হচ্ছে বিদ্যাসাগর কি এমন সামাজিক পরিবর্তন এনেছে? আসলে তো উনি হিন্দু সমাজের ক্ষতি করেছে? এর থেকেই প্রশ্ন ওঠে এই “হিন্দু সমাজ” কোন হিন্দু সমাজ? এই হিন্দু সমাজ কি বাংলার হিন্দু সমাজ? যাকে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়ের মতো নক্ষত্ররা তিলে তিলে তৈরি করেছেন নাকি এটা সেই “হিন্দু সমাজ” যেখান থেকে ভারতী ঘোষ হাজার ছেলে এনে বাঙালিকে কুকুরের মতো মারার হুমকি দিয়েছে?
সেই হাজার ছেলের পল্টনের তাণ্ডব দেখলো বাংলা। দেখলো বাংলা শত্রুর নগ্ন রূপ। সে তার ভয়ঙ্কর রূপ আর মুখোশ দিয়ে ঢেকে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। যেন তেন প্রকারে আজ তার বাংলাকে চাই। তার জন্য যদি বাংলা ধ্বংস হয়ে যায়, যাক। বাঙালির জাতিসত্তাবোধ ধ্বংস হয়ে যায় আরও ভালো। বাংলার ভাষা, বাংলার খাদ্য, বাংলার ধর্ম, বাংলার চিন্তা এই সব কিছুর ধ্বংসই তার আজ লক্ষ্য। বাংলার শত্রুদের আজ যে কোনো মূল্যে বাংলা দখল নিতে হবে। তাই তো আজ বিদ্যাসাগরের মূর্তির ওপর হাত ওঠে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মূর্তির ওপর হাত ওঠে, স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তির ওপর হাত ওঠে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তির ওপর হাত ওঠে, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের মূর্তির ওপর হাত ওঠে। কিন্তু বাংলার শত্রুরা বাঙালিকে চেনে না। এই জাতি হলো বারো ভূঁইয়ার জাতি, মাস্টার দা সূর্য সেনের জাতি, বাঘা যতীনের জাতি, যতীন দাশের জাতি, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের জাতি। বাংলা মায়ের গায়ে হাত পড়লে প্রতি ঘর থেকে মাস্টার দা বেরোবে, বাঘা যতীন বেরোবে, নেতাজি সুভাষ বেরোবে।
আজ বাঙালির কাছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, বাঙালি জাতিসত্তাবোধ রক্ষা করার লড়াই, বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার লড়াই, আত্মমর্যাদা রক্ষা করার লড়াই। আজ বাংলার শত্রুদের একটু বাঙালি জাতির ইতিহাসটা মনে করিয়ে দেওয়ার সময়ে এসছে। এই জাতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সূর্যাস্ত ঘটিয়েছে, এই জাতি উর্দু সাম্রাজ্যবাদকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। ইতিহাস সাক্ষী, বাঙালি যখনই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে পরিবর্তন এসছে, সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। আজ একটা মূর্তি ভেঙেছে, কিন্তু সহস্র বাঙালির হৃদয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে বিদ্যাসাগরের আলো। এই আলোই আগামী দিনে বাংলাকে রাতের আঁধার ঠেলে নতুন নবজাগরণের ভোরের দিকে নিয়ে যাবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা।
–মতামত লেখক এর ব্যাক্তিগত