‘জিয়া নস্টাল’ বোধ হয় একেই বলে! বছরভর টেকনোলজির প্রাচুর্যে যে রেডিও সেটটির কথা মনেই থাকে না আমবাঙালীর, সেই রেডিওই সময়সরণী বেয়ে মহালয়ার আগে ফিরে আসে হারানো স্মৃতি নিয়ে৷ ঘুম-চোখে ভোর চারটেয় বালিশের পাশে রাখা রেডিও অন করলেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়- ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির।’
আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা, তারপরেই পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা। তাই, গুটি গুটি পায়ে পুরনো দিনের মানুষজন গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন কালনা চকবাজারে নিতাই দত্ত বা কাটোয়ার পঞ্চাননতলার তপন মণ্ডলের কাছে। হাতে বাড়ির ছাপোষা রেডিও। উদ্দেশ্য, একবার দেখে দিতে হবে। যদি কোনও সমস্যা থাকে তবে সঙ্গে সঙ্গে তা সারিয়ে নেওয়া যায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ না শুনলে যে তাঁদের পুজোটাই পানসে। রেডিও সারাতে আসা প্রবীণ-মাঝবয়সীদের এই হলো সার বক্তব্য।
টিভি আসায় রেডিওর কদর আর নেই বললেই চলে। অবসর সময়ে বসে বসে রেডিও শুনছেন, এমন মানুষ আর দেখাই যায় না। জেনারেশন ওয়াই-ও রেডিয়োর থেকে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ্য ইন্টারনেটে। হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারে নিজস্ব গন্ডীর মধ্যেই তাঁরা ঘোরাফেরা করেন। তবে এখনও এমন কিছু কলেজ পড়ুয়া বা তরুণ-তরুণীরা আছেন, যারা মহালয়ার ভোরে নিজেদের ফোন ডেটা বন্ধ করে ফোনের রেডিও চালু করে নেয়।
কোনও কোনও বাড়িতে আবার সারা বছর রেডিওর খোঁজ না পড়লেও মহালয়ার দিন কয়েক আগে থেকেই তা ঝাড়া মোছা শুরু হয়। পুরনো ব্যাটারি পাল্টে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে বেশ কয়েকবার ঝালিয়েও নেন বাড়ির বড়রা। তাঁদের মতে, ইন্টারনেট বলুন আর সিডি ডিভিডি-ই বলুন, ভোরের আলো ফোটার আগে আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ শোনার মত অভিজ্ঞতা টিভি বা ইন্টারনেটে পাওয়া যাবেনা। এই নস্ট্যালজিয়া বারবার ফিরে আসবে। ইদানীং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে মহালয়ার রমরমা হলেও, মহালয়ার ভোরে এখনও সেরা টিআরপি কিন্তু সেই আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র।
কালনার রেডিও মেকানিক নিতাই দত্ত ও কাটোয়ার তপন মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, টিভির রমরমায় রেডিওর দিন গেছে। বছরভর রেডিও শোনার লোক হাতে গোনা। রেডিওর বিক্রিও নেই। শুধু মহালয়ার সময়ে ‘বোবা’ রেডিও বগলে কিছু লোকজন আসেন মেরামত করাতে।
ট্রানজিস্টার বিলুপ্তপ্রায়। এখন অনেকের ভরসা কিন্তু হাতের মোবাইল ফোনই। মহালয়ার আগের রাতে ভোর চারটেয় অ্যালার্ম দিয়ে রাখেন অনেকেই। বলতে গেলে আধো ঘুমে আধো জাগরণে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চন্ডীপাঠ শুনেই বাঙালীর দুর্গোৎসবের ঢাকে কাঠি পড়ে। ইট বালি পাথর দিয়ে ঘেরা শহরে কাশ শিউলির গন্ধ আজ আর তেমন পাওয়া যায় না। কিন্তু ভোর চারটেয় এবারও বেজে উঠেবে সেই পরিচিত কন্ঠ। যা ছাড়া এখনও বাঙালীর দেবীপক্ষের আগমনী অসম্পূর্ণ।