মানুষের সব কাজ, উদ্যোগ, চেষ্টা, ইচ্ছার পিছনে একটা স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নটা বুকে নিয়েই গড়ে ওঠে বাড়ি, স্কুল, গ্রন্থাগার, মন্দির, মসজিদ এমনকি পাড়ার ক্লাব বা ব্যায়াম সমিতিও। সেই স্বপ্নটা ভেঙে যাওয়া বা ভেঙে দেওয়াটা একটা ক্ষমাহীন অপরাধ। তবুও এই ঘটনা জগৎসংসারে প্রতিনিয়ত ঘটে চলে। মানুষই সবকিছু উদ্যোগ নেয় আবার মানুষের ভুলেই সেই উদ্যোগ নষ্ট হয়। উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের দাড়িভিটে হাইস্কুলে শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে হাঙ্গামায় দুই স্কুলছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুতে সেই অপরাধেরই পুনরাবৃত্তি হল। মানুষ হিসেবে তো বটেই বাবা হিসেবেও এই ঘটনায় আমি মর্মাহত। সব অভিভাবকরাই ভবিষ্যতের একটা স্বপ্ন নিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে গোটা পরিবার।
এমন ঘটনা ঘটলে যা হয় তা সবকিছুই যথারীতি নিয়ম করে শুরু হয়ে গেছে। স্থানীয় মানুষ, পুলিশ, স্কুল কর্তৃপক্ষ, রাজনৈতিক দল সবাই একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। শুরু হয়ে গেছে বিক্ষোভ ও পাল্টা বিক্ষোভ, মিটিং, মিছিল এবং দেওয়া হয়েছে রাজ্য জুড়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক, প্রয়োগ করা হয়ে গেছে বাংলার রাজনীতিবিদদের চেনা ব্রহ্মাস্ত্র – বাংলা বন্ধ। এসব কোনকিছুই রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মণ নামে দুটি ছাত্রকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। যার যায়, তার যায়। যে বাবা মা তাদের সন্তানকে হারালেন, যাদের কে অবলম্বন করে তারা ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের সেই ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেল। কন্যাশ্রী, মিড ডে মিল, সাইকেল প্রদান ও নানা যোজনার মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখী করার পরিবেশে এই গুলি চালানোর ছবিটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। খবরের কাগজে দেখলাম ঐ স্কুলের এক ছাত্রী বলছে, এরপর তার ঐ মাঠের মধ্যে দিয়ে স্কুলে যেতে ভয় করবে। ছেলেমেয়েদের এই প্রতিক্রিয়া নিশ্চিতভাবে তাদের বাবা মায়েদের মধ্যেও ছড়াবে। শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগের সঙ্গে যাদের সামান্য যোগাযোগ আছে তারা সবাই জানেন এখনও আমাদের দেশে বহু অভিভাবকদের তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে রীতিমত বেগ পেতে হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে এই ঘটনা ঘটল কেন? দায়ী কারা? যে জহ্লাদদের গুলিতে এরা খুন হল রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে তাদের কীভাবে দ্রুত চিহ্নিত করা হবে? ঘাতক ও তাদের উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এটা গ্রামবাসীদের প্রশ্ন, রাজ্যের মানুষের প্রশ্ন, আমার মত বাবাদেরও প্রশ্ন। কোন রাজনৈতিক ওতরচাপানে এই প্রশ্নটাকে গুলিয়ে দেওয়া যাবে না। দুঃখের সঙ্গে দেখছি সেই চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। মোদ্দা কথা, পুলিশই হোক বা রাজনৈতিক দলের ভাড়াটে গুন্ডা যে বা যারা গুলি চালিয়েছে তাদের শাস্তি চাই। এব্যাপারে যদি পুলিশ, প্রশাসন, স্কুল কর্তৃপক্ষ, স্কুল শিক্ষা দপ্তর, স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কোন গাফিলতি, ব্যর্থতা, পরিস্থিতি বুঝতে না পারার অক্ষমতা থাকে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কোনভাবেই তাদের আড়াল করা যাবে না। কাউকেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে দেওয়া হবে না।
আমাদের রাজনীতির এটা এখন বোঝার সময় এসেছে মানুষের স্বপ্ন, ইচ্ছেকে ভেঙে দিয়ে বা তাকে ব্যবহার করে বা ভুল পথে চালিত করে আখেরে কোন লাভ হয় না। আমি তখন আনন্দবাজারে। বাম আমলে বানতলার ঘটনার পর আনন্দবাজার পত্রিকার এক সাংবাদিক ঘটনাটি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানার জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ফোন করলে তিনি ‘এমন ঘটনা কত ঘটে’ বলে ফোনটি রেখে দিয়েছিলেন। বাংলার রাজনীতিতে বামেরা অতীত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বামপন্থী ঔদ্ধত্যও অতীত হয়ে গেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিদেশ সফররত অবস্থায় ঘটনাটির জানার সঙ্গে সঙ্গেই জ্যোতিবাবুদের ঢঙে এড়িয়ে যাওয়ার মত কোন নিরাপদ বিবৃতি না দিয়ে উপযুক্ত তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি যা বলেছেন তা তার কাছে আসা সর্বশেষ রিপোর্টের ভিত্তিতে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, একটা গ্রামের স্কুলে এমন কী ঘটনা ঘটল যে পুলিশ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। গোলমাল বেড়ে ওঠার আগে ছাত্রদের সরিয়ে দিতে কি তারা পারতেন না? বিক্ষোভ যে এমন তীব্র হতে পারে সেই খবর না পাওয়াটাও তো তাদের ব্যর্থতা! স্কুলের এই গণ্ডগোলে সমাজবিরোধীরা ঢুকে পড়ার ব্যাপারটা তাহলে হয়তো আটকানো যেতে পারতো। কোন বহিরাগত শক্তি ঘোঁট পাকাতে পারতো না। একটা জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ এখন যেকোন ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারেন। এই শক্তি কাজে লাগালে অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা এড়ানো যায়।
রাজনীতিবিদদের মুশকিল হল তারা সবকিছুতেই হয় শাসক নয় বিরোধীদের ব্যর্থতা বা ইন্ধন খোঁজেন। যেমন বিজেপি এই দুঃখজনক ঘটনার পিছনে খুঁজছে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত। বেদনাদয়ক এই ঘটনাতেও একটা সাম্প্রদায়িক রঙ লাগাতে চাইছেন তারা। প্রকৃত সত্য সামনে আনতে হলে এই চেষ্টা প্রতিহত করতে হবে। পরিস্থিতির মোকাবিলা করার ব্যাপারে পুলিশের কোন ব্যর্থতা ছিল কিনা তাও দেখতে হবে। কাগজে দেখছিলাম সদ্য কাজে যোগ দেওয়া উর্দু শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, ছাত্রছাত্রীরা প্রথম থেকেই ছিলেন মারমুখী, তারা তাদের লাঠি ও চড় দেখিয়েছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল কেন সে ব্যাপারেও বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ও তদন্ত দরকার। ব্যাপারটা শুধু আমরা ভাল আর ওরা খারাপ এমন জায়গায় আটকে রাখলে চলবে না। দেখতে হবে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে অকারণ কোন তাড়াহুড়ো বা অনিয়ম হয়েছে কিনা যা ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
একটা দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা এই দুঃখজনক ঘটনাটাকে নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে পারে। বহু চেষ্টার পর আমাদের রাজ্যে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা এখন সুদিনের মুখ দেখেছে। এই অবস্থাটাকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। ইসলামপুর যেন একটা দুঃখজনক বিক্ষিপ্ত ঘটনা হয়েই থাকে। এর পুনরাবৃত্তি আটকানোর ব্যাপারে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষা দপ্তর, পুলিশ, প্রশাসন, সরকারের পাশাপাশি আমাদের মত অভিভাবকদেরও বিরাট ভূমিকা আছে। সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে আমাদের যাতে কেউ ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদেরও সচেতন থাকতে হবে। জীবনের ফুটে ওঠার অবস্থায় আপনার আমার ঘরের ছেলেমেয়েদের লাশ করে দেওয়ার অধিকার কারোর নেই, দোষীদের শাস্তি চাইছি। কিন্তু প্রতিবাদের নামে লাশের রাজনীতিও আটকাতে হবে। ‘লাশ’ করে দিতে হবে লাশের রাজনীতিটাকেই।
স্কুল নিয়ে লিখতে লিখতে ছোটবেলায় পড়া কবিশেখর কালিদাস রায়ের সেই ‘ছাত্রধারা’ কবিতাটা মনে পড়ে গেল বর্ষে-বর্ষে দলে-দলে আসে বিদ্যামঠতলে,/ চলে যায় তারা কলরবে,/ কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয়/ যৌবনের শ্যামল গৌরবে। বুলেট নয়, হিংসা নয় যৌবনের শ্যামল গৌরবে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিষ্ঠা করার কাজে আপনার আমার সবার দায়িত্ব আছে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )
অশোক মজুমদার
লেখক প্রাবন্ধিক ও প্রথিতযশা চিত্র সাংবাদিক