এবারও রায়চৌধুরী বাড়িতে শুরু হয়ে গিয়েছে পুজোর প্রস্তুতি। জোর কদমে চলছে দেবীপ্রতিমা তৈরির কাজ। বাংলাদেশের যশোহর জেলার মহেশপুর গ্রামে ছিল এই রায়চৌধুরীদের আদি বাস। তখন ওই বাড়িটি ছিল জমিদার বাড়ি।
কাঁটাতারের ওপারেও একসময় ঢাকের বাদ্যি বেজে উঠত। অষ্টমীর সন্ধিপুজোতে শোনা যেত কামান গর্জন। পুজোর দিনগুলিতে গমগম করত রায়চৌধুরীদের সেই জমিদার বাড়ি। বর্তমান বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দুর্গাপুজো চলেছিল প্রায় আড়াইশো বছর।
দেশভাগের সময় নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে এপারে চলে আসতে হয় রায়চৌধু্রীদের। ফলে চলে আসতে হল তাঁদের আরাধ্য দেবীকেও। এপারে এসে এই বাড়ির সদস্যরা ওঠেন নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার পাবনাখালিতে। মহেশপুর থেকে পাবনাখালি গ্রামের দূরত্ব মাত্র ২৫ কি.মি.। তবে এখন ২টি জায়গাই আলাদা ২টি দেশের মধ্যে পড়ে।
প্রায় ২৫০ বছরের নাটমন্দির ছাড়তে কষ্ট হয়েছিল সকলেরই। কিন্তু উপায় ছিল না। তবে এপারে এসেও দেবীর আরাধনা বন্ধ করেননি তাঁরা। নতুন করেই ফের শুরু হয় পুজো। এখন আর জমিদারি নেই বটে, দেবীর আরাধনায় নিষ্ঠা কিন্তু সেই আগের মতই রয়ে গিয়েছে।
ইতিমধ্যেই ৭১ বছর পার করেছে রায়চৌধুরীদের পুজো। তবে দুই বাংলা মিলিয়ে পুজোর মোট বয়স ৩২০ বছরেরও বেশি। এবাড়ির দুর্গা প্রতিমা একটু অন্যরকম। আপাতদৃষ্টিতে দেবী এখানে দ্বিভুজা। তিনি ‘দ্বিভুজা দুর্গা’ নামেই প্রসিদ্ধ। তবে রায়চৌধুরী বাড়ির প্রতিমা কিন্তু দশভুজাই। দেবীর অন্য হাতগুলি আঙুলের মত ছোট। সেগুলি দেবীর চুলের আড়ালেই ঢাকা থাকে। ফলে বাইরে থেকে দেখা যায় মাত্র দুটি হাত।
প্রথা অনুযায়ী আজও রায়চৌধুরী বাড়িতে দেবীর কাঠামো পুজো হয় রথযাত্রার দিনে। ষষ্ঠীর দিনে জ্বলে ওঠে হোমের আগুন। তা নেভানো হয় দশমীতে। পুজোর চারদিন ধরেই চলে চণ্ডীপাঠ। দেবীর একহাতে থাকে ত্রিশূল এবং অন্য হাতে থাকে সাপের লেজ। দেবীকে ভোগ দেওয়া হয় দিনে চারবার। সকালে ৫ রকমের ভাজা-সহ কলাই ডালের খিচুড়ি, ফল ও মিষ্টি দেওয়া হয়। দুপুরে অন্নভোগ। বিকালে পরমান্ন ভোগ। রাতে লুচি, সুজি ও সন্দেশ। দশমীর ভোগেও অন্য নিয়ম। দেবীকে ভোগ দেওয়া হয় পান্তাভাত আর শিবের জন্য গাঁজা। রায়চৌধুরী বাড়িতে দেবীকে বিদায় দেওয়ার আগেই নেমে আসে শোকের ছায়া। এখনও প্রথা মেনেই প্রতিমা কাঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিসর্জনে। চূর্ণী নদীতে হয় বিসর্জন।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ওপারে সন্ধিপুজোর সময়ে শোনা যেত কামানের গর্জন। তবে এপার বাংলায় কামানের কোনও অস্তিত্ব নেই। রায়চৌধুরী বাড়ির বর্তমান কর্তা পিনাকীপ্রসাদ রায়চৌধুরী বলেন, ওপার বাংলা অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ২৫০ বছর ধরে এই পুজো হয়েছিল। এপার বাংলায় আসার পর তা প্রায় ৭১ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। একসময় জমিদারির জৌলুস ছিল পুজোয়। ঢাকের বাদ্যি, আলোর রোশনাই, আতশবাজি, শয়ে শয়ে মানুষের আনাগোনায় গমগম করত পুজোর দিনগুলি। তবে পুজোয় সেই জাঁকজমক না থাকলেও, এই ঐতিহ্যবাহী পুজো দেখতে এখনও ভিড় জমান সকলে।