“শুধু অসমের লড়াই নয় দেশ-মানবতা বাঁচাবার এই লড়াইয়ের বর্শাফলকের নাম মমতা”
কোচবিহারের দেবীগঞ্জ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত উইলিয়াম র্যাডক্লিফ যে কলমের আঁচড় কেটেছিলেন তার রক্তাক্ত ক্ষত ছিন্ন বাঙালি আজও বহন করে চলেছে। দেশভাগের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা নিয়েই বাঙালি জীবনের লড়াইয়ে থেকেছে। উদ্বাস্তু ছিন্নমূল জীবনের অভিশাপ এদেশে বাঙালির থেকে আর বেশি কেউ বহন করেনি।
আমি নিজে এক উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান। শৈশব আর কৈশোরের বেড়ে ওঠা যাদবপুরের কলোনিতে। পরিবার, সমাজ, পারিপার্শ্বিকে তাই ছিন্নমূল মানুষের ভিটে থেকে উচ্ছেদ হওয়ার যন্ত্রণাক্লিষ্ট রোমন্থনের আবহে আমার বেড়ে ওঠা।
মাস কয়েক আগে একটি কাজে আসাম যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। নাগরিক পঞ্জিকে কেন্দ্র করে, সেখানকার বাঙালিদের মধ্যে যে ভয়ের পরিবেশ লক্ষ্য করে ছিলাম তা লিখেছিলাম খবর ৩৬৫ দিনে। সেই সময় নাগরিক পঞ্জির প্রথম খসড়া প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। আমার আগের লেখায় আমি উল্লেখ করেছিলাম যে দশপুরুষের বেশি আসামে বসবাসকারী পরিবারেরও নাগরিক পঞ্জির প্রথম খসড়ায় ঠাঁই হয়নি।
৩০শে জুলাই ২০১৮ চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়েছে। আর তার সাথে সাথেই “নিজ ভূমে পরবাসী” হয়ে গিয়েছেন আসামে বসবাসকারী চল্লিশ লক্ষের বেশি মানুষ- অধিকাংশই বাঙালি।
গোটা আসামে বাদ পরা চল্লিশ লক্ষ নাগরিকের মধ্যে বরাকের তিন জেলা কাছার, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির অন্ততপক্ষে পাঁচ লক্ষ বাঙালি রয়েছে। ‘ নিজ ভূমে পরবাসী’ হওয়া বাঙালিদের অনেকেই বলছেন এই এনআরসি মোটেই নাগরিক চিহ্নিত করণের প্রক্রিয়া নয়। এটা আসলে আসাম থেকে প্রকৃত ভারতীয় অথচ ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সরানোর প্রক্রিয়া। তালিকায় নাম না থাকা বহু বাঙালি যন্ত্রনায় কাতর হয়ে গিয়ে বলছেন যে এনআরসি আসলে উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে আরো একটা বাঙালি খেদাও অভিযান।
গোটা আসাম জুড়েই এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই আতঙ্ক আরো বেড়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ায়। পনেরো কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়েছে আসাম। প্রশ্ন উঠছে ‘নিজ ভূমে পরবাসী’দের বুলডোজ করবার জন্যেই কি এত সেনা মোতায়েন করা হলো? দেশের সংবিধানে যে কোনো রাজ্যে বসবাস করার মৌলিক অধিকার দেশের নাগরিকদের রয়েছে। অথচ একশো বছর ধরে আসামে বসবাসকারীর তালিকায় নাম নেই। নাম নেই দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারের সদস্যদের। কাছারের এমএলএ দিলীপ পালের স্ত্রী অর্চনা পালেরও নাম তালিকায় নেই। তালিকা থেকে বাদ গেছেন প্রাক্তন এমএলএ আতাউর রহমান। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে নির্বিচারে উদ্বাস্তুর তকমা লেগে গিয়েছে বাঙালি সহ অন্যান্য মানুষদের উপর। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ভাষা সৈনিক, বাঙালী বীর তপধীর ভট্টাচার্য আসামে এনআরসি প্রয়োগের মধ্যে বিশেষ উদ্দেশ্য দেখছেন। তার কথায় – “চল্লিশ লক্ষ লোকের নাম নেই।গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সর্বনাশ হচ্ছে। উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদ গোটা দেশকেই বিভ্রান্ত করছে। এখন শুনছি অন্য রাজ্যেও এনআরসি করতে চায়। আসলে বাংলা ভাষায় কথা বললেই বিপদ।”
পরিস্থিতি ভয়াবহ। বাঙালি সহ তালিকায় নাম না থাকা অন্যান্য মানুষও দিশাহারা। এই অসহায় মানুষদের পাশে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন জনতার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে গোটা বিষয়টিকে তিনি বড় ধরনের মানবিক সমস্যা হিসাবে দেখছেন। তালিকা থেকে বাদ পরা দের পাশে সর্বশক্তি দিয়ে থাকার কথা জানিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই আশ্বাস ‘নিজ ভূমে পরবাসী’দের মনে শক্তি জুগিয়েছে। আসলে এই তালিকা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দ্বিচারিতা পরিস্কার হয়ে গিয়েছে। ৩০শে জুলাই -এ দেওয়া সিপিএম আসাম রাজ্য কমিটির বিবৃতি আর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য কমিটির পক্ষে সম্পাদক সূর্য মিশ্রের বিবৃতি স্ববিরোধিতায় ভরা।
চল্লিশ লক্ষ মানুষের পক্ষে লড়াই আসলে মানবতার পক্ষে অবস্থান। বিজেপির মানুষ খেদাও অভিযানের বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই সময়ের চাহিদা। আর দেশ ও মানবতা বাঁচাবার এই লড়াইয়ের বর্শাফলকের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
(সৌজন্যে:-খবর ৩৬৫ দিন)