একেই বলে শারদীয়ার পরেও ‘অন্য শারদীয়া’। বাঙালির তেরো পার্বণের সেরা পার্বণ যেন শেষ হয়েও শেষ হয়নি এখনও। একদিকে দেশবিদেশের অতিথিদের উপস্থিতি। অন্যদিকে সাধারণ দর্শক। তাঁদের সামনে কলকাতা শহরের সমস্ত পুরস্কারজয়ী পুজোর শোভাযাত্রা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের সমাপ্তি এর চেয়ে ভালভাবে বোধহয় আর হতে পারে না।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত দুর্গা কার্নিভালের এটি তৃতীয় বছর। ২০১৬ সাল থেকে রেড রোডে দুর্গাপুজো কার্নিভাল শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। যা কম আকর্ষণীয় নয়। ক্রমেই বেড়েছে এর পরিসর এবং বর্ণময়তা। শুধু বর্ণাঢ্য বললে কম বলা হয়, এই অনুষ্ঠান যেন এক দিগন্তের দিকে সুদীর্ঘ যাত্রা। যে দিগন্তযাত্রায় উঠে আসে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সম্প্রীতির বিভিন্ন রং। সব রং মিশে তৈরি হয় এক আলোকিত বর্ণমালা।
আজ, মঙ্গলবার সেই শোভাযাত্রা উপলক্ষেই সব পথ মিলে যাবে রেড রোডে। এক জায়গায় বসে সেরা পুজোগুলি দেখে নেওয়ার তীর্থক্ষেত্রে। বিকেল সাড়ে ৪টেয় শুরু কার্নিভাল। চলবে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। কিন্তু শুরুর অনেক আগে থেকেই ভরে যাবে রেড রোডের দর্শকাসন। থাকবেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীও। সোমবারই তিনি টুইট করে সকলকে ওই শোভাযাত্রায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মমতার ফেসবুক পেজেও ‘লাইভ’ দেখা যাবে গোটা অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের সূচনা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও তাঁর ট্রুপের মাতৃবন্দনা দিয়ে। তারপর কার্নিভাল রঙিন হয়ে উঠবে একের পর এক পুজো আয়োজনের প্রদর্শনী, ট্যাবলো, চন্দননগরের আলো, শিল্পসংস্কৃতি, অভিনয় জগতের তারকা আর দেশ–বিদেশের অতিথিদের উপস্থিতিতে। থাকবেন বিশিষ্ট শিল্পদ্যোগীরাও। থাকবেন বিচারপতি, মন্ত্রী, পদস্থ আমলা–সহ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অফিসাররাও।
কার্নিভালে যোগ দিচ্ছে সুরুচি সঙ্ঘ, চেতলা অগ্রণী ক্লাব, বড়িশা ক্লাব, কালীঘাট মিলন সঙ্ঘ, শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব, নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ, ত্রিধারা, অকালবোধন, হিন্দুস্থান পার্ক দুর্গোৎসব কমিটি, সল্টলেক এ কে ব্লক অ্যাসোসিয়েশন, শিবপুর মন্দিরতলা সাধারণ দুর্গোৎসব কমিটি, ৯৫ পল্লী সর্বজনীন দুর্গোৎসব যোধপুর পার্ক। থাকছে টালা পার্ক প্রত্যয়, সল্টলেক এফ ডি ব্লক সর্বজনীন পুজো কমিটি, হরিদেবপুর অজেয় সংহতি, ৪১ পল্লী, ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন মহম্মদ আলি পার্ক, কলেজ স্কোয়ার সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি, হাতিবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি, দমদম পার্ক ভারতচক্র ক্লাব, একডালিয়া এভারগ্রিন, হাওড়ার স্বামীজী স্পোর্টিং ক্লাব–সহ কলকাতা, হাওড়া, বিধাননগর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মোট ৭৪টি পুজো।
প্রতিটি ক্লাবের প্রতিমাই আসবে তাদের স্থানীয় থানার পুলিশের তত্ত্বাবধানে। প্রসঙ্গত, কসবার বোসপুকুর শীতলা মন্দির এবার বিশাল পাথরে খোদাই প্রতিমা করেছে। সেটি কার্নিভালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় তারা ওই মূর্তির ছবির ফ্লেক্স নিয়ে কার্নিভালে অংশ নেবে।
খিদিরপুর রোড দিয়ে ঢুকে জে কে আইল্যান্ড হয়ে রেড রোডে আসবে সব প্রতিমা। ফলে খিদিরপুর রোড থেকে জে কে আইল্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে বহু মানুষ দাঁড়িয়ে প্রতিমা দর্শন করতে পারবেন। আর রেড রোডে দেখতে পারবেন আসনে বসে। রেড রোডের শোভাযাত্রার পর প্রতিমাগুলি নেতাজিমূর্তির সামনে দিয়ে কিংসওয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। যে আয়োজকরা গঙ্গায় নিরঞ্জন করতে চান, তাঁদের প্রতিমা কলকাতা পুলিশের তত্ত্বাবধানে বাবুঘাটে বিসর্জন দেওয়া হবে। যাঁরা নিজেদের এলাকায় বিসর্জন দেবেন, তাঁরা কার্নিভালের পর প্রতিমা নিয়ে ফিরে যাবেন।
প্রতি পুজোর আয়োজক মুখ্যমন্ত্রী ও বিশিষ্ট অতিথিদের সামনে দেড়মিনিট করে মোট ৩ মিনিট সময় পাবেন তাঁদের থিমের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে। যাঁদের থিম সং আছে, তাঁরা সেটি বাজাবেন। সঙ্গে থাকবে থিমভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। যাঁদের থিম সং নেই, তাঁদের প্রতিমার যাত্রাপথে বাজবে ঢাকের বাদ্য। প্রতিটি প্রতিমা রেড রোডে আসার সঙ্গে সঙ্গে ধারাভাষ্যে বলে দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট পুজোটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। বাংলার পাশাপাশি বিদেশি দর্শকদের জন্য ইংরেজিতেও চলবে ধারাভাষ্য।
রেড রোডে মূল মঞ্চ তৈরি হয়েছে রাজবাড়ির বারান্দার আদলে। সেখানে মুখ্যমন্ত্র–সহ বিশিষ্টরা বসবেন। পাশের দু’টি মঞ্চে থাকবেন ভিভিআইপি এবং বিদেশি অতিথিরা। রাজ্যের প্রথমসারির ৭৫ জন শিল্পপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, সঞ্জয় বুধিয়া, হর্ষ নেওটিয়া, সত্যম রায়চৌধুরী প্রমুখ।
কার্নিভাল দেখতে ইংল্যান্ড থেকে এসেছে ২০ জন বিশেষ প্রতিনিধি দল। সম্প্রতি লন্ডনের টেমস উৎসবে বাংলার শারদোৎসবকে তুলে ধরা হয়েছিল। তারপর থেকেই বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে শারোদৎসব দেখার আগ্রহ বেড়েছে। বেশকিছু বিদেশি পর্যটকেরও কার্নিভালে অংশ নেওয়ার কথা। সোমবার তাঁরা বিধাননগরে মহড়াও দিয়েছেন।
শহরের পাঁচতারা হোটেলগুলি থেকে আসবেন আরও ২০০ জন বিদেশি পর্যটক। আইসিসিআর, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, টেকনো ইন্ডিয়া, জেআইএস, আ্যাডামাস, অ্যামিটির মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিদেশি পড়ুয়াদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দেশবিদেশ মিলিয়ে আড়াই হাজার পর্যটক থাকবেন কার্নিভাল প্রাঙ্গণে। তাঁদের মধ্যে দেড়হাজার বিদেশি। নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, চীন ছাড়াও আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির উপদূতাবাস ও কনসুলেটের প্রতিনিধিরা থাকবেন। থাকবেন কনসাল জেনারেলরাও।
কার্নিভালে গত দু’বছর ভিড় উপচে পড়েছিল। এবার উন্মাদনা তুঙ্গে। কার্নিভালে দর্শকদের প্রবেশ অবাধ। দাঁড়িয়েও শোভাযাত্রা দেখা যাবে। তবে আসনে বসে সামনাসামনি কার্নিভাল উপভোগের জন্য ছাড়পত্র পাওয়ার হুড়োহুড়ি পড়েছে। তথ্যসংস্কৃতি দপ্তর এবং পর্যটন দপ্তরে তো বটেই, মন্ত্রীদের কাছেও জমছে অনুরোধের পাহাড়। কলকাতাস্থিত বিভিন্ন দেশের উপদূতাবাস, কনসুলেট থেকেও পর্যটন দপ্তরের কাছে কার্নিভাল দেখার ‘পাস’ চেয়ে বিস্তর অনুরোধ এসেছে।
প্রথমে ঠিক ছিল ১৫ হাজার দর্শকাসনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু আগ্রহ বাড়তে থাকায় তা বাড়িয়ে ২৬ হাজার করা হয়েছে। দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন আরও অন্তত ৫ হাজার মানুষ। তবে এর চেয়েও বেশি দর্শক আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কার্নিভাল প্রাঙ্গণে দর্শকদের ঢোকার জন্য ময়দানের দিক থেকে ৬টি প্রবেশপথ করা হয়েছে। দর্শকদের সুবিধার্থে থাকছে ৪টি জায়ান্ট স্ক্রিন এবং ১০০টি প্লাজমা টিভি। কার্নিভাল সরাসরি টিভিতেও সম্প্রচার করা হবে। যাঁরা রেড রোডে পৌঁছতো পারবেন না, তাঁদের জন্যই এই ব্যবস্থা।
প্রতিমার সঙ্গেই কার্নিভালে থাকছে ট্যাবলো। সেখানে কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, সবুজশ্রী, খাদ্যসাথীর মতো রাজ্য সরকারের জনপ্রিয় প্রকল্পগুলি তুলে ধরা হবে। খিদিরপুর থেকে রেড রোড হয়ে কিংসওয়ে পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে চন্দননগরের আলোয় পুজোর ভাবনা এবং সবুজশ্রী, কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্পগুলি তুলে ধরা হয়েছে। আজ আশ্বিনের সন্ধ্যায় আবারও মুখর হয়ে উঠবে কল্লোলিনী কলকাতা।