দুটি নতুন প্রাণের আবাহন হল অদ্ভুত পরিস্থিতিতে। তার চেয়েও ভাল খবর দুটি প্রাণকে মানুষ বরণ করেছে আন্তরিকতায়। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, এই চেনা কথাটি ঘটনাদুটির মধ্যে দিয়ে আবার প্রমাণিত হল। ছোট ছোট খবর অনেক সময় একটা বড় শিক্ষা দিয়ে যায়, নতুনভাবে ভাবায় আমাদের। এই তো পুলিশদের সম্পর্কে নানা কটু মন্তব্য শুনি চারদিকে। কিন্তু দুটি খবরের একটিতে জানলাম পুলিশের সহায়তা ছাড়া প্রাণের এই আবাহন সম্ভবই হত না। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল পুলিশের এক অন্য মুখ। ওয়াটগঞ্জ থানা এলাকায় টহলরত পুলিশের একান্ত চেষ্টায় নিরাপদ প্রসব করতে পারলেন রাস্তায় প্রসব যন্ত্রণা ওঠা এক মহিলা। প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় থানা থেকে মহিলা পুলিশকর্মী ডেকে তারা মহিলাকে উদ্ধার করে ভ্যানে তোলেন, মহিলা পুলিশকর্মীর সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দারাও প্রসূতিকে পুলিশ ভ্যানে তোলার কাজে সাহায্য করেন। সেই ভ্যানেই একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন তিনি। ইতিমধ্যেই আরেক অফিসার স্থানীয় এলাকা থেকে একজন ধাইমাকে নিয়ে আসেন, তিনি এসে মায়ের নাড়ি কেটে দেন। এরপর পুলিশের তৎপরতায় মা ও শিশুকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মা ফরিদা খাতুন ও শিশুটি দুজনেই এখন ভালো আছে।
কথায় কথায় পুলিশের দোষত্রুটি ধরা আমাদের অভ্যাস, তারা যেন অন্য গ্রহের জীব। কিন্তু তারা না থাকলে আমাদের নিরাপদে বাস করাটা যে বহুক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে যেত তা একবারও আমরা ভেবে দেখিনা। ওয়াটগঞ্জের ঘটনাটা পুলিশের মানবিক মুখচ্ছবিটা আমাদের কাছে আবার স্পষ্ট করে দিল। এসব ঘটনাই পুলিশকে শুধুই ভিলেন না ভেবে তাদের সমাজের বন্ধু ভাবতে শেখায়। গার্ডেনরিচ রোডের ঝুপড়িবাসী প্রসূতিটির পরিবার পুলিশের কাছে কৃতজ্ঞ। ওই রাতে স্থানীয় যে মহিলারা প্রসূতিটির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্যালুট জানাই তাদেরও।
ওপরের ঘটনাটি মানবধর্ম পালনের একটা উদাহরণ। এমনটাই কিন্তু হওয়ার কথা, এমনটাই হত। নিয়মটাই এখন ব্যতিক্রম হয়ে গেছে বলে এখন এসব খবর হয়। ওয়াটগঞ্জের ঘটনাটির সূত্রেই আমার মনে পড়ে গেল আরেকটি ঘটনার কথা। এও খবরের কাগজেই পড়া। চেন্নাই থেকে ডিব্রুগড়গামী ট্রেনে প্রসব বেদনা ওঠে সঞ্জনা তাতির। ট্রেন তখন সবে পুরুলিয়া স্টেশন পেরিয়েছে। সঞ্জনার সঙ্গে তার স্বামীও ছিলেন। তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এগিয়ে এলেন শ্রাবণী নামে এক সহযাত্রী মহিলা। শ্রাবণী পুরুলিয়া শহরে একটা বিউটি পার্লার চালান। যাত্রীদের মধ্যে থেকেই চারজন মহিলাকে বেছে নিয়ে একটা টিম গড়ে তুললেন তিনি। তারা পুরুষ যাত্রীদের সরিয়ে দিল কামরার আরেকটা প্রান্তে। মহিলার চারপাশে কাপড় দিয়ে একটা আড়াল রচনা করলেন তারা। ট্রেনের কামরাতেই একটি কন্যা সন্তান প্রসব করলেন সঞ্জনা। নাড়ি কাটতে না জানায় অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না। জয়চন্ডী স্টেশনে ট্রেন পৌছনোর পর রেলের পক্ষ থেকে আদ্রার রেল হাসপাতালে খবর দেওয়া হয়, ডাক্তার ও নার্সরা আসেন। নাড়ি কেটে, প্রাথমিক চিকিৎসার পর মা ও সদ্যজাত শিশুটিকে রঘুনাথপুর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন তারা। সঞ্জনা জানিয়েছেন, শ্রাবণীর মুখটা তার চিরদিন মনে থাকবে। মা ও মেয়ে এখন ভালো আছে। শ্রাবণী তো বটেই ওয়াটগঞ্জের পুলিশের মত এখানে মানবধর্ম পালন করেছেন ট্রেনের সহযাত্রীরাও।
আমার মনে হয় মানবধর্ম পালনের এইসব উদাহরণগুলি যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সৃষ্টি করে চলেছেন তাদের পুরস্কৃত করা উচিৎ। শুধু সরকার বা কোন কর্পোরেট সংস্থা এই পুরষ্কার দেবে তা নয়, স্থানীয় ক্লাব, পুজো কমিটি বা কোন সমাজসেবী সংগঠনও এই উদ্যোগ নিতে পারেন। এতে উৎসাহিত হতে পারেন বা ঘটনাগুলো জানতে পারেন অন্যান্যরা। এই উজ্জ্বল উদাহরণগুলিকে তুলে ধরার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সবার। মানুষ মানুষের জন্য এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোন ভুল নেই, তবে সবচেয়ে ভাল হয় এই এগোনোর জন্য তাদের যদি কোন প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ থাকে। সব দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারিনা। আমাদের মত গরীব দেশে পথে ঘাটে, ক্ষেতে খামারে, বাসে ট্রেনে, মেয়েদের প্রসব বেদনায় আক্রান্ত হওয়ার এমন ঘটনা আকছার ঘটে। কোন উপায় না থাকা এমন মহিলারা বাইরে বেরোন। প্রসবে সহায়তা করার মত কোন প্রাথমিক প্রশিক্ষণ মহিলাদের দেওয়া হলে তারা পরিস্থিতি সামলাতে পারবেন।
এই ধরণের ব্যবস্থা চিন, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে রয়েছে। অবিলম্বে মেয়েদের স্কুলে, স্বনির্ভর দলগুলিতে, পঞ্চায়েতের মহিলা সদস্যদের মধ্যে এবং অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রের মত জায়গাগুলিতে হঠাৎ প্রসব বেদনা উঠলে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসন্মত প্রসব করানো প্রশিক্ষণ চালু করা উচিৎ। গ্রামে ধাইমারা একাজটা জানেন তাই উচ্চশিক্ষিত না হলে কেউ একাজ করতে পারবে না তা নয়। মেয়েরা এই প্রশিক্ষণ পেলে অনেক প্রাণ বাঁচবে, নিরাপদ প্রসবের ফলে সুস্থ থাকবে মা ও শিশু। সমাজ, সময় সবকিছুই এগোচ্ছে তাই প্রয়োজনীয় এই প্রশিক্ষণটির ব্যাপারে কারও কোন জড়তা থাকা উচিৎ নয়। চিকিৎসকদের সংগঠনগুলিও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে। আমি কিন্তু হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, চিকিৎসক, নার্স, নার্সিং হোম ইত্যাদি বাদ দিয়ে প্রসবের জন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলছি না। আমি শুধু বলছি এখনও প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক ও পরিকাঠামো কম থাকা একটি দেশে জরুরি প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসন্মত প্রসব করানোর শিক্ষা দানের কথা। মেয়েদের কুংফু, ক্যারাটে শেখানোর মত আত্মরক্ষার পদ্ধতির পাশাপাশি প্রসব পদ্ধতি শেখালে আখেরে আমাদেরই লাভ হবে।
পথে কিংবা ট্রেনে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হল, তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি আজকের দিনে আমাদের সেই শক্তি দেবে। কোন অসতর্কতা বা ভ্রান্তি তাকে যেন কেড়ে নিতে না পারে। মা আসছেন, আসুন তাঁর কাছে আমরা অজ্ঞানতা, অশিক্ষার অসুর বধ করার শক্তি চাই। তাহলে আমরা আরও বেশি মানবিক হয়ে উঠতে পারবো।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )