আবারও চরমে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত। এ বার বিতর্কের কেন্দ্রে জলপাইগুড়ির সার্কিট বেঞ্চ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ, শুক্রবার জলপাইগুড়িতে এসে সার্কিট বেঞ্চ উদ্বোধন করবেন, এই সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার শেষ মুহূর্তে রাজ্যকে জানানো হয়েছে। রাজ্য সরকারকে কিছুই না-জানিয়ে এমন আচমকা সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক’ বলে মনে করছে নবান্ন। আর তাতেই বেধেছে সংঘাত।
রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে প্রধানমন্ত্রীর এহেন কর্মপন্থায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। যে সার্কিট বেঞ্চের জন্য ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে যাবতীয় পরিকাঠামো তৈরি করেছে রাজ্য, তার উদ্বোধনে রাজ্যকে বাইরে রাখার এই প্রচেষ্টায় স্বরাষ্ট্রসচিব অত্রি ভট্টাচার্য বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রতিবাদের চিঠি পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রককে। পাশাপাশি গোটা বিষয়টাকে বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা আখ্যা দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। তাঁর কটাক্ষ, এক কান কাটা ব্যক্তি লজ্জায় রাস্তায় বের হন না। কাল যদি প্রধানমন্ত্রী সার্কিট বেঞ্চ উদ্বোধন করেন, ধরে নিতে হবে তাঁর দু’কানই কাটা।
প্রসঙ্গত, সার্কিট বেঞ্চের যাবতীয় পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে, এই নিশ্চয়তা দিয়ে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর রাজ্যের তৎকালীন আইন-বিচার সচিব বিবেক চৌধুরী আইন মন্ত্রকে চিঠি লিখে উদ্বোধনের জন্য কেন্দ্রের সম্মতির আর্জি জানিয়েছিলেন। চিঠিতে জানানো হয়েছিল, সম্মতি মিললে আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধন করা হবে।
রাজ্যের আইনমন্ত্রীর অভিযোগ, ওই চিঠি দেওয়ার পর পাঁচ মাস কেটে গেলেও, কোনও সাড়াশব্দ মেলেনি কেন্দ্রের তরফে। মেলেনি কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের সম্মতিও। অথচ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বুধবার রাতে তড়িঘড়ি জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চ চালু করার বিষয়টিতে ছাড়পত্র দেয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। ময়নাগুড়িতে প্রধানমন্ত্রীর দলীয় জনসভার ৪৮ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সার্কিট বেঞ্চকে অনুমোদন দিয়েই থামেনি, শুক্রবার ময়নাগুড়ির জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী সেই সার্কিট বেঞ্চ উদ্বোধন করবেন বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। সার্কিট বেঞ্চকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে বিজেপি।
গতকাল বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিউটাউনের কনভেনশন সেন্টারে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অনুষ্ঠান চলাকালীনই খবর আসে, যে সার্কিট বেঞ্চ নিয়ে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে পরিকাঠামো তৈরি করেছে রাজ্য, ময়নাগুড়িতে বিজেপি’র জনসভায় এসে তার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। খবর পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন মমতা। তাঁর নির্দেশেই রাজ্যের প্রতিবাদ লিখিত আকারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দিল্লীতে। এবং সার্কিট বেঞ্চ গঠনে রাজ্যের ভূমিকা ও অবস্থান সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতে জরুরি সাংবাদিক সম্মেলন করেন আইনমন্ত্রী।
মহাকরণে সাংবাদিক সম্মেলনে দু’টি চিঠি দেখিয়ে আইনমন্ত্রী দাবি করেন, গত বছরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা হাইকোর্ট সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধনের সম্মতি চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল আইন মন্ত্রকে। এরপর গত ৩১ আগস্ট আইন মন্ত্রকের তরফে এ এন সাক্সেনা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল শুভাশিস দাশগুপ্তকে চিঠি দিয়ে জানান, পরিকাঠামোগত নানা সমস্যা এবং রাষ্ট্রপতির নোটিফিকেশন না থাকার কারণে এখন উদ্বোধন করা যাবে না। এরপর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় রাজ্যের আইন-বিচার সচিব কেন্দ্রকে জানান, ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিকাঠামো তৈরি করেছে রাজ্য। বিচারপতিদের বাংলো এবং স্টাফ কোয়ার্টারও তৈরি। লাইব্রেরি এবং সুসংহত নেট পরিষেবাও চালু করা হয়েছে। উদ্বোধনের অনুমতি দেওয়া হোক। তারপর থেকেই চুপচাপ কেন্দ্র।
এদিকে, দিল্লী থেকে প্রধানমন্ত্রীর যে সফরসূচি রাজ্যে এসে পৌঁছেছে, সেই অনুযায়ী, ময়নাগুড়ির সভাস্থলে আজ, শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী আসবেন বিকেল সাড়ে ৩টের সময়। এরপর ময়নাগুড়ির সভাস্থলে তৈরি একটি মঞ্চ থেকে বোতাম টিপে সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তবে নবান্নের কর্তারা জানাচ্ছেন, ‘আইন ও বিচার’ সংবিধানের কেন্দ্র, রাজ্য এবং উভয় তালিকাভুক্ত। কোথাও হাইকোর্ট বা সার্কিট বেঞ্চ তৈরি হলে সেখানে বিচারপতি নিয়োগ কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত। আবার সেই আদালতের কর্মী নিয়োগ রাজ্যের এক্তিয়ার। আদালতের পরিকাঠামো নির্মাণ, জমি, অর্থ দেওয়ার কাজ কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই করে।
রাজ্যের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করে যেতেই পারেন। কিন্তু পরের দিন থেকে তো আদালতের কাজ শুরু হবে না! মলয়বাবুর হুঁশিয়ারি, ‘সাধারণ কর্মী, গাড়ি চালক— এই সব নিয়োগই রাজ্যকে করতে হয়। ফলে গায়ের জোরে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করে দিলেও, বেঞ্চ কাজ শুরু করতে পারবে না।’ তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ, ‘সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধনের বিষয়ে রাজ্য সম্পূর্ণ অন্ধকারে। রাজ্য সরকারকে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। এটা বেআইনি। রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক।’