শোনা যাচ্ছে গত কয়েকদিনে কাজী নজরুল ইসলামের কবরে ফাটল দেখা গেছে, এলাকাটা মাঝে মাঝে কাঁপছে। রবীন্দ্রনাথের সমাধিস্থলের অবস্থা একই। চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, হতবাক সবাই, হলটা কি? রবীন্দ্র-নজরুল যন্ত্রণায় ছটপট করছে কেন? বহু গবেষণার পর জানা গেছে, বিজেপি বাংলা ভাষাকে ভালোবাসে বলার পরই এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বিজেপির বাংলা প্রেমের কথা শুনে আপনার হঠাৎ হৃদস্পন্দন বাড়েনি তো? চেয়ার কিংবা বিছানা থেকে পড়ে যাননি তো? আপনি আমার পাঠক, আপনার শরীরের চিন্তা তো আমায় করতেই হয়। জল খেয়ে ঠান্ডা হয়ে বসুন, তারপর পড়বেন। আমি কাজের কথায় ফিরি।
সমাজের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্ন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। ডাক্তারিতে সর্বভারতীয় নীট পরীক্ষা হচ্ছে, বাংলায় প্রশ্ন ইচ্ছাকৃত ভাবে জটিল করা হয়েছে একবার। আর একবার বাংলা প্রশ্নপত্র ভুলে ভরা। এমনিই বাংলা মাধ্যমের ছেলে-মেয়েদের জোর করে হারিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আবার বাংলা প্রশ্নপত্রে হাজার ত্রুটি। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায়- সত্যিই তারা বড় বাংলা প্রেমী! সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্ট এন্ট্রান্স হিন্দি ও ইংরেজির সাথে গুজরাটিতে হচ্ছে। অবাক হবেন না, গুজরাটি রাষ্ট্রের প্রধান সেবকের মাতৃভাষা, আর বাংলা তো বানের জলে ভেসে আসা। তাই বাংলায় পরীক্ষা হয় না, গ্রাম বাংলার ছেলেমেয়েরা ইঞ্জিনিয়ারিং এ সুযোগ পায় না। কিন্তু মাথায় রাখবেন, বিজেপি বড় বাংলা প্রেমী। রেলের কটা পরীক্ষা ছাড়া কোনো কেন্দ্র সরকারি পরীক্ষা বাংলায় হয় না। বাংলার ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিখে পরীক্ষা দেয়, অনেক জায়গায় আবার হিন্দি কিছু প্রশ্ন বাধ্যতামূলক। ওরা নিজেদের মাতৃভাষা হিন্দিতে পরীক্ষা দেয়। আর ইন্টারভিউয়ের সময় বাঙালিদের হয়রানির কথা তো ছেড়েই দিলাম। কিন্তু ভুলে যাবেন না, বিজেপি বাংলা প্রেমী। আমার কটা কথায় বিজেপির বাংলা প্রেমকে ছোটো করবেন না।
আসামের এন আর সি তে নাম না আসা ৩৮ লাখ বাঙালি নাকি “উইপোকা”। প্রসঙ্গত ৩৮ লাখ বাঙালির ২৫ লাখ হিন্দু ও ১৩ লাখ মুসলিম। আসামের মাটি থেকে বাঙালিকে উৎখাত করার চেষ্টা চলছে। এন আর সি তে নাম না ওঠায় আত্মহত্যা করছে অসংখ্য বাঙালি। উত্তেজিত হয়ে ভাববেন না, সবাই মুসলমান। কারণ হয়ত মুসলমান মরলে আনন্দিত হোন। কিন্তু আপনার জন্য দুঃখের কথা বেশিরভাগ হিন্দু বাঙালি। ডি-ভোটারের নোটিশ দিয়ে বাঙালিকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢোকানো হচ্ছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি মহিলারা ডিটেনশন ক্যাম্পে শারীরিক ভাবে অত্যাচারিত। ডিটেনশন ক্যাম্পেও অনেকের মৃত্যু হয়েছে, একটু শান্ত হোন। মুসলিম নাম খুঁজছেন? এখানেও অনেক হিন্দু বাঙালি। যাই হোক, মাথা খারাপ করবেন না। আপনি ঠিকই জানেন, বিজেপিই আসল বাংলা প্রেমী। খামোকা এই তথ্য গুলো মাথায় ঢোকাবেন না।
ঝাড়খন্ডের বিজেপি সরকার বাংলার অধীনে থাকা ম্যাসাঞ্জোর ড্যাম থেকে রাজ্য সরকারের সব সাইনবোর্ড সরিয়ে দিয়েছে। ভালোই তো করেছে! তাই না? আমাদের রাজ্যের মানুষ বিজেপিকে ভোট দেয় না কেন? তাই বাংলাকে ভালোবেসে এটুকু তারা করতেই পারে। বন্যায় যখন ভেসে যায় বাংলার গ্রামের পর গ্রাম, কেন্দ্র থেকে কানাকড়িও আসে না। বেশ করে! ভোট না দিলে কানাকড়িও পাবে না। বাংলা প্রেমী বিজেপি এটা কি ভুল করেছে? আপনি কি বলেন? আমার মনে হয় যথাযথ করেছে। বাংলায় নানা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা বাকি! আর রাজ্য থেকে যা ট্যাক্স তোলে তার অনেক কম অনুপাতে ফেরত দেয়। ব্যাংক গুলোও বাংলার মানুষকে ঋণ কম দেয়।
ক্ষমা করবেন, এগুলো বাজে অপপ্রচার। আসলে বাংলা প্রেমী বিজেপি অনেক ভালো কাজ করে। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের রোলার চালায় বাংলার বুকে। বাংলা কিছু শব্দ শুনলে গা-বমি পায় উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় ‘কারিয়াকর্তা’ দের, বিজেপির মিটিং-মিছিলে তাই হিন্দিই শোনা যায়। দাঙ্গার সময় বা রাম নবমীর মিছিলে তাই হিন্দি স্লোগান শুনে রাগ করবেন না। অবশ্য একটা ভালো জিনিস হয়, দাঙ্গার স্লোগান শুনে বোঝা যায় বিজেপির হয়ে দাঙ্গা কারা করে! বাংলার দুর্গা, কালী পুজোয় নাঁক উঁচু করা বিজেপির “জ্যায় শ্রীরাম”ই তো তাদের বাংলা প্রেমের প্রমাণ। দোল ভুলিয়ে হোলি করে, কালীপুজো ভুলিয়ে দিওয়ালী। আর আমাদের মতো নিন্দুকেরা বিজেপির বাংলা প্রেম দেখতে পাই না। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী বিজেপি বাংলার বুকে “উর্দু অগ্রাসন” খুঁজে বাংলা প্রেম দেখায়। তা মশাই এতে আপনাদের সমস্যা কি? “হিন্দি অগ্রাসন” তো হতেই পারে, হিন্দির দ্বারা বাংলার “ধর্ষণ” তো স্বাভাবিক। তাই না? বাঙালি মুসলমানের ভাষা উর্দু! হাসবেন না! এটা আমি বলছি না, বিজেপি বলে। তারা কতটা বাংলা প্রেমী দেখেছেন, বাংলাকে কতটা চেনে! তাই আর ভুলেও তাদের বাংলা প্রেমকে প্রশ্ন করবেন না।
তারা বাংলার প্রাণপুরুষ চিত্তরঞ্জন দাসের মূর্তি উপরে ফেলে। তাদের রাজ্যে তারা নেতাজির মূর্তি ভাঙে। তারা ত্রিপুরায় রবীন্দ্রনাথের মূর্তি সরায়। আসামে রবীন্দ্র জয়ন্তী নিষিদ্ধ করে। এতটাই বাংলা প্রেমী তারা, নিজেদের ঘৃণার বাণী রবি ঠাকুরের বলে চালায়। বাংলার জাতীয় শিক্ষক বিদ্যাসাগরকে ভুলিয়ে তারা “মোগলসরাই উপাধ্যায়” কে পুজো করাতে চায়। তারা স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলার অভিভাবক প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের তৈরি করা বেঙ্গল কেমিক্যালস বন্ধ করে দেবে বলে। তারা ঝাঁপ বন্ধ করতে চায় হিন্দুস্তান কেবলসের। আর আপনারা বারবার বলবেন, বিজেপি বাংলা বিরোধী। এটা মানব না। গুজরাট থেকে “আদমি” ডাকব কিন্তু, আপনাকে একটু “সমঝিয়ে” দেবে! আরে এখন তো ডাকতে হয় না, বর্গীরা তো ঝাঁপিয়েই পড়েছে। তাই আপনার “জবান” সামলাম। আপনি সারা জীবন রাখিবন্ধন দেখেছেন, বাঙালির মিলন ও সম্প্রীতির উৎসব রাখি। বিজেপি রাখি উৎসব করে তলোয়ার হাতে। আর কত প্রমান দেব বিজেপির বাংলা প্রেমের? মানবেন? আর কত লিখতে হবে? এতকিছু বললাম। বাঙালিকে কথায় কথায় বাংলাদেশি বলে, পাকিস্তানি বলে বিজেপি। এমনকি টিভি চ্যানেলে বসেও বলে। এমন বাংলা প্রেম দেখেছেন?
লোকসভা ভোট আসছে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে বিজেপি ওয়ার রুম খুলছে। সেসবের দায়িত্বে উত্তর ভারতের ‘বাংলা প্রেমী’ দাঙ্গাবাজরা। সেখানে ঠাঁই নেই বাংলার নেতাদের। আমাদের রাজ্যের ক্ষমতা আমাদের রাজ্যের নেতাদের হাতে থাকবে কেন? গোবলয়ের গুন্ডারা কি জন্য আছে? বিজেপি খড়-বিচালি দিয়ে এত বছর কি এমনি পুষেছে?
তাই বিজেপির বাংলা প্রেম নিয়ে মনে সংশয় রাখবেন না। অনেক বোঝালাম। এবার না বুঝলে ডেকে দেব অমিত শাহকে, “উইপোকা” বলে বাংলাদেশে “ভেজ দেগা”, বুঝবেন! নাহলে, আরও কয়েকজনকে ডাকব, “ঘুসা দেগা”। তাই কাল থেকে বলবেন, “বিজেপি বড়া বাংলা প্রেমী আছে। “
একি রবীন্দ্র-নজরুলের সমাধিস্থল গুলো আরও বেশি করে কাঁপছে কেন?
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )