কিছু কিছু লড়াই স্বগুণে হয়ে ওঠে রূপকথা। কিছু কিছু যাত্রাপথে বাড়তি কোনও আলো লাগে না। বরং জীবনকে আলোকিত করে তোলে। কোনও কোনও মানুষ তাই হয়ে ওঠেন প্রণম্য। যেমন, ৭৯ বছরের পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। নদীয়ার মানুষ তাঁকে ডাকেন ‘মাদার টেরিসা’ নামে। এলাকার যে কোনও বিপদ আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। যে কোনও অসুবিধায় বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। শুনেছিলেন, কবরস্থান না থাকায় মৃত্যুর পর এলাকার মুসলমান ভাইদের বাড়ির উঠোনেই কবর দিতে হয়। থাকতে পারেননি। নিজের ১২ কাঠা জমি ছিল নদীর ধারে। কবরখানা করার জন্য সেই জমি দান করে দেন পূর্ণিমাদেবী।
হুগলীর শ্রীরামপুরের ঠাকুরবাড়িতে জন্ম পূর্নিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাবা ছিলেন অবিনাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, মা বিমলা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তরে চাকরি করতেন। আজীবন অকৃতদার। পারিবারিক বিবাদের কারণে ঘর ছাড়েন। সেই থেকে বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন। অবশেষে ২০০০ সালে পলাশিপাড়া ব্লক অফিস অবসর নেন। এই জায়গাটা খুব পছন্দ হয়ে যায় তাঁর। ঠিক করেন, বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দেবেন। তাই এখানেই জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন। একাই থাকতেন বাড়িতে। এলাকার লোকজনই ছিল তাঁর পরিবার। বয়সের ভারে শরীর অশক্ত হলেও স্মৃতিশক্তি এখনও প্রখর। ওই গ্রামেরই চাইনা বেগম বলেন, ‘পূর্ণিমাদেবী আমার পূর্ব পরিচিত। সেই সুবাদেই গল্পের ছলে আমি ওকে বলেছিলাম আমাদের গ্রামে মুসলিম পরিবারের কেউ মারা গেলে কবরস্থান না থাকায় বাড়ির উঠোনে কবর দিতে হয়। এটি আমাদের গ্রামের বড় সমস্যা। এই কথা শোনার পর পূর্ণিমাদেবী বলেন নদীর ওপারে আমার ১২ কাঠা জমি আছে, ওই জমি আমি মুসলিম ভাইদের দান করে দেব। যেমন বলা তেমনি কাজ, কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি কাগজপত্র তৈরি করেন, কবরখানা করার জন্য জমি দান করে দেন।’
এর আগে হিন্দুদের মন্দির গড়ার জন্য নিজের জমি দান করেছিলেন। এবার মুসলিমদের কবরস্থানের জন্য জমি দান করলেন। গ্রামের মানুষের কথায়, ‘পূর্ণিমাদেবীর থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শেখা উচিৎ রাজনৈতিক নেতাদের’। নিজের বসতবাড়িটাও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে দান করে দিয়েছেন। এখন পেনশনের টাকায় কোনও মতে চলে। পূর্ণিমাদেবীর কথায়, ‘আমার আমার করে কী লাভ। নিজে সংসার করিনি, ঠাকুরের নাম করে ৭৯টা বছর পার করে দিলাম। সম্বল বলতে সামান্য কয়েক হাজার টাকার পেনশন। যে কদিন বাঁচব, এই অর্থেই চলে যাবে। হাসিমুখে অন্যের সেবা করার মতো আনন্দ অন্য কিছুতে আছে কিনা আমার জানা নেই’। সত্যিই প্রণম্য পূর্ণিমাদেবী।