গ্রামের ছেলে, সবে মাধ্যমিক দিয়েছে, স্বপ্ন ডাক্তার হবে। এই তো কবছর আগে তার পাশের গ্রামের এক দাদা এনআরএস-এ মেডিক্যাল পড়েছে, এখন মহুকুমা হাসপাতালের ডাক্তার। কিন্তু খবরে যে ভাসছে, রাজ্য বোর্ডের ছেলে-মেয়েরা মেডিক্যাল নীটে পিছিয়ে পড়ছে, মেডিক্যাল কলেজগুলোর দখল নিচ্ছে সিবিএসই বোর্ডের ছেলেমেয়েরা।
কিন্তু গ্রাম-বাংলার ছেলেমেয়েদের ডাক্তার হওয়ার পথে বাধা কি? কবছরে পরিস্থিতি এতটা বদলাল কিভাবে? শেষ দু-তিন বছরে কি মেধা কমে গেল বাংলার ছেলে-মেয়েদের? কঠোর পরিশ্রমের অভাব? না, সেটা তো হতে পারে না, এত কম সময়ে পুরো চিত্র বদলানো অসম্ভব। তাহলে কারণ কি? দু-তিন বছরে কি বদলেছে? উত্তর একটাই, বদলেছে ডাক্তারিতে ভর্তির পরীক্ষা।
২০১২ সালে সারা দেশের মেডিক্যাল শিক্ষাকে এক ছাতার তলায় আনতে শুরু হয় NEET (National Eligibility cum Entrance Test). ২০১২ তে কার্যকরী না হলেও ২০১৩ র ৫ ই মে প্রথম নীট পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট অভিন্ন নীটকে বাতিল করে, দুর্ভাগ্যবশত ২০১৬’য় সুপ্রীম কোর্টই বৈধতা দেয় নীটকে। ২০১৬ সালে শুধুমাত্র হিন্দি ও ইংরেজিতে প্রশ্নপত্র ছিল। ২০১৭ তে বাংলা সহ অন্যান্য অহিন্দি ভাষাতেও পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু এই নীট পরীক্ষা কারা নেয়? উত্তর হল, সিবিএসসি বোর্ড। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যবোর্ডের সিলেবাস ও মেডিক্যাল নীটের সিলেবাস প্রায় এক। স্বাভাবিক প্রশ্ন, তাহলে সমস্যা কোথায়? রাজ্য বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা অনেক গভীরে করতে হয়, প্রশ্নের ধরনও অন্যরকম। নীট পরীক্ষার প্যাটার্ন ও উচ্চ-মাধ্যমিকের প্যাটার্ন অনেকটাই আলাদা। কিন্তু, সিবিএসই র সেকেন্ডারি ও হায়ার-সেকেন্ডারি পরীক্ষার প্যাটার্ন এবং নীটের প্যাটার্ন এক। পরীক্ষা নিচ্ছে সিবিএসই, তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা সুবিধা পাওয়া স্বাভাবিক, পাচ্ছেও। অসম লড়াইয়ের সম্মুখীন হচ্ছে রাজ্য বোর্ডের ছেলে-মেয়েরা। পিছিয়ে যেতে বাধ্য তারা। মেধা নয়, পরিশ্রম নয় – তারা হেরে যাচ্ছে কেন্দ্র সরকারের শিক্ষা নীতির কাছে। সিবিএসই র মাধ্যমে খুন করা হচ্ছে গ্রাম-বাংলার ভবিষ্যতকে।
যে সমস্ত শিক্ষকদের হাতে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ডাক্তার, যোগাযোগ করেছিলাম তাঁদের সাথে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় মূল কারণ হিসাবে উঠে এল সিবিএসই ও নীট পরীক্ষার ধরণ। তাঁরা চোখের সামনে দেখছেন, অসম প্রতিযোগীতার সামনে কিভাবে হীনমন্যতায় ভুগছে ছাত্র-ছাত্রীরা। ডাক্তারিতে বসতে ভয় পাচ্ছে অনেকেই। গত বছর দেখেছি বাংলা প্রশ্নপত্র আলাদা ছিল, প্রসঙ্গত সবচেয়ে কঠিন ছিল। যা অনুচিত, একই প্রশ্নের সব ভাষায় অনুবাদ হওয়াই অবশ্য। সে নিয়ে ভারতের সংসদে বাক বিতণ্ডাও হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার আশ্বাস দিয়েছিল এ সমস্যা হবে না ভবিষ্যতে। গত বছরই রাজ্যে ডাক্তারিতে চান্স পাওয়া রাজ্য বোর্ডের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৭৫% থেকে এক ধাক্কায় কমে ৭% এ দাঁড়ায়। কিন্তু আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও এ বছর আবারও বিপদে পড়ে বাংলা মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীরা। বাংলায় প্রশ্ন ভুল ছিল, কোথাও কোথাও পরীক্ষাকেন্দ্রে বাংলা প্রশ্নপত্র এসে পৌঁছায়নি। এর ফলে রাজ্য বোর্ডের বাংলা মাধ্যমে পড়া ছেলেমেয়েরা আরও অনেকটা পিছিয়ে যায়।
এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে নামকরা বড় মেডিক্যাল কোচিং সেন্টারে পড়া ছাড়া মেডিক্যাল পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশের মতো কোচিং ইন্সটিটিউট গুলো সব জায়গায় মাথাচাড়া দিয়েছে, মোটা টাকার খেলা চলছে। গরীব ছেলেমেয়েরা এই সব ইন্সটিটিউটের নাম উচ্চারণ করতেও ভয় পায়। সিবিএসই র সাথে এই কোচিং ইন্সটিটিউট গুলোর অনৈতিক বোঝাপড়াও হাজার হাজার গরীব ছেলেমেয়েদের স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করছে। কিছুটা দায়ী রাজ্য বোর্ডের পরিকাঠামোও। শিক্ষকের অভাব এ সমস্যা খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে, শিক্ষক নিয়োগ হয়নি বেশ কয়েক বছর। বেশিরভাগ স্কুলেই পড়াশোনার তেমন পরিবেশ নেই। এছাড়া নতুন পরীক্ষা পদ্ধতিতে ধাতস্থ হতে সময় নিচ্ছেন টিউটররাও।
ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজ্য বোর্ড ছেড়ে সিবিএসই তে ভর্তি হচ্ছে অনেকেই, শহর ছাড়িয়ে মফঃস্বলেও গজিয়ে উঠছে বেসরকারি স্কুল। সামান্য সামর্থ্যেও অভিভাবকরা বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করছেন ছেলে-মেয়েদের। কিন্তু গ্রাম-মফঃস্বল-শহরের গরীব ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবে? কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে কেনই বা বেসরকারি তে পড়তে হবে বাধ্য হয়ে? সরকারি স্কুলে শিক্ষা তো তাদের অধিকার।
এর সমাধান কি? উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ধরন সিবিএসই র মতো করে দেওয়া? তাতে স্বতন্ত্রতা ও প্রাসঙ্গিকতা হারাবে রাজ্যবোর্ড, ধ্বংস হয়ে যাবে রাজ্যবোর্ড। সিবিএসই কে হাতিয়ার করে এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে সারা দেশজুড়ে চাপিয়ে দিলে একটা শ্রেণির ছেলে-মেয়েরাই ডাক্তার হবে। শ্রেণি বৈষম্য তীব্র হবে। যারা এ মাটিকে চেনে না, যারা গ্রামকে চেনে না, তারা কিভাবে মানুষের সেবা করবে? তারা কোনো ভাবেই গ্রামে বা মফঃস্বলের হাসপাতালে চাকরি করতে রাজি হবে না, ভেঙে পড়বে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। গ্রামের কোনো ছেলেকে ইংরেজি শিখিয়ে ঘষে মেজে সিবিএসই র কায়দায় মানুষ করলেও সে মাটির ডাক্তার হবে না, সে মানুষের ডাক্তার হবে না, সেও গ্রামে থাকবে না, একথা হলফ করে বলা যায়।
নীট নামক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে মানুষকে। সিবিএসই র হাতে এ রাজ্যের ছেলেমেয়েদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের অপমৃত্যু রুখতে হবে। নীট গরীব ছেলেমেয়েদের উপর অভিশাপ, নীট ফেডেরাল স্ট্রাকচারের উপর আঘাত। নীট প্রত্যাহারের আর্জি জানাই। রাজ্য মেডিকাল জয়েন্ট ফিরে আসুক।
রাজ্য সরকারেরও এ রাজ্যের ছেলে-মেয়েদের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে, দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব পালন করুক সরকার। নীটের বিরোধীতা করুক সর্বশক্তি দিয়ে। তামিলনাড়ু এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে, যৌথভাবে লড়ার সময় এসেছে। রাজ্যবোর্ডকে বাঁচাতে, গ্রাম-বাংলার ভবিষ্যত সুরক্ষিত রাখতে পদক্ষেপ নিতেই হবে রাজ্য সরকারকে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )