হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকের পাতা জুড়ে দাঙ্গা, রক্তপাত, হানাহানির ছবি- হিন্দু-মুসলমান একে অপরের শত্রু, ক্রমশ এমন একটা আবহাওয়া তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক মাধ্যমে। বর্তমান ভারতবর্ষে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমও এই নোংরা খেলার অংশীদার। দুই ধর্মের সাধারণ মানুষ একে অপরের শত্রু মাত্র- সত্যিই কি তাই? এরাজ্যের কিছু জায়গায় দাঙ্গা ছড়িয়েছে সাম্প্রতিক অতীতে, কিন্তু এটাই রাজ্যের সার্বিক চিত্র না। সম্প্রীতির নজির আলাদা করে খুঁজতে হয় না। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বাস্তব দেখা যায়।
পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বর ব্লকের একটা গ্রাম কাইগ্রাম। কুসুমগ্রাম থেকে মোটামুটি ছয়-সাত কিলোমিটার দূরত্বে এই গ্রাম। গ্রামের ইতিহাস প্রাচীন, বসুমুন্সী জমিদার বাড়ি এই গ্রামেই। প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো টেরাকোটা মন্দির, দুর্গাদালান, ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ি এই গ্রামের ঐতিহ্য বাড়িয়েছে। গ্রামে একটা বিশাল বড় দিঘিও আছে। এই অঞ্চলটা মুসলিম প্রধান। গ্রামের শুরুতেই মুসলিম পাড়া। তারপর একটু এগোলেই হিন্দুপাড়া। বুঝতেই পারবেন না, দুটো আলাদা ধর্মের বাস, একদম পাশাপাশি বাড়ি। এই গ্রামে আমার বন্ধুর বাড়ি। ওর মুখে গ্রাম নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। আমি তিনবার গেলাম ওর বাড়ি, কাইগ্রাম। এবার ঈদের ছুটি সপরিবারে বন্ধুদের সাথেই কাটালাম কাইগ্রামে। আগ্রহবশত ঘুরলাম গোটা গ্রাম, কথা বললাম দুই ধর্মের মানুষের সাথেই।
ঈদে প্রায় প্রতিটা মুসলিম বাড়িতেই হিন্দু বন্ধুদের নেমন্তন্ন। হিন্দু বাড়ির নানান পূজো, বিয়ে-প্রায় প্রতি অনুষ্ঠানেই মুসলিম বন্ধুদের ডাক পড়ে। নির্দ্বিধায় একে অপরের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। শুধুমাত্র বাড়িতে নেমন্তন্ন না, জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রেও একে অপরের উপর নির্ভরশীল গোটা গ্রাম। চাষের কাজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। বন্ধুর বাড়ির পাশে একটা ছোটো দিঘি আছে, মাছ চাষের কাজে আসে হিন্দুরা। বন্ধুর বাড়িতেই চা-জল খাবার খায় তারা। বসুমুন্সী জমিদার বাড়ির উত্তরসূরী শুভ্রকান্তি বসু এসেছিলেন বন্ধুর বাড়িতে বিরয়ানি খেতে, গল্প করলাম জমিয়ে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানলাম গ্রামের হাল-হকিকত। বারবার একটা কথাই উঠে এল, সবার ধর্ম নিজের কাছে। কখনও ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ায়নি এই গ্রামে। গোটা দেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও গ্রামে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি হয়নি। একে অপরের পরিপূরক হয়ে বেঁচে আছে মানুষগুলো।
পুরো মন্তেশ্বর ব্লকেই সম্প্রীতির একই চিত্র, মুসলিমরা সংখ্যাগুরু। অনেকেই ভাববেন হয়ত, প্রতিদিন ধর্মীয় আগ্রাসনের শিকার হোন হিন্দুরা। হিন্দুদের আতঙ্ক তো নেইই, একসাথে মিলেমিশে আনন্দে থাকাটাই যেন মজ্জাগত।
রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন নেতা-নেত্রীরা ঘৃণার চাষ করছেন, লড়িয়ে দিচ্ছেন দুই ধর্মের সাধারণ মানুষকে। দুই সম্প্রদায়ের মৌলবাদীরা নখ-দাঁত বের করে নষ্ট করতে চাইছেন এই বাংলার পরম্পরাকে। অতীতেও হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, কিন্তু তা কখনই সম্প্রীতির পথে অন্তরায় হতে পারেনি। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যে ভারতের স্বপ্ন দেখছেন, বাংলার এই গ্রাম গুলো সে পথে বাধা হয়ে সম্প্রীতির নজির হয়ে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে। সাম্প্রতিক অতীতে দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়ছে, দাঙ্গার খবর আসছে- এগুলো যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি শুধু কাইগ্রাম বা মন্তেশ্বর ব্লক না, বাংলার বেশিরভাগ জায়গায় এই সম্প্রীতিই বাস্তব।