অস্তরাগের এই বারান্দার কোনাটা মিনতি দেবীর একান্ত নিজস্ব। বড় আপনার। ছোট্ট একটা তুলসী গাছ, তাতে জল দিতে দিতে আপনার মনেই সূর্য প্রণাম টা সেরে নেন মিনতি দেবী বরাবরের মতো। স্বামী ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপ পুলিশ কমিশনার। চোর ডাকাতের পেছন ছুটতে ছুটতে কোনদিন আর ঘর সংসারের দিকে তাকান নি। একা হাতে তিন ছেলেমেয়ে কে মানুষ করতে করতে আর ট্রান্সফারের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে মিনতি দেবীও কম শক্ত হননি।
তাই স্বামীর মৃত্যুর পর তিন ছেলেমেয়ে তিন মাস করে রাখার প্রস্তাবে দৃঢ় ভাবে না বলতে বাঁধেনি। কিছুদিন পরে বড়ছেলে নিজেই খুঁজে পেতে এই বৃদ্ধাশ্রমটার কথা বলল। ছেলেমেয়ে খুশী হয়েছিল কিনা জানেন না, তবে তিনি নিজে বড় খুশী হয়েছিলেন। এ ভাবে ভাগের মায়ের গঙ্গা হতে বড় সম্মানে লাগত তৎকালিন জাঁদরেল পুলিশ অফিসারের স্ত্রী মিনতি বসুর।
অস্তরাগের সব ব্যাবস্থা খুবই ভালো। কর্মচারীরা পেশাদার ও সহানুভূতি সম্পন্ন। পূজা পার্বণে উৎসব উপলক্ষে একসাথে বেড়াতে যাওয়া, সন্ধ্যাবেলা চা-তেলেভাজার সাথে গান-গল্প করে কাটিয়ে দিতে মিনতি দেবীর বেশ ভালই লাগে। কিন্তু তবু……সেই তবুর শূন্যতা যেন যায় না।নিজেই জেদ করে এসেছেন তাই কাউকে কিছু বলতেও পারেন না। সবার সাথে থাকতে ভালই লাগে। বেশ একটা আলাদা পরিবারের মতো। তবুও দিনের শেষে ঘরে ফিরে সবাই একা। কাপড়ের ভাঁজ নষ্ট হয় না, বিছানার চাদর পাট পাট থাকে, ড্রেসিং টেবিলের ধুলো দিনে আর কতবার ঝাড়া যায়।
আজ বেশ কয়েক মাস হলো অবিনাশ বাবু এসেছেন অস্তরাগে। হটাৎ করে আসা তাই একদম শেষের ঘরটাতে ওনার ঠাঁই হয়েছে। একমাত্র পুত্র বিদেশে, তাই স্ত্রী বিয়োগের পর অগত্যাই অস্তরাগের দ্বারস্থ, ছেলেকে সব চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে।
বেশ নির্বিবাদী মানুষ এই অবিনাশ বাবু। একাই থাকেন, বিশেষ কারো সাথে মেলামেশা নেই, মাঝে মাঝে একটু চোখাচোখি, হাসি আর কুশল বিনিময় ছাড়া কিছু হয় নি।
কদিন থেকেই অবিনাশ বাবুর পাঞ্জাবির কোনাটা ছেঁড়া। কর্মচারীদের বললে তারাই হয়ত সেলাই করে দেবে, তবুও বাঁধো বাঁধো ঠেকে অবিনাশ বাবুর। অস্তরাগের এত মানুষের মাঝে শুধু ঐ মহিলার সাথে ছাড়া আর কারো সাথেই তেমন কথা হয়নি। বাধ্য হোয়েই সান্ধ্য চায়ের আসর থেকে ফেরার পথে বলেই ফেললেন মিনতি দেবী কে, “ যদি কিছু মনে না করেন আমার পাঞ্জাবি টা যদি…”, বলে পাঞ্জাবির কোনাটা দেখালেন।
মিনতি দেবীও যে লক্ষ্য করেন নি তা নয়, তবে এই বয়েসে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাওয়া টা শোভনীয় নয় ভেবেই আর বলেন নি।
পাঞ্জাবির সূত্র ধরে আলাপটা বেশ এগিয়ে গেছে। মিনতি দেবীও বেশ সাবলীল এখন অবিনাশ বাবুর সাথে কথা বলতে। প্রাতঃভ্রমন আর সান্ধ্যভ্রমন ওনারা একসঙ্গেই করে থাকেন।
সান্ধ্য চায়ের আসরে মাঝে মাঝে অনুপস্থিত থেকে নিজেদের একান্তে আলাপচারিতা……বেশ ভালো লাগে। দিনের শেষে সেই একাকীত্ব আর গ্রাস করে না।
ছোট খাট হাল্কা কাজ, একটু হাসি গল্প আর অনেক খানি সঙ্গ জীবনের শেষ প্রান্তে আসা দুটো মানুষ কে মিলিয়ে দেয় ভালবাসার উষ্ণতার প্রলেপে।
পাঁচটা বাজে…এখুনি অবিনাশ বাবু চায়ের খোঁজে এসে পড়বেন। মিনতির চা ছাড়া ওনার আজকাল মন ওঠে না।