বাঙালি হয়ে একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলায় আধুনিক সমাজ তৈরির পথিকৃৎ যদি রাজা রামমোহন রায় হয়ে থাকেন, তাহলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পেছনে দায়ী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রাজা রামমোহন রায় শিক্ষা সংস্কারের যে সূচনা করে দিয়েছিলেন সেটা আরও বহুদূর নিয়ে গিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
ইউরোপে তখন শিক্ষা এবং শিল্পবিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ গড়ে তুলতে তখন তারা ব্যস্ত। বাংলা তখন ইংরেজদের অধীনে এবং বাংলার সমাজও অনেক দিক দিয়েই পিছিয়ে। এরকম সময় যদি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলার মানুষদের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কারে না হাত দিতেন তাহলে আমাদের এই সমাজ আরও এক কয়েক দশক পিছিয়ে যেত।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি এমনভাবে সাজাতে চেয়েছিলেন যেন বাংলার প্রতিটি মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন তিনি সেখানকার প্রশাসন এবং শিক্ষায়তনিক দিকে যেসব পরিবর্তন আনেন সেগুলো তার আগে আর কেউ কখনও করেনি। সংস্কৃত কলেজ তিনি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। কোন ধর্ম, জাতিবিদ্বেষ এবং কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় মতাদর্শের ব্যক্তিত্বের জন্য সেখানে পড়াশোনা করার কিংবা যাওয়ার বাধা ছিলনা। উনিশ শতকের সময় বাংলায় এ ধরনের কাজকে নাস্তিকতা এবং ব্লাসফেমি বলে গণ্য করা হতো।
সংস্কৃত শিক্ষার মধ্যেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন তিনি। আগে সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনা করতে হলে চার-পাঁচ বছর সংস্কৃত ব্যাকরণ ‘মুগ্ধবোধ’ পড়তে হতো। বিদ্যাসাগর এই কলেজে যোগ দেওয়ার পর সংস্কৃতকে বাংলায় রূপান্তরিত করেন এবং সেগুলোকে পাঠ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। এরকম করার পেছনে যুক্তি ছিল যেন শিক্ষার্থীরা পছন্দ অনুযায়ী সংস্কৃতে লেখা যেকোন বিষয় সহজেই পড়তে পারে। শুধুমাত্র সংস্কৃত শিক্ষার দিকেই যে তার লক্ষ্য সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। তিনি ইংরেজি, বিজ্ঞান এবং গণিত শিক্ষার প্রতিও সমানভাবে নজর দিয়েছিলেন।
তিনিই প্রথম সংস্কৃত কলেজে ভর্তি ফি এবং শিক্ষণ ফি নেয়া শুরু করেন, ক্লাসে ঠিক সময়ে উপস্থিতি এবং নিয়মানুবর্তিতার উপর কঠোরভাবে জোর দেন, প্রথম সাপ্তাহিক ছুটির প্রচলনও করেন তিনি। পরীক্ষাব্যবস্থারও প্রচলন করেন তিনি।
বিদ্যাসাগরের ভর্তি ফি এবং শিক্ষণ ফি নেওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নেওয়া যায় তাহলে প্রতিষ্ঠান চালাতে সুবিধা হয়। তাই সরকারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান করার লক্ষ্যে তিনি এই কাজ শুরু করেন।
বিদ্যাসাগর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাসিক পরীক্ষা নেওয়ার শুরু করেন। এটাও তাঁর আরেকটি দূরদর্শিতার প্রমাণ। বর্তমানে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সার্বক্ষণিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা দেখা যায় সেটি তিনি দুশো বছর আগেই শুরু করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে বছরে একটিমাত্র পরীক্ষা না নিয়ে সারা বছরই যদি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয় তাহলে সারা বছর শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার মধ্যেই থাকবে। উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে শিক্ষার গুরুত্ব ঠিক কতটা তা তিনি জানতেন বলেই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন তিনি।
তিনি যে শুধু সংস্কৃত কলেজের উন্নতির জন্যই যে কাজ করেছেন এমন কিন্তু নয়। তাঁর কাজের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে সরকার থেকে তাঁকে বাংলার বিভিন্ন স্কুলের ইন্সপেক্টর নিযুক্ত করা হয়। ইন্সপেক্টর বা পরিদর্শক নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি চারটি জেলায় প্রায় বিশটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠাই করেননি, সেগুলোর তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বও নেন তিনি, আধুনিক সিলেবাস তৈরি এবং শিক্ষকদের নিয়োগ করার জন্যও তাঁর ডাক পড়তো।
শুধুমাত্র নতুন আঙ্গিকে পুরো শিক্ষার প্রেক্ষাপট তৈরি করেই তিনি থেমে থাকেননি। শিক্ষকদেরকেও তৈরি করেছেন তিনি। তিনি জানতেন, যারা এই নতুন আঙ্গিকে গড়া সিলেবাস পড়াবে তারা নিজেরাও এরকম শিক্ষাব্যবস্থার সাথে পরিচিত নয়। তাই তাদেরকে ঠিকভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে তিনি প্রতিটি স্কুলের সাথে নর্মাল স্কুল বলে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুপারিশ করেন, যাতে শিক্ষকদেরকেও ঠিকভাবে প্রস্তুত করা যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুধু শিক্ষা প্রসারেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। শিক্ষার্থীদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে পড়াশোনা করা এবং সেই পড়াশোনাকে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। এই ব্যাপারটি তিনি খুব গুরুত্ব নিয়ে ভেবেছেন। তাই পাস করে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের জন্য যেন কাজের ব্যবস্থা এবং সুযোগ তৈরি করা হয় সে ব্যাপারে সরকারের কাছে সুপারিশ করেন এবং অনেকটা সফলও হন।
মেয়েদের পড়াশোনাতেও বিদ্যাসাগরের অবদান কিছু কম নয়। তিনি জানতেন, সমাজে আদর্শ শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হলে নারী-পুরুষ উভয়েরই শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। তিনি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেন, পরবর্তী সময়ে যার নামকরণ করা হয় বেথুন কলেজ হিসেবে। নারীশিক্ষায় অর্থের জোগানের ব্যবস্থাও তিনি করেন, যা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল। এখান থেকে মেয়েদের শিক্ষার জন্য যাবতীয় অর্থের ব্যবস্থা করা হতো।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুধু নিজে শিক্ষিত হয়ে থমকে থাকেননি। পড়াশোনার গুরুত্ব সবাইকে বোঝানোর জন্য এবং একটি শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলার জন্য তিনি আজীবন কাজ করে গিয়েছেন। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে যে, কোথাও পড়ানোর জন্য বইয়ের ব্যবস্থা নেই, তিনি নিজের পয়সা খরচ করে সেখানে বইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাঁর জীবনের অন্যতম লক্ষ্যই ছিল সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে আসা এবং সমাজকে শিক্ষিত করে তোলা।