অনেক সময়ই বাংলা ছবিতে মেলোড্রামার ব্যাবহার নিয়ে অনেকে নাক সিঁটকান। কারন মেলোড্রামার চূড়ান্ত ফর্ম যা আসলে ঋণাত্মক। বিশেষত নব্বইয়ের দশকের ছবিতে কান্না-হাসির অসংলগ্ন প্রকাশ দেখা যায়। মেলোড্রামার ঋণাত্মক হওয়াটা দুর্ভাগ্যের। তবে সৌভাগ্যের সময় হলো মুলত পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক এবং সে সময় প্রাসঙ্গিক ও আধুনিক মেলোড্রামার ব্যবহার। এব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। তাঁর ছবিতে এপিক মেলোড্রামার সাথে কনটেম্পোরারি কালচারের এত ভালো সহাবস্থান- যার কিছু নিজস্ব মেটাফিজিক্যাল প্রশ্ন আছে, নির্দিষ্ট উত্তরের আশাও আছে। বাস্তবে ‘এপিক’ এবং ‘মেলোড্রামা’ এই দুটি শুধু শব্দের যোগসাজশ নয়, এদের নিয়ত ঘাত-প্রতিঘাত যেটা একটা নতুন এস্থেটিকের জন্ম দেয়।
এপিক মেলোড্রামা প্রসঙ্গে আসে ব্রেখতের কথা, তাঁর এপিক থিয়েটারের প্রতিফলন আসলে আধুনিক মহাকাব্যের সবথেকে সাসটেনড ফর্ম। ‘মিমেটিক রিয়েলিজম’ আর বিনোদনের ফর্ম নিয়ে কাটা ছেঁড়া ছাড়াও দর্শককে বৃহৎ ভাবে যুক্ত করার প্রচেষ্টা ছিল, যেটার আর একটা দিক হলো সহজবোধ্যতা এবং সমালোচনার প্রতিফলন। একটা সামঞ্জস্য, ‘gestus’ এবং ‘gist’ এর, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি এবং চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গির –যেটাকে ব্রেখত নিজেই বলেছেন, “The realm of attitudes adopted by the characters towards one another is what we call the realm of the gest.” প্রসঙ্গত অভিনয়েরও একটা এপিক ফর্ম আসে…… চরিত্রায়ন যদি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়,যেটা রপ্ত করতে হয়, তাহলে সহজ এবং স্পষ্ট চরিত্রায়নে যাওয়া উচিত নয়, বরং যেটাকে ব্রেখত বলছেন ““consider various other conceivable pronouncements” এবং “build into the character that element of ‘Not-But’”, এটা শুধুই পুনর্নির্মাণ নয়, ক্রিটিকাল কনটেমপ্লেশানের সম্ভাবনাও থাকে। ব্রেখত আসল এবং নকল অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন, আইজেনস্তাইনের মতই…যেটা ‘anti-illusionism’ থেকে বর্তমানে ‘hyper-realism’ এর রূপান্তর।
ঘটকের মেলোড্রামাকে অনেকেই ব্যাকডেটেড রিগ্রেশান বলেছেন। কিন্তু ঘটকের মত হলো, “Melodrama is a birthright” এবং এটাই সামাজিক দ্বন্দ্বকে বের করে আনে। পরিবার, চাহিদা, আত্মহত্যা এগুলো ঘটকের ছবির মূল থিম, বাস্তব এবং কল্পনার বোঝাপড়া। এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো চলচিত্রে প্রাচীন মহাকাব্যের ব্যাবহার (বিশেষত রামায়ন এবং মহাভারত)…যাদের ন্যারেটিভ ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরে এবং দৈনিক জীবনযাপনে। ঘটকের নিজের কথায়, “We are an epic people. We like to sprawl, we are not much involved in story-intrigues, we like to be re-told the same myths and legends again and again. We, as a people, are not much sold on the ‘what’ of the thing, but the ‘why’ and ‘how’ of it. This is the epic attitude.” ঠিক যে সময় বাংলা মূলধারার চলচিত্র Octavio Paz এর ভাষায় “project of nationhood”কে বার বার প্রদর্শন করছে, সেই অদ্ভুত সময়ে ঘটক পড়ে থাকেন অবিভক্ত বাংলার অতীতকে আঁকড়ে। এখানেই বাংলা মূলধারার ছবিতে মেলোড্রামার উপস্থিতি থাকা সত্বেও ঘটকের ছবির থেকে আলাদা। তাই হয়ত দেশভাগের গভীর ক্ষত ঘটকের ছবিতে প্রায়শই আসে। বিশেষত তাঁর partition trilogy সে সময়ের নেহেরুর সময়ে সামাজিক অবস্থান এবং ক্যাপিটালিস্ট মুভমেন্টকে সরাসরি অস্বীকার করে। ঘটকের মেলোড্রামা সময়ের অস্থিরতাকে দেখায়, সমাজকে দেখায়, প্রতিবাদ করে সমাজে ঘটতে থাকা অন্যায়ের। স্বপ্নভঙ্গের পরে, পোস্ট-কলনিয়াল সময়ে তিনি যেন নির্ঝর তুল্য -শিল্পই একমাত্র অস্ত্র।
সাতচল্লিশের দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা এক মধ্যবিত্ত পরিবার “মেঘে ঢাকা তারা” ছবির প্লট, যাদের জীবনযুদ্ধ চলে কলকাতার বাইরের এক রিফিউজি কলোনিতে। সম্বল হারা বয়স্ক বাবা এবং বড় দাদার সঙ্গীতকে জীবিকা হিসেবে গ্রহন করা- বাড়ীর বড় মেয়ে নীতাকে বাড়ীর একমাত্র উপার্জনকারী করে তুলেছিল, মা এবং দুই ছোট ভাইবোনের ভারও একরকম তার উপরেই। ছোট ভাই মনটু খেলায় নাম করে পাশের ফ্যাক্টরিতে কাজ পেল, তাকে নিজের জীবনযাপনের জন্য কলোনি ছাড়তে হোল। ঘটনাচক্রে এক বছরের মধ্যে দুর্ঘটনায় সে তার একটি পা হারাল, আবার কলোনিতে ফিরে এলো ব্রাত্যের মতো। বিজন ভট্টাচার্য (বাবা) নিখুতভাবেই পূর্ববঙ্গের রিফিউজি। অসম পরিবেশে বাস্তুহারার জীবন তাঁর, অথচ ধানভরা মাঠের সৌন্দর্য প্রকাশ করেন কিটসের কবিতার মাধ্যমে। ঘটনাচক্রে তিনিই বাংলা থিয়েটারের অভিনয়ে ব্রেখতের gestusকে রূপ দেন। নীতার কষ্ট দেখে সনৎ চাকরি করতে চায়, নীতাই তাকে পড়াশুনার অনুপ্রেরণা দেয়। কিন্তু ছোট বোন গীতার সাথে সনৎের যোগাযোগ শুরু হয়, দানা বাঁধে সম্পর্ক। তাদের মাও চায় এ সম্পর্ক। এর মধ্যে শঙ্কর চলে যায়, ফিরে আসে গায়ক হয়ে। নীতার লুকিয়ে রাখা যক্ষ্মা ধরা পরে যায় শঙ্করের কাছে। শঙ্কর তাকে চিকিৎসার জন্য পাহাড়ে নিয়ে যেতে চায়, নীতার চিরকালীন বাসস্থান।
শব্দের ব্যাবহার ঘটকের এ ছবির এক উল্লেখ্য বিষয়, যেটা আইজেন্সটাইন-পুদভকিন-আলেক্সান্দ্রভ মানিফেসটোর সরাসরি প্রভাব। নীতা সনৎের ঘরে গেলে অন্য মহিলার উপস্থিতি টের পায়। সে বেরিয়ে আসে এবং সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। আমরা সেই মুহূর্তে চাবুকের শব্দ শুনতে পাই, বুর্জোয়া সমাজের বিশ্বাসঘাতকতা আর স্বপ্নভঙ্গের চাবুক। নীতার মা যখন নীতা এবং সনৎের মেলামেশা দেখেন, আমরা তেল পোড়ার শব্দ পাই, অদ্ভুত অস্থিরতায় ছেয়ে যায় পরিবেশ। ফলস্বরূপ তার মা গীতাকে দিয়ে সনৎের জন্য খাবার পাঠায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী চলে যাওয়ার ভয় তাকে গ্রাস ধরে।
ঘটকের কাছে যেন পরিবারের ভালবাসা এবং দেখাশোনার দিকটা ধূসর হয়ে পড়েছে আধুনিকতার চাপে। অথচ শঙ্করের নীতার উপর নির্ভরশীলতার লজ্জা যেন ঢেকে যায় নীতারই ভালবাসার শব্দে। এ এক অদ্ভুত দ্বৈত, এই নিঃশর্ত ভালবাসা যেন সময়ের সঙ্গে পুরনো হয়ে পড়েছে, আধুনিকতার মোড়কে একেবারেই মানানসই নয়। কিন্তু এই ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতেই যেন ঘটক নীতাকে চিরকালীন এক মাতৃসত্তাতে রূপান্তরিত করেছেন। জগদ্ধাত্রী পুজার দিন জন্মগ্রহণ করে নীতা সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী রুপে তার পরিবারকেই ধরে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসার মানুষগুলোর আপাত বৈপরীত্য যেন নীতার এই সত্ত্বারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এটা শুধুই প্রাচীন মহাকাব্যের ব্যাবহার নয়, ব্রেখতের ‘এপিক থিয়েটার’ এর ফ্রেমকে ধরে রেখে নিজস্ব অনুভুতি এবং স্বাভাবিক নাটকীয়তাকে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া। যখন শঙ্কর বম্বের সাফল্যের পর বাড়ি ফেরে, সে নীতার ঘরে যায়। নীতা শঙ্করকে দেখে কিছু লুকোতে যায়। ঠিক আগের প্রেম-পত্রের মতো। ঘটনাক্রমে, রক্তভেজা রুমাল পায় সে, যক্ষ্মার খারাপ অবস্থা ধরা পড়ে। একটা পুরুষের ভেঙে পড়া গলার non-diegetic soundtrack। এরপর, রুমালের ক্লোজ-আপ, শঙ্করের লো অ্যাঙ্গেল শট, তারপর নীতার মুখের দুটি অদ্ভুত ক্লোজ-আপ, সে উঠে বসছে, ফ্রেমের নীচের বাঁদিক থেকে উপরের ডানদিকে। চিরাচরিত ১৮০ ডিগ্রি রুল ব্রেক হোল। আবার নীতার ক্লোজ-আপ, এবার ফ্রেমের নীচের ডানদিক থেকে উপরের বাঁদিকে। আবার নিয়মভঙ্গ। এবার দেখি শঙ্করের ক্লোজ-আপ, এবং রুল ব্রেক। দুই চরিত্রের ‘অসম্ভব’ অবস্থান যেন চিরাচরিত এডিটিং কে ভেঙে নাটককে একটু একটু করে মেলে ধরছে। এটা আসলে ডায়ালেকটিক এর প্রকাশ, যার প্রভাব ঘটক নিজেই স্বীকার করেছেন তাঁর “Dialectics in Film” প্রবন্ধে। ফলস্বরূপ, ঘটক ব্রেখতএর দুটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন- Caucasian Chalk Circle এবং Galileo। তাই তাঁর নিজের ছবিও শেষ হয় দ্বন্দের মধ্যে দিয়ে যার কোন নিশ্চিত সমাধান নেই। আমরা শুনি বিদায়ী গান ‘আয় গো উমা কোলে লই’, বাপেরবাড়ি থেকে স্বামীরবাড়ি যাওয়ার চিরকালীন সুর। রক্ত দমকে দমকে নীতার গলা দিয়ে বেরোতে থাকে। এটাকে ব্রেখতের “un-Brechtian” মুভ বলা যেতে পারে যেখানে নেহাতই পারিবারিক গল্প এক মহাকাব্যিক লেন্স এর মাধ্যমে চূড়ান্ত মেলোড্রামাতে রূপান্তরিত হয়েছে। নীতার যক্ষ্মা ধরা পড়ার পর ওদের বাবা “I accuse!” বলে চিৎকার করে ওঠে। ক্যামেরা তাকে সামনে ধরে, মাথার পিছন থেকে, তার হাত যেন পরিবারের বাকিদের দিকে আঙ্গুল তোলে। পরক্ষনেই শঙ্করের প্রশ্নে তার হাত নেমে আসে নীচে, নীতার এই অবস্থার জন্য যেন এই পরিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী।
ছবির শেষে শঙ্করের পারিবারিক ঘটনা দিয়ে নীতাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। নীতা বলে, “আমি বাঁচতে চাই”, সমগ্র আকাশ-বাতাস বলে, “আমি বাঁচতে চাই”, ভূমণ্ডল ছাড়িয়ে এই ডাক অনন্তচরাচরে পৌঁছে যায়। এ যেন ক্যামেরার মাধ্যমে ঘটকের এক তীব্র প্রতিবাদ দেশভাগের বিরুদ্ধে, ভারতীয় আধুনিকতায় পাশ্চাত্যের ছাপের বিরুদ্ধেও। কুমার সাহানির মতে, “In an atmosphere where our cultural attitudes and artifacts have been identified with the objectification of effete feudal Brahminism and European humanism inflicted on us by the colonials, Ritwikda’s work is the violent assertion of our identity. It is the cry of the dying girl in Meghe Dhaka Tara that echoes through the hills, our right to live.”
ছবির একদম শেষে শঙ্কর আর এক যুবতী নারীকে দেখতে পায়, ছেঁড়া স্যান্ডেলকে ঠিক করার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ নীতা কোন বিচ্ছিন্ন নারী নয়, নীতার পরিবারও বিচ্ছিন্ন পরিবার নয়। হাজার হাজার নীতা একইরকম ভাবে কষ্ট ভোগ করে চলেছে। মনে পরে, নীতার স্যান্ডেল ছিঁড়ে যাওয়া, কিন্তু গীতার জন্য শাড়ি আর মনটুর জন্য খেলার জুতো কিনতে হয় তাকে, স্যান্ডেল সারানো আর হয়ে ওঠে না তার। এই স্যান্ডেল আসলে লাকানিয়ান point de capiton, যেটা জীবনের টুকরোগুলোর অপ্রতিরোধ্যতা প্রমান করে।
মেঘে ঢাকা তারা নিতান্ত সাধারন, আমাদের দুচোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া টুকরো টুকরো ঘটনার এক জীবনকাহিনী, চিরপরিচিত, সেই কোন যুগের হিমালয় কন্যা পার্বতীর বাপেরবাড়ি থেকে স্বামীরবাড়ি যাওয়ার কাহিনী। এ এক বিরাট মেটাফর। চারদিনের জন্য আসা বাপেরবাড়িতেও নীতা লড়াই করেই চলেছে, কোন এক সময় আমরাই আবার তাকে বিসর্জন দিয়ে আসি। কিছুদিন পর আবার কাঠামোটাকে তুলে নিয়ে আসা, তৈরি হয় আর এক নীতা। এ এক চিরন্তন প্রবাহমানতা, অনন্তচরাচর জুড়ে বয়েই চলেছে।