‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লভে’। গোটা দেশকে সেই পথই দেখাল বাংলা। আর যার কাণ্ডারি স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গতকাল, বাংলার পুজো কার্নিভাল যেন ধারে-ভারে প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক। আর আগত বিদেশিরা শুধু দর্শকাসন থেকে দেখলেনই না, অংশও নিলেন সেই বর্ণময় শোভাযাত্রায়। দু’বছর আগে শুরু হওয়া কার্নিভাল ক্রমে শুধু যে কলেবরে, পুজোর সংখ্যায় বেড়েছে তাই নয়, তা আরও জমকালো, আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে এ বছর।
সেই সাফল্যের মুকুটেই এবার নতুন পালক যুক্ত হল বিদেশিদের অংশগ্রহণে। মুখ্যমন্ত্রী মমতার লেখা সুরুচি সঙ্ঘের থিমসঙ ‘জয় মা, জয় দুর্গা’ গাইলেন ইন্দ্রনীল সেন, লোপামুদ্রা মিত্র। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচলেন ইসকনের বিদেশিনীরা। বাংলা প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠল বিশ্ব বাংলা।
আগের দু’বারের কার্নিভালের চেয়ে সংখ্যায় বেড়েছে পুজো কমিটির অংশগ্রহণ। গতকালের বর্ণময় কার্নিভালে অংশ নিয়েছিল ৭৪টি পুজো কমিটি। একে একে ৭৪টি পুজো কমিটিই উৎসবের আলোয় শোভাযাত্রা করে ফোর্ট উইলিয়ামের প্রধান ফটকের সামনে থেকে রেড রোডের কার্নিভাল সরণিতে এগিয়ে এল। মুখ্যমন্ত্রী ও কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে লাইভ দেখানো হল গোটা অনুষ্ঠানটাই।
পড়ন্ত বিকেলে রাজবাড়ির বারান্দার আদলে নির্মিত মূল মঞ্চে এলেন মুখ্যমন্ত্রী। হাজির ছিলেন বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, সাংসদ সুব্রত বক্সি, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ বিধানসভা ও লোকসভার অন্যান্য সদস্যরাও। ছিলেন কবি জয় গোস্বামী, শুভাপ্রসন্ন, যোগেন চৌধুরি, প্রসেনজিৎ, হৈমন্তী শুক্লা, সন্দীপ রায়, রঞ্জিত মল্লিক, গৌতম ঘোষ প্রমুখ। পাশাপাশি, দেশ–বিদেশের আমন্ত্রিত অতিথি, ইংল্যান্ড থেকে আগত বিশেষ প্রতিনিধিদলের সদস্যরাও এসেছিলেন।
পূর্ব ঘোষণামতোই ঠিক বিকেল সাড়ে ৪টেয় শুরু হয়ে গেল কার্নিভাল। শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের শোভাযাত্রায় রাজস্থানি ‘ঘুমর’ নাচ, পদ্মাবতের গান আর অভিজিতের ঢাকের বাজনায় সুর বাঁধা হয়ে গেল কার্নিভালের।
রেড রোডের দু’পাশে বসে, দাঁড়িয়ে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। আরও অনেকে কার্নিভাল প্রাঙ্গণে পৌঁছতে না পেরে দর্শকাসনের পেছনে পাঁচিলে উঠে উঁকি দিয়ে উৎসবের স্বাদ উপভোগে মগ্ন। পুজোর শেষে ঠাকুর দেখতে সকাল থেকেই মানুষের ঢল নেমেছিল। উৎসবের স্বাদ উপভোগ করতে তাই সকাল থেকেই রেড রোডমুখী হাজার হাজার মানুষ।
শ্রীভূমির পর উৎসব সরণিতে শোভাযাত্রা নিয়ে হাজির হয় একডালিয়া এভারগ্রিন। দমদম পার্ক ভারত চক্র তুলে ধরল মহিলাদের প্রগতির চিত্র। আগত বিদেশি দর্শকরা মন ভরে দেখলেন বাংলার মহিলাদের প্রগতির ধারা। আবার, প্রতি মেয়ের মধ্যেই থাকেন একজন মা। টালা বারোয়ারির শোভাযাত্রায় ছিল সেই বার্তা।
খানিকক্ষণ পরেই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের নেতৃত্বে কার্নিভাল সরণিতে এলো সুরুচি সঙ্ঘের শোভাযাত্রা। অংশ নিলেন বিদেশিরাও। মুখ্যমন্ত্রীর লেখা সুরুচি সঙ্ঘের থিমসঙ ‘জয় মা, জয় দুর্গা’ তাঁরা নৃত্যানুষ্ঠানে পরিবেশন করলেন। তার একটু পরেই বেহালার শ্রীসঙ্ঘের শোভাযাত্রায় মুখ্যমন্ত্রীর লেখা থিম গান— ‘মা গো তুমি সর্বজনীন’-এর সঙ্গে নাচে পা মেলালেন নৃত্যশিল্পীরা। গলা মেলাতে দেখা গেল খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও। আবার চেতলা অগ্রণী ক্লাবের শোভাযাত্রায় হাঁটলেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও।
নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের শোভাযাত্রায় আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও তাঁর ডান্স ট্রুপের নাচে। ছিলেন গৌতম ঘোষ, অগ্নিমিত্রা পল। নাচের শেষে ঋতুপর্ণা মেয়েকে নিয়ে মঞ্চে উঠে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রণাম করেন। কালীঘাট মিলন সঙ্ঘের শোভাযাত্রায় উঠে এল ম্যাজিক খেলা, ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ বিশ্বচেতনার প্রকাশ।
শুধু কলকাতা বা বাংলারই নয়, টিভি আর ইন্টারনেটের দৌলতে রাত পর্যন্ত পুজোর বিশেষ বর্ণময় শোভাযাত্রা দেখলেন দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ। বাংলার কৃষ্টি, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতির হাত ধরে চলমান সময়ে উন্নয়নের যে আলোয় আলোকিত বাংলা, তারই প্রতিফলন হল মঙ্গলবার রেড রোডের অভূতপূর্ব আনন্দ উৎসবে। শঙ্খধ্বনি, ঢাকের বাদ্য আর লেজার শোয়ে যা আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। সন্ধে হতেই চন্দননগরের আলোয় মায়াবী হয়ে উঠল কার্নিভাল সরণি।