(বিশ্বকাপে এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত খেলতে আসা ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের ২৫ বছরের স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু বিশ্বকাপের সব আলো যেন নিজের দিকেই টেনে নিলেন।
আজ তিনি যে অবস্থানে আছেন, সেখানে আসাটা তাঁর পক্ষে মোটেও সহজ ছিল না। এক অসম্ভব দরিদ্র পরিবার থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উঠে আসা, অনেকের কাছেই অসম্ভব হলেও, লুকাকু তা সম্ভব করে দেখিয়েছেন। দারিদ্রের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবার সংগ্রাম তিনি নিজের মুখে বললেন ‘ প্লেয়ারস ট্রিবিউন’এ…..)
‘ আমার বয়স তখন ছয়। যখন স্কুলের বিরতিতে বাড়ি যেতাম তখন প্রতিদিন আমার মা আমাকে দুধ আর পাউরুটি খেতে দিতেন। প্রতিদিন একই খাওয়ার পেছনে যে কারণ, তা আমি ওই বয়সেই বুঝতে পারতাম। মাকে বলতাম, একদিন আমি বেলজিয়াম ক্লাবের খেলোয়ার হব, আর তখন তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। একদিন দেখলাম আমার মা দুধের সাথে জল মিশিয়ে আমাকে খেতে দিচ্ছেন অথচ মায়ের মুখে হাসিটুকু লেগে আছে। সেদিন বুঝতে পারলাম যে আমরা শুধু দরিদ্র নই, আমরা প্রায় নিঃস্ব!
একে একে বাড়ি থেকে ফ্রিজ, টিভি এমন কি ইনেকট্রিসিটিও চলে গেল।তখন আর শাওয়ারের গরম জলে স্নান করতে পারতাম না। মা কেতলী করে গরম জল করে দিত।
আমার বাবাও একজন ফুটবল খেলোয়ার ছিলেন। তবে তখন তিনি আর বিশেষ খেলতে পারতেন না। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কত বছর বয়সে জাতীয় ফুটবল খেলা যাবে। তিনি বললেন, ১৬ বছরে। তার মানে আরো বেশ কয়েক বছর!
যখন আমার বয়স ১০, তখনও আমি চাম্পিয়নস লীগের খেলা দেখতে পেতাম না। কারণ খেলা দেখার মত কোনো সাধন আমার কাছে ছিল না।
তবে আজ আপনাদের বলি….আমার জীবনের প্রতিটি খেলাই ছিল আমার কাছে ফাইনাল!
যখন আমি পার্কে খেলেছি, সেটি ছিল ফাইনাল, যখন কিন্ডারগার্টেনে খেলেছি তখনও সেটি ছিল ফাইনাল! যতবার শট করতাম ততবার বলটিকে যেন ছিঁড়ে ফেলতাম, সমস্ত শক্তি দিয়ে মারতাম। তবে সে মারার মধ্যে কোনো সৌন্দর্য ছিল না। কারণ আমার কাছে ফিফা নেই, প্লেস্টেশন নেই, খেলার সুবিধা নেই, তাই আমি যেন প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলতে চাইতাম।
বড় হচ্ছিলাম যখন অনেক লম্বা হয়ে গেলাম। ক্লাবে খেলতে গেলে সবাই আমার বয়স নিয়ে সন্দেহ করত। জিজ্ঞেস করত, বয়স কত? প্রতিবার তার জন্যে আমাকে স্কুলের প্রমাণ পত্র দেখাতে হত।
আমার জীবনের লক্ষ্য স্থির ছিল।
যখন আমার বয়স ১২ তখন আমি ৩৪ টি খেলায় মোট ৭৬ টি গোল করেছিলাম।
বাবার জুতো আমার পায়ে হয়ে যেত তাই বাবা এবং আমি যার যার খেলায় সেই একই জুতো পরে খেলতাম।
আমার দাদুকে ( মার বাবা) একদিন ফোন করে আমার ৭৬ টি গোল করার কথা বললাম। তিনি ফুটবল খেলায় আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন। শুনে তিনি বললেন, তুমি কি আমার মেয়েকে ( আমার মা) দেখে রাখবে? আমি বুঝতে পারলাম না, কেন তিনি একথা বলছেন! বললাম, নিশ্চয়ই দেখে রাখব।
এর পাঁচ দিন পর দাদু মারা গেলেন। খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। তিনি যদি আর ক’টা বছর বাঁচতেন তবে আমার খেলা দেখতে পেতেন! তবে আমি দাদুকে দেওয়া আমার কথা রেখেছি।
মাকে বলেছিলাম, আমার ১৬ বছর বয়সে আমি করে দেখাব!
১১ দিন দেরী হল।
২৪ মে ২০০৯।
অ্যান্ডারলেচ বনাম স্টেন্ডারড লীগের ফাইনাল।
অযান্ডারলেচের আন্ডার ১৯ খেলার খেলোয়ার আমি। কিন্তু আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কোচকে বললাম, আমার ১৬ বছরের জন্মদিনে কেন কন্ট্রাক্ট সই করিয়েছেন? আর আমাকে এখন আন্ডার ১৯শে বসিয়ে রেখেছেন কেন?
আমাকে খেলতে দেওয়া হোক। আমি গ্যারেন্টি দিচ্ছি যে আমি ডিসেম্বরের মধ্যে ২৫ খানা গোল করে দেখাব।
কোচ বললেন, আচ্ছা। তবে যদি ২৫ টি গোল করতে না পার তবে আবার বসিয়ে দেব।
নভেম্বর এর মধ্যেই আমি ২৫ টি গোল দিয়েছিলাম।
এরপর এসে গেল সেই অপ্রত্যাশিত ডাক। কোচ সেদিন আমাকে স্টেডিয়ামে ডেকে পাঠালেন, বললেন, সকলে তোমাকে চাইছে। আনন্দে আত্মহার হয়ে গেলাম। ড্রেসিন রুমে ঢোকার মুখে কিটম্যান জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওকে, ছোট ছেলে, তোমার কোন নম্বরটি চাই?’
আমি বললাম, আমাকে ১০ নম্বরটি দিন।
সেই প্রথম আমার বড় খেলা! তারপর আমার নাম ধীরে ধীরে বিখ্যাত হতে লাগলো। সেই শুরু……..
২০০২ সনে খেলার সময় আমার জুতোর তলায় বড় ফুটো ছিল। তার ১২ বছর পর আমি ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে নামি।
আজ যদি আমার দাদু বেঁচে থাকতেন তাহলে বলতাম…….. দেখ! তোমার মেয়ে কত ভাল আছে। এখন আমাদের বাড়িতে আর ইঁদুরের উপদ্রব নেই। আর আমরা মাটিতে শুই না। এখন আমাদের দুশ্চিন্তা নেই। আমরা ভাল আছি…….
এখন আমাকে আর প্রমাণ পত্র দেখাতে হয় না। সবাই এখন আমাকে চেনে,আমার নাম জানে!
(সংগৃহিত)