পোস্টার,ফ্লেক্স, দেওয়াল লিখন, ব্যানারে ভোট যুদ্ধের আমেজ। আর সেখানে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে তৃণমূলের নতুন লোগো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এক নতুন যুগের সূচনা য়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তৃণমূলের নতুন লোগো সেই যুগেরই দিকনির্দেশ করছে।
নতুন লোগোয় নয়া বার্তা দিয়েছেন মমতা। খসে গেছে ‘কংগ্রেস’ শব্দটি। নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লোগোতে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার সবচেয়ে মজবুত প্রতিনিধি হিসেবে তৃণমূলকে তুলে ধরেছেন মমতা।
নতুন লোগোয় রয়েছে আরও কিছু বার্তা। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন যে কংগ্রেসকে আজ দেশ দেখছে, তার থেকে যে তিনি নিজের রাজনীতিকে ক্রমাগত অনেক দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন, তা বোঝাতে তেরঙা ব্যাকড্রপ সরে গিয়েছে। নীল-সাদার উজ্জ্বল উপস্থিতিকে তৃণমূলের নিজস্ব রং হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। আর বেড়েছে সবুজের উপস্থিতি। জোড়াফুল প্রতীকটার নীচে লোগোর যে অংশ, সেটা পুরোটাই সবুজ। শুধু প্রতীকের নীচের বাঁ দিকের কোনায় ছোট্ট এককুচি গেরুয়া। স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, গেরুয়া রঙের দাপট বাংলার রাজনীতিতে অচল। বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, গেরুয়া দল বাংলার দল নয়, বাংলার প্রতিনিধিত্ব করবে নীল-সাদা-সবুজের তৃণমূলই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই একমাত্র নেত্রী যিনি নিজের রাজ্যে কংগ্রেসি রাজনীতির প্রধান উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন অত্যন্ত উজ্জ্বল ভাবে। পাঁচ-সাত বছর নয়, টানা ২১ বছর ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে বাংলায় তিনি কংগ্রেসকে বহু পিছনে ফেলে দিতে পেরেছেন। ২০১১ সালে তাঁর দেওয়া শর্তে কংগ্রেসকে জোট গড়তে বাধ্য করেন মমতা এবং ৩৪ বছরের বাম শাসন শেষ করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রিত্বে আসীন হওয়ার পর থেকে কিন্তু অনুচ্চারিত ভাবে নতুন যুগের সূচনা হয়ে গিয়েছে তৃণমূলে। বামপন্থী ঘরানার লোকজনকেও অক্লেশে তৃণমূলে ঠাঁই দিতে শুরু করেছেন মমতা। কখনও স্লোগানে, কখনও সরকারি নীতিতে, কখনও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বাংলার জন্য বিশেষ কিছু আদায়ের তাগিদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান বার বার মিলে যেতে শুরু করেছে বামেদের সঙ্গে। ফলে বামপন্থী হিসেবে পরিচিত বাঙালি বিদ্বজ্জনদের একটা বড় অংশকেই পাশে টানতে সক্ষম হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত আট বছরে সেই বৃত্ত প্রায় সম্পূর্ণ করে বাংলার সব শ্রেণির আশা-আকাঙ্খার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে তৃণমূল।
নতুন লোগোর নেপথ্যে সম্ভবত ক্রিয়াশীল ছিল সেই চেষ্টাও। ‘আমার, আপনার, বাংলার’-এই স্লোগানেই কিন্তু নিহিত গোটা বাংলার প্রতিনিধি হিসেবে তৃণমূলকে তুলে ধরার প্রয়াস। বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্খা নিয়ে একমাত্র তৃণমূলই ভাবে, বাংলার সব শ্রেণির নাগরিকদের আশা-আকাঙ্খা পূরণের সক্ষমতা একমাত্র তৃণমূলেরই রয়েছে— এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা তো রয়েইছে। বাংলার জন্য বিজেপি-কে প্রয়োজন নেই, বাঙালি সমাজের অন্তর্লীন চেতনার সঙ্গে বিজেপির ভাবধারা মেলে না, বিজেপি আসলে এ রাজ্যে বহিরাগত এবং মূলত মোদী-শাহের মতো বহিরাগতদের ভরসাতেই বিজেপি বাংলায় নিজের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে— সুকৌশলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এই বার্তাও। বলছেন বিশ্লেষকরা।
মার্চের প্রথম সপ্তাহেই নতুন লোগোটা প্রকাশ করে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সোশ্যাল মিডিয়া পেজের ডিসপ্লে পিকচারে জ্বলজ্বল করে ওঠে নতুন লোগো। একে একে তৃণমূলের সব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নতুন রঙে রেঙে উঠতে শুরু করে। সব শেষে প্রার্থীতালিকা প্রকাশের দিন কালীঘাটের তৃণমূল দফতরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়ারের পিছনের দেওয়ালে বড় করে দেখা দেয় নতুন লোগো, নতুন রং, নতুন স্লোগান।