“বাদল পে পাও হ্যায়/ ইয়া ঝুটা দাও হ্যায়/আব তো ভাই চল পড়ি/ আপনা ইয়ে নাও হ্যায়’’
‘চাক দে ইন্ডিয়া’ ছবির সেই বিখ্যাত গানটির কথা মনে পড়ছে? সেই যে সব বাধা পেরিয়ে মেয়েদের হকি টিম গিয়েছিল বিদেশের মাটিতে ওয়ার্ল্ড কাপ জিততে? সেটা ছিল সিনেমার পর্দায় স্বপ্ন পূরণের গল্প। তবে লক্ষ্মী খাতুন, গুড়িয়া রাণী, অনিতা ওঁরাও-রা বাস্তবেই সেই স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছেন। তবে হকি নয়। ভলিবল খেলতে তাঁরা এবার পাড়ি দেবেন আবু ধাবি। প্রত্যেকেরই বয়স ১৮ থেকে ২০। এঁরা কেউই আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক নন। মানসিক ভারসাম্যহীনতার শিকার। অনিতা ওঁরাও-এর সমস্যা তো আরও গুরুতর। তিনি একইসঙ্গে মূক ও বধির। তিনজনেই পিতৃ-মাতৃহীন। হাওড়ার বাগনানের পারবাকশী গ্রামের ‘চির নবীন’ হোমই তাঁদের ঠিকানা।
তবে এত প্রতিকূলতা পেরিয়েই এই তিনজন, বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের নিয়ে তৈরি জাতীয় ভলিবল টিমে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। সামনের বছর স্পেশাল অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে যাবেন আবুধাবিতে।
‘চিরনবীন’ এই হোমটিতে প্রায় ২০০ মানসিক ভারসাম্যহীনতার আবাসিক থাকেন। হোমে লেখাপড়া, খেলাধুলো, নাচ-গান, হাতের কাজ সবই শেখানো হয়। কিন্তু মেয়েদের ভলিবল খেলার আগ্রহ জন্মালো কীভাবে? হোমের সুপারিন্টেনডেন্ট পম্পা পাত্র জানালেন, “আসলে এই হোমের কর্মীরা মাঝে মধ্যেই ভলিবল খেলেন। শুধু পুরুষ কর্মী নন, মহিলা কর্মীরাও সময় পেলেই ভলিবল খেলেন। আর তাঁদের ভলিবল খেলতে দেখেই লক্ষ্মী, অনিতা, গুড়িয়াদের ভলিবল নিয়ে আগ্রহ জন্মায়। তারাও দেখাদেখি ওই কর্মীদের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে খেলা শুরু করেন। এই খেলায় মেয়েদের এত আগ্রহ দেখেই ভলিবল খেলার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।”
মেয়েদের উৎসাহ দেখে হোমেরএই হোমের অ্যাথলেটিক গ্রুপ ‘ভারত’ স্পেশাল অলিম্পিকে সদস্য পদের জন্য আবেদন করে। রেজিস্ট্রেশন মিলে যায়। তারপরেই স্পেশাল অলিম্পিক আয়োজিত বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যান তাঁরা। বেশ কিছু টুর্নামেন্টে জয় পান তাঁরা।
এই তিনজন ছাড়াও কিন্তু এই হোমের আরও কয়েকজন আবাসিক নিয়মিত ভলিবল খেলেন। এমনকি গত বছর জানুয়ারিতে এই হোমের আটজন খেলোয়াড় রাজ্যের ভলিবল দলের সদস্য হয়ে গুজরাতে জাতীয় স্তরে খেলতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা কেরালাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। লক্ষ্মী, গুড়িয়া, অনিতা ছাড়াও সেই দলে ছিলেন হেনা আফসানা, রাজকুমারী চৌধুরী, রেজিনা, সোনি এবং খুকুমনি শিট।
জাতীয় স্তরে এই জয় আত্মবিশ্বাস এনে দেয় ‘চিরনবীন’-এর খেলোয়াড় ও উৎসাহী কর্মীদের মনে। শুরু হয় আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার প্রস্তুতি। তার জন্য ইতিমধ্যেই দুটি প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ নিয়ে ফেলেছেন এই খেলোয়াড়েরা। গত বছরের জুন মাসে রাজস্থানের প্রশিক্ষণ শিবিরে লক্ষ্মী, অনিতা, গুড়িয়াদের সঙ্গে ছিলেন রাজকুমারীও। তবে পরে কিছু টেকনিক্যাল কারণে তিনি চুড়ান্ত দল থেকে বাদ পড়েন। বাকি তিনজনেই দলে সুযোগ পেয়েছেন। গত অগাস্ট মাসে, বোলপুরের শান্তিনিকেতনে সারা হয়ে গেছে দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ শিবির। জোর কদমে প্রস্তুতি চলছে পরের প্রশিক্ষণ শিবিরের।
তবে এই খেলোয়াড়দের কিন্তু বেশ কষ্ট করেই খেলাধুলোর চর্চা করতে হয়। যথাযথ পরিকাঠামোর অভাব তো রয়েইছে। সেই আক্ষেপই ঝরে পড়ল পম্পার গলায়। “আমাদের হোম প্রত্যন্ত গ্রামে হওয়ায় তেমন প্রচার পায়না। অনেক অসুবিধার মধ্যে দিয়েই আমাদের মেয়েরা খেলাধুলোর চর্চা করে। আগে বর্ষাকালে জল জমে মাঠের অবস্থা খারাপ হয়ে যেতো। ফলে অনেকদিন মেয়েদের অনুশীলন বন্ধ রাখতে হত। সম্প্রতি সরকার থেকে আবেদন করে এই হোমে একটা মিনি স্টেডিয়ামের ব্যবস্থা করা হয়েছে”। এর পরেও আরও অনেক অভাবের মধ্যেই দিন কাটে ওই আবাসিকদের। নির্দিষ্ট সরকারি সাহায্যের পরেও হোম চালাতে ক্লাব ও অন্যান্য সমাজসেবী সংস্থার অনুদানের উপরেই নির্ভর করতে হয়। “কোনও কর্পোরেট সংস্থা যদি তাঁদের সিএসআর ফান্ড থেকে সাহায্য করে, তাহলে হয়তো একটু সুরাহা হবে”, জানিয়েছেন পম্পা।
এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ‘চিরনবীন’-এর দল তাঁদের লক্ষ্যে স্থির। জাতীয় স্তরের পর আন্তর্জাতিক জয়ই এখন পাখির চোখ। এই খেলোয়াড়েরা কেউই তাঁদের মনের ভাব গুছিয়ে বলার ক্ষমতা রাখেন না। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সাফল্যই হবে মুখের মতো জবাব। তবে আবু ধাবিতে পদক আসুক না আসুক সব বাধাকে জয় করে স্বপ্ন দেখার সাহসে ভর করে এঁরা ইতিমধ্যেই এক একজন সোনার মেয়ে।